চারদিকে পানি। পানির তোড়ে জলমগ্ন আবাসস্থল, সড়ক চারিপাশ। খাবার পানির জন্য যুদ্ধে লিপ্ত খুলনা জেলার সুন্দরবনের কোলঘেঁষা কয়রা উপজেলার মানুষেরা। বেড়িবাঁধ ভেঙে ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।বাঁধে সাতটি বড় ও বেশকিছু ছোট ছোট ভাঙনের ফলে এই ৩৫টি গ্রামের ২৩ হাজার মানুষ সুপেয় পানির সংকটে পড়েছেন।
এই এলাকাটিতে দেখা যায় কলসি, বালতিসহ নানা পাত্র নিয়ে পানির জন্য ছুটছেন মানুষ। লিয়াকত আলী নামের এক লোক বলেন, বৃষ্টির পানি ফুরিয়ে গেছে। নলকূপের পানি লবণাক্ত, এখন তাও ডুবে গেছে। বাধ্য হয়ে নলকূপের পানি পান করতাম। কিন্তু এখন সেটাও হচ্ছে না। ভেলা নিয়ে পাশের গ্রাম থেকে পানি এনেছিলাম। পানিতে এত স্রোত আর যাওয়া যায় না তাই বাধ্য হয়ে পানি কিনে খাচ্ছি।
কাকলী রানীর বাড়ি কয়রার মঠবাড়ী গ্রামে। কাকলী রানী প্রতিদিন ভোরে কলসি কাঁধে বের হন। তিন কিলোমিটার দূর থেকে পানি আনতে হয় তাকে। দীর্ঘদিন এক কিলোমিটার দূরে একটি পুকুরে মিলতো পানি। কিন্তু পানির আধার পুকুরটি ডুবে যাওয়ায় আনতে হচ্ছে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূর থেকে। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পানি আনতেই তার চলে যায় প্রায় দুই ঘণ্টা সময়।
তিনি বলেন, আগে যেখান থেকে পানি আনতাম সেই পুকুর ডুবে গেছে। তাই দূর থেকে পানি আনতে হচ্ছে। এই এক কলসি পানি দিয়ে সারাদিন কোনোরকমে পাঁচ সদস্যের পরিবারকে চালিয়ে নিতে হবে।
আলিমুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ পথ টেনে এনে অনেকেই পানি পান করতে পারেন না। ফলে বাধ্য হয়েই নলকূপের পানি পান করেন অনেকেই। আমি ও আমার শাশুড়িকে মে মাসের শুরুতেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। শাশুড়ির বয়স প্রায় ৭০। পাতলা পায়খানায় এই বয়সে কাহিল হয়ে পড়েছেন তিনি।
কয়রার তিনটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায় প্রায় বাড়িতেই রয়েছে বৃষ্টির পানি জমানোর ট্যাংক বা রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম। কিন্তু এই পানি প্রায় সবারই শেষের পথে। সুপেয় খাবার পানির পুকুর তলিয়ে যাওয়ায় ভোগান্তিতে হাজার হাজার মানুষ। এ ছাড়াও নলকূপের পানি পান করে পেটের নানা রোগ লেগেই আছে এই এলাকার মানুষের।
খাবার পানি কোনো না কোনোভাবে সংগ্রহ করতে পারলেও গোসল, নিত্যদিনের গৃহস্থালির নানা কাজের জন্য নোনাপানির ওপরেই ভরসা করতে হচ্ছে। যা থেকে দেখা দিচ্ছে খোসপাঁচড়া, চুলকানি, রেশসহ নানা রোগ।
মো. আলী বলেন,লবণাক্ত পানিতে কাপড় দীর্ঘ সময় ভেজা থাকার কারণেও ঘটছে বিপত্তি। এই কাপড় শুকানোর পরে সাদা দাগ হয়। পাউডারের মতো বের হতে থাকে। এরপর ধীরে ধীরে কাপড় নষ্ট হয়ে যায়। একে তো দীর্ঘ সময় ভেজা থাকছে তার ওপর লবণ পানি কাপড়ে শুকিয়ে যাওয়ায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ছিঁড়ে যাচ্ছে।
মুদি দোকানদার মো. মিজান। তার পানি বিক্রির লিস্ট থেকে দেখা যায়, ঝড়ের আগের তিনদিন তিনি পানি বিক্রি করেছেন ৯২ লিটার। ঝড়ের দিন বন্ধ ছিল তার দোকান। আর ঝড়ের পরদিন পানি বিক্রি করেছেন ৫১ লিটার। যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল পাঁচ লিটারের বোতল।
কয়রা বাজারের একটি দোকানে মেলে বন্যায় না ডুবে যাওয়া নলকূপের পানি। পরিষ্কার স্বচ্ছ গ্লাসে সেই পানি ঘোলাটে হয়ে দেখা যায়। এরপর সেখান থেকে ধীরে ধীরে নিচে পড়তে থাকে ছোট ছোট দানা। যে পানি পুরোটাই লবণাক্ত।
এখানে সুপেয় পানির সমস্যা দীর্ঘদিনের। ডিপ টিউবওয়েল করেও সফলতা মেলেনি এলাকায়। অধিকাংশ এলাকায় ডিপ টিউবওয়েলেও লোনা পানি ওঠে। আর বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ট্যাংকও নেই সকলের কাছে। তাই কয়রায় এবারের বন্যায় আরো চরম সংকট দেখা দিয়েছে পানির। তিনি আরো বলেন, প্রশাসন থেকে যে পানি সরবরাহ, ব্লিচিং পাউডার ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিচ্ছে তা খুবই নগণ্য। এতটাই অপর্যাপ্ত যে মানুষ জানেই না প্রশাসন থেকে সহায়তা দেয়া হচ্ছে বলে জানান,কয়রা সদর উপজেলার চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবির ।