।। নিজস্ব প্রতিবেদক ।।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জানিয়েছে, বাংলাদেশে ২০১৮ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় ৬ শতাংশ বেড়েছে। একই সময় পণ্যমূল্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। রাজধানী ঢাকায় সংগৃহীত বাজার দর ও বিভিন্ন সেবা সার্ভিসের তথ্য বিশ্লেষণ করে ক্যাব এই হিসাব হাজির করেছে। সংস্থাটি প্রতি বছরের শুরুতে এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে।
ক্যাব জানিয়েছে, ২০১৮ সালে অধিকাংশ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বহুলাংশে স্থিতিশীল ছিল এবং বছরের শেষে চালসহ বেশ কিছু পণ্যের মূল্য ছিল নিম্নমুখী। ডিসেম্বর ২০১৭ এর তুলনায় ডিসেম্বর ২০১৮ এ মোটা চালের দাম ১৫ শতাংশ, ডালের দাম গড়ে ১৭ শতাংশ, তেলের দাম ২ শতাংশ, মসলার দাম গড়ে ২২ শতাংশ, শাক-শব্জির দাম প্রায় ১১ শতাংশ এবং চিনির মূল্য ১১ শতাংশ হ্রাস পায়।
তবে সারা বছর ধরে চালের মূল্য বাড়তিই ছিল। বছরের শেষে সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসলেও ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে সব ধরনের চালের গড় মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। তবে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে সাবানের, যা গড়ে প্রায় ২০ শতাংশ। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে মাছ, তরল দুধ, গরম মসলা, মাংস ও দেশি ডিমের দাম বেড়েছে।
ভোক্তার ঝুলিতে যেসব পণ্য ও সেবা রয়েছে সেসব পণ্য বা সেবা পরিবারের মোট ব্যয়ের সাথে তুলনা করে পণ্য বা সেবার ওজনের ভিত্তিতে জীবনযাত্রা ব্যয়ের এই হিসাব করা হয়েছে। রাজধানীর ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবা-সার্ভিসের মধ্যে থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবা-সার্ভিসের তথ্য এই পর্যালোচনায় বিবেচনা করা হয়েছে। এই হিসাব শিক্ষা, চিকিৎসা ও প্রকৃত যাতায়াত ব্যয় বর্হিভূত।
২০১৮ সালে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে
সব ধরনের চালের গড় মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। গড়ে প্রায় ২০ শতাংশ দাম বেড়েছে সাবানের। মাছের দাম বেড়েছে ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ, শাক-সব্জিতে ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ, চা-পাতায় ৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ, পান-সুপারিতে ৭ দশমিক ১৮ শতাংশ, তরল দুধে ১০ দশমিক ৩৩ শতাংশ, গরম মসলায় ৮ শতাংশ, মাংসে ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ, মুরগিতে ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ, ডিমে ৭ দশমিক ৭১ শতাংশ।
২০১৮ সালে ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির মূল্য প্রতি হাজার লিটারে বেড়েছে ৫ শতাংশ। দুই-কক্ষ বিশিষ্ট বাড়ি ভাড়া বেড়েছে গড়ে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। দেশি থান কাপড়ের দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ৬৪ শতাংশ আর বিদেশি কাপড়ের দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ, দেশি শাড়ির দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ আর গেঞ্জি, তোয়ালে ও গামছায় দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। নারিকেল তেলের দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
২০১৮ সালে যেসব পণ্যের দাম কমেছে
২০১৮ সালের পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ডাল, লবণ, মসলা, চিনি ইত্যাদি পণ্যের দাম কমেছে। দেশি মসুর ডালের দাম কমেছে ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ, আমদানিকৃত মসুর ডালে কমেছে ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ, আস্ত ছোলায় দাম কমেছে ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
দেশে উৎপাদিত রসুনের দাম কমেছে কেজি প্রতি ২০ দশমিক ৫৩ শতাংশ আর আমদানিকৃত রসুনের দাম কমেছে ৩২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, কাঁচা মরিচের দাম কমেছে ১৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। চিনির দাম কমেছে ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ, লবণের দাম কমেছে গড়ে ২ দশমিক ২৬ শতাংশ। বেশ কিছু শাক-সব্জির দামও নিম্নমুখী ছিল, যেমন লালশাকের দাম কমেছে ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ, পটলের দাম কমেছে ১০ দশমিক ১১ শতাংশ, ঝিংগার দাম কমেছে ৯ দশমিক ৭১ শতাংশ, আর ঢেঁড়সের দাম কমেছে ১০ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
যেসব পণ্যে ও সেবার দাম অপরিবর্তিত ছিল
২০১৮ সালে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল এবং বাস ও রেলের ভাড়া বাড়েনি। যে সব পণ্যের মূল্য বহুলাংশে স্থিতিশীল ছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভোজ্য তেল এবং গুঁড়ো দুধ।
ক্যাবের সুপারিশমালা
পণ্য ও সেবামূল্যের গতিপ্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে ভোক্তার স্বার্থ সুরক্ষায় ক্যাব বেশ কিছু প্রস্তাবনা হাজির করেছে। এর মধ্যে রয়েছে,
১. ‘ভোক্তা শ্রেণি’ দেশের সর্ব বৃহৎ অর্থনৈতিক গোষ্ঠী। সরকার প্রতিনিয়ত নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের সিদ্ধান্ত ভোক্তাদের ওপর কি প্রভাব ফেলবে সে বিবেচনা উপেক্ষিত হয়। এমতাবস্থায় ভোক্তা-স্বার্থ বিবেচনা, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভোক্তাদের স্বার্থের বিষয়টি তুলে ধরা, ভোক্তা-স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্যক্রমে সমন্বয় সাধন এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল থেকে দরিদ্র, স্বল্প আয় এবং নিম্ন-মধ্য বিত্তের ভোক্তারা যাতে বঞ্চিত না হোন সে লক্ষ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে রাখার উদ্দেশ্যে ১২ থেকে ১৫টি খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চিহ্নিত করে সে সব পণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে এবং মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য ‘ভোক্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ নামে একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠন করা
২. ধান-চালের মূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং কৃষককে উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত মূল্য প্রদানের লক্ষ্যে পরীক্ষামূলকভাবে কনট্রাক্ট গ্রোয়িং পদ্ধতি অনুসরণ করে ধান কাটার মৌসুমে কৃষকের নিকট থেকে সরাসরি সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান-চাল সংগ্রহ করা ও তাদের জন্য শষ্য বীমার প্রথা প্রবর্তন করা
৩. ক্যাবের প্রস্তাবনা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সংস্কার সাধন করা এবং ‘মূল্য স্থিতিশীলকরণ তহবিল’ সৃষ্টি করে দেশে জ্বালানি তেলের দাম স্থিতিশীল রাখা। এলএনজি আমদানি সকল প্রকার শুল্ক-কর মুক্ত রেখে গ্যাসের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা
৪. যাত্রী দুর্ভোগ ও যানজট কমানোর লক্ষ্যে ঢাকায় বাস চলাচলের ক্ষেত্রে ফ্রানচাইজ প্রথা প্রবর্তন, র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতু প্রকল্পসহ যোগাযোগ খাতের প্রকল্প সমূহের দ্রুত ও সময়মত বাস্তবায়ন করা। অ্যাপভিত্তিক যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে অবিলম্বে আইনি কাঠামো প্রণয়ন করা এবং এসব সেবা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় আইনানুগভাবে বাস-ট্রাকের ভাড়া নির্ধারণের জন্য বিইআরসির অনুরূপ একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা। প্রস্তাবিত এই কমিশনকে লঞ্চসহ অন্যান্য যানবাহন এবং ওয়াসার পানির মূল্য নির্ধারণের দায়িত্বও দেয়া যেতে পারে
৫. ডাক্তারদের ফিসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল্য নির্ধারণ, ওষুধের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ; বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সুলভে মানসম্মত চিকিৎসা সেবা প্রদান নিশ্চিত করা
৬. শিক্ষা খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করার লক্ষ্যে অবিলম্বে শিক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। শিক্ষার মান উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা
৭. খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে আমানতকারীগণ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং তাদের অর্থের নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে। সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নিয়োগ পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে পর্ষদের জবাবদিহিতা বৃদ্ধি এবং আইনের সংস্কার করে দ্রুত খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করা
৮. আমদানি শুল্কের ব্যাপক হ্রাস এবং লবণসহ যে সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ অবিলম্বে সে সব পণ্যের অবাধ আমদানির সুযোগ সৃষ্টি করা
৯. দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তা-স্বার্থ সংরক্ষণে প্রণীত আইন- ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, প্রতিযোগিতা আইন ২০১২, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫ এর বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ওষুধ নীতি বাস্তবায়ন করা। বিএসটিআই ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে শক্তিশালী ও কার্যকর করা
১০. অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল যাতে সুষম বণ্টন হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা। আয় বৈষম্য নিয়ন্ত্রণের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের পদক্ষেপ গ্রহণ করা
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ১২ জানুয়ারি ২০১৯ অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে ২০১৮ সালের ভোক্তার ব্যয় সংক্রান্ত এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূন কবির ভূঁইয়া, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শাহনেওয়াজ চৌধুরী ও সাইফুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। সবার সামনে প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন ক্যাবের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান।
ক্যাবের চেয়ারম্যান বলেন, এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে মানুষের আয় বাড়ছে। কারও আয় বেড়েছে কোটি টাকা, কারও বেড়েছে শত টাকা। যেসব পরিবারের আয় বৃদ্ধির পরিমাণ ৬ শতাংশের বেশি, তাদের জন্য এটি সহনীয়। কিন্তু যাদের আয় ৬ শতাংশ বাড়েনি, তাদের জন্য কষ্টকর। তিনি মনে করেন, আয় বৃদ্ধির ওপর বেশি জোর দেওয়া উচিত। জীবনযাত্রায় ব্যয় সহনীয় থাকুক, আয় বৃদ্ধি দ্রুত হোক। তাহলে জীবনমানের উন্নতি হবে।