ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক
ই-কমার্সের নামে প্রতারণার আরেক ঠিকানা ‘এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেসে’র নাম। দীর্ঘদিন ধরে গ্রাহকের জমানো টাকা দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। ফলে অনিশ্চয়তায় রয়েছে প্রায় ৫০ লাখ গ্রাহক।
ভুক্তোভোগী গ্রাহকরা জানান, বিভিন্ন উপায়ে এসপিসির মাধ্যমে আয় করা টাকাগুলো তাদের ওয়ালেটে জমা রয়েছে। তারা কোনোভাবেই এ টাকা ক্যাশ আউট করতে পারছেন না। গত তিন-চার মাস ধরে তাদের সব গ্রাহকের একই অবস্থা।
নিজেদের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দাবি করলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, এসপিসি মূলত একটি বহু স্তরভিত্তিক বিপণন ব্যবসা (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং- এমএলএম) প্রতিষ্ঠান।
এসপিসির গ্রাহক খুলনার একটি মাদরাসার শিক্ষক মোহাম্মদ আজাদ। মোবাইল ফোনে তিনি বলেন, চলতি বছরের এপ্রিলে এক বন্ধু আমাকে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার মাধ্যমে আয়ের সুযোগের কথা বলে। সে আমাকে এসপিসিতে যুক্ত হয়ে নিয়মিত আয়ের একটি রাস্তা দেখায়। তার কথা শুনে এসপিসিতে ১২০০ টাকা দিয়ে একটি আইডি খুলি। একটি রয়েল আইডি নিতে ১৩টি সাধারণ আইডি করতে হয়। আমি সেটিও নিই। ৯৬০০ টাকা (প্যাকেজ) দিয়ে ১৩টি আইডি কিনি।
এসপিসির অর্থ আত্মসাতের মামলায় বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির এমডি আল আমিন গ্রাহকের ৮২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে নিজের নামে তিনটি প্রাইভেট কার কিনেছেন। এছাড়া সিটি ব্যাংকের একটি হিসাব থেকে গ্রাহকের ৩৫ লাখ টাকা তার স্ত্রী সারমীন আক্তারের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার (স্থানান্তর) করেছেন।
‘এসব আইডি থেকে প্রতিদিন বিজ্ঞাপন দেখে আমি ১৩০ টাকা আয় করতে থাকি। একপর্যায়ে অ্যাকাউন্ট থেকে আট হাজার টাকা তুলে নিই। আয় ভালো হওয়ায় আরও ১৩টি আইডি কিনি। বর্তমানে আমার মোট ২৬টি আইডি রয়েছে। এসব আইডির বিপরীতে প্রতিদিন আমার অ্যাকাউন্টে ২৬০ টাকা জমা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইডিগুলোতে টাকা জমা হতে থাকলেও জুন-জুলাই থেকে কোনো টাকা তুলতে পারছিলাম না। এসপিসির পক্ষ থেকে আমাকে বলা হয়, লকডাউনের কারণে টাকা তুলতে কিছুটা ঝামেলা হচ্ছে। পরবর্তীতে ওই আইডিগুলো থেকে আর কোনো টাকা তুলতে পারিনি। গত চার মাসে আমার কোনো আয় নেই। আইডিগুলোতে মোট ৩৫ হাজার টাকা জমা আছে।’
মোহাম্মদ লিঙ্কন নামে এসপিসির আরেক গ্রাহক ফোনে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বর্তমানে আমার অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা জমা আছে। শুরু থেকে এলাকার এজেন্টের মাধ্যমে ক্যাশ আউট করতাম। এটি অনেকটা বিকাশের মতো। আমরা অ্যাপ থেকে উইথড্র অপশনে (উত্তোলন) চাপ দিলে এজেন্ট টাকা দিয়ে দিত। তবে গত তিন-চার মাস ধরে টাকা পাচ্ছি না। কোনোভাবেই ক্যাশ আউট করা যাচ্ছে না। এজেন্টের কাছে গেলে বলে, কোম্পানি (এসপিসি) থেকে কোনো টাকা আসেনি।’
ই-কমার্সের নামে এমএলএম ব্যবসা ও প্রতারণার অভিযোগে ২০২০ সালে আল আমিনসহ প্রতিষ্ঠানটির ছয়জনকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। ওই সময় জানানো হয়, এসপিসি ২২ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে ২৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
তবে গ্রেফতারের দুই মাসের মধ্যেই জামিনে বের হয়ে আসেন আল আমিন। আবারও নতুন উদ্যমে শুরু করেন ব্যবসা। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির মোট গ্রাহক সংখ্যা ৫০ লাখ। টাকা তুলতে না পেরে ভোগান্তিতে পড়া হাজার হাজার গ্রাহক এসপিসির ফেসবুক গ্রুপগুলোতে পোস্ট দিচ্ছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, বিতর্কিত এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে মানি লন্ডারিং (অর্থপাচার) মামলা হয়েছে।
২০২০ সালে নিজেদের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দাবি করে যাত্রা শুরু করে এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে আছেন আল আমিন প্রধান। তিনি ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের টিম লিডার ও প্রশিক্ষক ছিলেন।
ই-কমার্সের নামে এমএলএম ব্যবসা ও প্রতারণার অভিযোগে ২০২০ সালে আল আমিনসহ প্রতিষ্ঠানটির ছয়জনকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। ওই সময় ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার জানিয়েছিলেন, এসপিসি ২২ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে ২৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তবে গ্রেফতারের দুই মাসের মধ্যে জামিনে বের হয়ে আসেন আল-আমিন। আবারও নতুন উদ্যমে শুরু করেন ব্যবসা।
ব্যবসার সম্প্রসারণের স্বার্থে জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার সঙ্গে শুভেচ্ছা দূতের চুক্তি করে এসপিসি। হু হু করে বাড়তে থাকে তাদের অ্যাকাউন্ট সংখ্যা। একপর্যায়ে তা ৫০ লাখে উন্নীত হয়। যদিও পরবর্তীতে ‘ব্যবসা সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়ায়’ ফেসবুকে এক পোস্টের মাধ্যমে চুক্তি বাতিলের বিষয়টি জানান মাশরাফি।
দুই পদ্ধতিতে এসপিসি গ্রাহকদের আয়ের প্রলোভন দেখায়। প্রথমত, বিজ্ঞাপন দেখে আয় করা এবং দ্বিতীয়ত, রেফার করে আয় (অন্যকে অ্যাকাউন্ট খোলাতে পারলেই আয়)। এসপিসি গ্রাহকদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের লিংক দেয়। সেগুলো দেখলেই টাকা আয় হয় এবং তা গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টে জমা হয়।
এছাড়া এসপিসিতে একটি আইডি খুলতে ১২০০ টাকা লাগে। কেউ যদি তার পরিচিত কাউকে আইডি খুলতে রেফার করেন তাহলে তিনি ১২০০ টাকার মধ্যে ৪০০ টাকা পাবেন। রেফারেল বোনাস দীর্ঘদিন ধরে পেতে থাকবেন গ্রাহক। তবে রেফারেল ও বিজ্ঞাপন থেকে আয়ের এ টাকা তারা নগদ তুলতে পারবেন না। তাদের অনলাইন ওয়ালেটে জমা হবে। টাকা তোলার সময় কাটা হবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, কিনতে হবে এসপিসির পণ্য।
সম্প্রতি এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেসের বিরুদ্ধে অর্থপাচার ও আত্মসাতের তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি। প্রমাণও পেয়েছে তারা।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, এসপিসি অনুমোদনহীন মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা পরিচালনা করে এক কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছে। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলাও করেছে সিআইডি। তবে তদন্ত এখনও চলমান। আত্মসাতের টাকার অঙ্ক আরও বড় হতে পারে। কারণ, তাদের ব্যাংক লেনদেনের পরিমাণ অনেক বেশি।
সিআইডি জানায়, এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেডের মাধ্যমে গত বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয়টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করে। এসব লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা যায়, সেখানে মোট ২২ কোটি পাঁচ লাখ টাকা জমা হয়েছে। তোলা হয়েছে মোট চার কোটি সাত লাখ টাকা
অর্থ আত্মসাতের মামলায় বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির এমডি আল আমিন গ্রাহকের ৮২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে নিজের নামে তিনটি প্রাইভেট কার কিনেছেন। এছাড়া সিটি ব্যাংকের একটি হিসাব থেকে গ্রাহকের ৩৫ লাখ টাকা তার স্ত্রী সারমীন আক্তারের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার (স্থানান্তর) করেছেন।
প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষকে অধিক কমিশনের প্রলোভন দেখিয়ে এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস নামের মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিং এবং বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে অর্থ গ্রহণ করে তা আত্মসাৎ করেছে। তদন্তে সিআইডি জানতে পারে, এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেডের মাধ্যমে গত বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয়টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করে। এসব লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা যায়, সেখানে মোট ২২ কোটি পাঁচ লাখ টাকা জমা হয়েছে। তোলা হয়েছে মোট চার কোটি সাত লাখ টাকা।
খবর: ঢাকা পোস্ট