ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক:
চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ডলার বাজার। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সময়মতো বিদেশি ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ সংকটকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীদের পকেট কাটছে ব্যাংকগুলো। বর্তমানে আমদানি পেমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের প্রতি ডলারের জন্য গুনতে হচ্ছে প্রায় ৮৯ টাকা থেকে ৯০ টাকা।
ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের অভিযোগ, চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে সংকটের কথা বলে নতুন এলসি খুলতে অনীহা ও আগের এলসির পেমেন্ট পরিশোধে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঘোষিত রেটের চেয়ে চার টাকা পর্যন্ত বেশি আদায় করছে ব্যাংকগুলো। এতে ব্যবসায়ীদের আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় পণ্যমূল্যও বাড়ছে। তাই সংকট কাটাতে রিজার্ভ থেকে ডলারের সরবরাহ বাড়িয়ে এলসি খোলার সুযোগ ও দাম নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়েছেন তারা।
এদিকে, প্রায় আড়াই মাস স্থির থাকার পর বুধবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ফের ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রবাসী আয়ের নিম্নমুখী প্রবণতা ও আমদানি ব্যয়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে গত বছরের আগস্ট থেকে ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে ডলারের দাম। ফলে প্রতিনিয়ত ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাচ্ছে। এতে রপ্তানিকারক ও রেমিটাররা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমদানিকারক ও সাধারণ মানুষ। কারণ ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি খরচ বাড়লে পণ্যমূল্যও বাড়ে। এরই মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম বেশ বেড়েছে। এতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, এলসি খোলার সময় ব্যাংকগুলো ডলারের যে রেট ধরে, পেমেন্টের দিনে সেই রেট নিতে চায় না। এমনকি পেমেন্টের তারিখে যেই রেট থাকে সেই রেটেও ডলার দিচ্ছে না। গতকাল আন্তঃব্যাংকে ডলারের দাম ২০ পয়সা বেড়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় উঠলেও সংকটের কথা বলে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অনেক ব্যাংক ৮৯ টাকা থেকে ৯০ টাকা আদায় করেছে বলে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান। চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ী আমাদের সময়কে বলেন, একটি বিদেশি ব্যাংক এলসি পেমেন্টে তাদের কাছ থেকে ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা করে ডলার রেট নিয়েছেন। কিন্তু যখন তিনি এলসি খুলেছিলেন, তখন ডলারের রেট ছিল ৮৫ টাকার মতো। এখন সেটি ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় উঠেছে। কিন্তু ব্যাংকটি সংকটের কথা বলে ঘোষিত রেটের চেয়েও প্রায় চার টাকা বেশি নিয়েছে। তার প্রশ্ন-তা হলে কি যথাযথ মনিটরিং হচ্ছে না। ডলারের দামে লাগাম টানার কি কেউ নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আন্তঃব্যাংকে ডলারের সংকট কি শুধু আমদানি বৃদ্ধির কারণে হচ্ছে, নাকি ব্যাংকগুলো ডলার ধরে রেখেও সংকট তৈরি করছে সেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথ তদারিকর মাধ্যমে দেখাতে পারে। এ ছাড়া খোলাবাজার থেকে কারা ডলার কিনছেন, প্রয়োজনে কিনছেন, নাকি অপ্রয়োজনে কিনে ব্যবসার করছেনও সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার। তিনি আরও বলেন, ডলারের দাম বেশি হলে আমদানি খরচ আরও বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে পণ্যমূল্যেও।
করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ার পর থেকে দেশে অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে বিভিন্ন পণ্যের আমদানি। মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য, খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেলসহ সব পণ্যের আমদানিই এখন বেশ ঊর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে পণ্য আমদানি বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৫২ শতাংশ। একই সময়ে বিভিন্ন পণ্যের এলসি বেড়েছে প্রায় ৪৯ শতাংশ। ফলে আমদানিতে ডলারের চাহিদা বেশ বেড়েছে। কিন্তু ব্যাংকের কাছে ডলার আসার উৎস রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় সাড়ে ১৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের ২ আগস্ট আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮১ পয়সায় বিক্রি হয়, যা বাড়তে বাড়তে চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি ৮৬ টাকা ওঠে। এর পর থেকে প্রায় আড়াই মাস ডলারের দাম এই জায়গাতেই আটকে রেখেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে গতকাল ২০ পয়সা দাম বৃদ্ধি পেয়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় উঠেছে।
আন্তঃব্যাংকের তুলনায় খোলাবাজারে ডলারের দাম আরও চড়া। এই বাজারে প্রতি ডলার কিনতে ক্রেতাকে খরচ করতে হচ্ছে প্রায় ৯৩ টাকা। বর্তমানে আন্তঃব্যাংকের সঙ্গে খোলাবাজারের ডলারের দামের পার্থক্য প্রায় ৬ টাকা। স্বাভাবিক সময়ে এই পার্থক্য আড়াই থেকে ৩ টাকার মধ্যে থাকে। এদিকে, ব্যাংকগুলোয় গতকাল নগদ ডলার বিক্রি হয়েছে ৯১ টাকা থেকে ৯২ টাকার মধ্যে। গতকাল বেসরকারি সাউথবাংলা ব্যাংক নগদ ডলার বিক্রি করেছে ৯১ টাকা ৭৫ পয়সায়। আর সোনালী ব্যাংক বিক্রি করেছে ৯১ টাকায়।
এদিকে আমদানিতে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধির পর থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের ২২ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করা হয়েছে প্রায় ৩৬৫ কোটি ডলার।