নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা:
ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া এখন সোনার হরিণের মতোই। মনে আনন্দ নিয়ে নির্ধারিত তারিখে বিআরটিএ অফিসে এসে দীর্ঘসময় লাইন দাঁড়িয়ে থেকে ফিরতে হচ্ছে নতুন দিন তারিখ নিয়ে। এটি নতুন কিছু নয়, একই ঘটনা ঘটছে বারবার।এমনটাই জানিয়েছেন মামুনুর রশীদ নামের এক গ্রাহক।
সম্প্রতি বিআরটিএ সরোজমিন ঘুরে, বেশ কয়েকজন ভুক্তোভোগীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানাগেছে। লাইসেন্সের জন্য শুধু মামুনুর রশীদ নয়, আরো অনেকে রয়েছে যারা দীর্ঘসময় ধরে অপেক্ষোয় আছেন লাইসেন্সের জন্য।
মামুনুর রশীদ জানান, সাড়ে তিন বছর ধরে ঘুরছেন তিনি। প্রতি তারিখেই লাইসেন্স পাওয়ার আশা নিয়ে আসলেও ফিরতে হচ্ছে নতুন তারিখ নিয়ে।
‘জানুয়ারি ২০১৯ এ ড্রাইভিং লাইসেন্স এর জন্য আবেদন করি। একই বছেরর আগস্ট মাসে লাইসেন্স হাতে পাওয়ার কথা। কিন্তু কি দূর্ভাগ্য! এখনো পায়নি। এই যেন সোনার হরিণ হাতে পাওয়ার মতো অবস্থা।
মামুন রাজধানী বারিধারায় একটি অফিসে কর্মরত। লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালাচ্ছেন গত তিন বছরের বেশি সময়। মাঝে মাঝে পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে।
মামুনের মতো এমন হাজার-হাজার গ্রাহক অন্ধকারে দৌড়াচ্ছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স নামক বস্তুটি হাতে পেতে।
অপর একজন গ্রাহক আব্দুল হাকিম বলেন, গত তিন বছরে তিনিও পেয়েছেন চারটা ডেট। নির্ধারিত তারিখে খুব আশা নিয়ে আসলেও তারিখ পরিবর্তন সীল আর হতাশা ছাড়া কিছুই পাননি তিনি।
চার বছরেরও অধিক সময় পর গাড়ির লাইসেন্স হাতে পেয়ে আনন্দিত সোহাগ। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে আবেদনের পর থেকে চরম ভোগান্তি সহ্য করতে হয়েছে তাকে। অবশেষে লাইসেন্স হাতে পেয়েছে, তাতেই খুশি মনে বাসায় ফিরছেন তিনি।
বিআরটিএ-র সদর দপ্তর ও মিরপুর অফিসের তথ্যে অমিল
হারুনর রশীদকে আজকের নির্ধারিত তারিখ পরিবর্তন করে আগামী ৪ জানুয়ারি ২০২৩ লাইসেন্স দেওয়ার তারিখ দেয়া হয়। সুতরাং তার অপেক্ষা করতে হবে আরও নয় মাস।
অথচ বিআরটিএ-র সদরদপ্তর সূত্রে জানা যায়, আগামী ৬ মাসের মধ্যে পেন্ডিং থাকা সকল ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রিন্ট করে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরী (বিএমটিএফ) এর সাথে চুক্তি হয়েছে।
যেখানে চলতি বছরের অক্টোবরের মধ্যে লাইসেন্স দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেখানে জানুয়ারিতে নতুন তারিখ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর (মিরপুর জোন) সহকারী পরিচালক মামুন বলেন, হাতে কিছু সময় রেখে তাদের তারিখ পরিবর্তন করে দেয়া হচ্ছে। যাতে গ্রাহকরা পুনরায় ভোগান্তির শিকার না হয়।
অথচ এর আগেও চারটি তারিখ পরিবর্তন করেছে বিআরটিএ। যার কারণে নির্ধারিত তারিখে লাইসেন্স পাওয়া নিয়েও বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেন এই গ্রাহক।
নতুন আবেদনে মিলছে লাইসেন্স ৬ মাসে
পুরাতন গ্রাহকদের তুলনায় কিছুটা কম ভোগান্তি থাকলেও নতুন গ্রাহক সেবা নিয়েই অসন্তুষ্ট গ্রাহকেরা। নতুনদের ড্রাইভিং লাইসেন্স হাতে পেতে সময় নিচ্ছে চার থেকে পাঁচ মাস। কারো কারো ক্ষেত্রে আবার তা দাঁড়াচ্ছে ছয় মাস।
সদর দপ্তরের থেকে বিআরটিএ-র রোড সেফটি পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই রাব্বানী বলেন, নতুন গ্রাহকদের এক মাসের মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহ করছি। অন্যদিকে মিরপুর অফিস থেকে আব্দুল আল নোমান বলছেন, গ্রাহকের পরীক্ষা পাশের পর দুই থেকে তিন মাস সময় নিচ্ছি। এর মধ্যে লাইসেন্স সরবরাহ করে থাকি।
ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে খরচ তিনগুণ
এছাড়াও ড্রাইভিং লাইসেন্স এরিয়ায় রয়েছে দালালের ছড়াছড়ি। বিআরটিএ-র আশপাশে কিংবা অফিস এলাকায় দাঁড়াতেই একেরপর এক অফার দিতে থাকে দালালরা।
ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে সরকারি হিসেবের দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণ খরচ হচ্ছে সাধারণ মানুষের।
সরকারি নির্ধারিত দুইটি ক্যাটাগরিতে তৈরি হচ্ছে ড্রাইভিং লাইসেন্স। যেখানে অনলাইনে আবেদনের সময় ১ম ক্যাটাগরিতে ৩৪৫ টাকা জমা দিতে হয় এবং ২য় ক্যাটাগরি জমা দিতে হয় ৫১৮ টাকা যা অনলাইনেই পরিশোধ করতে হয়।
আবেদনের দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে নির্ধারিত সময়ে কেন্দ্রে লিখিত, মৌখিক ও ফিল্ড টেস্ট-এ অংশ গ্রহণ করে পাশ করলে লাইসেন্সের নির্ধারিত ফি পেশাদার ১৬৭৯ টাকা ও অপেশাদার ২৫৪২ টাকা বিআরটিএ’র নির্ধারিত ব্যাংকে জমা দিতে হবে।
অর্থাৎ সবমিলিয়ে সরকারি হিসেবে ড্রাইভিং লাইসেন্স সম্পন্ন করতে প্রয়োজন অপেশাদারদের জন্য ১৬৭৯+৩৪৫=২০২৪ এবং পেশাদারদের প্রয়োজন ২৫৪২+৫১৮=৩০৬০ টাকা।
অন্যদিকে বাস্তবতা ভিন্ন। প্রতিটি লাইসেন্স করতে গ্রাহকদের গুনতে হচ্ছে সময়, ব্যক্তি ও স্থান ভেদে পাঁচ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
সুমন নামের এক গ্রাহক জানান লাইসেন্স বাবদ তার চুক্তি হয়েছে ১০হাজার টাকা। লোকের মাধ্যমে লাইসেন্স বানানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের অদৃশ্য হাত রয়েছে। সাধারণভাবে আমাদের চেয়ে তাদের সময় কম লাগছে। অফিসের সাথে তাদের যোগাযোগ রয়েছে।
বিআরটিএ-র সদরদপ্তর জানাচ্ছে, এবিষয়ে তাদের করণীয় নেই বললে চলে। কারণ হিসেবে বলছেন, এখানে লাইসেন্সের কাজ করা হয় না। লাইসেন্স মূলত ফিল্ডে তৈরী হচ্ছে। এখানে শুধু প্রিন্ট হচ্ছে।
বিআরটিএর মিরপুর অফিসের সহকারী পরিচালক আব্দুল আল মামুন বলছেন, নিয়মিত ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে তদারকি জোড়দার করা হয়েছে। অভিযোগ পেলেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
বিআরটিএ টাইগার আইটি’র সাথে চুক্তি নবায়ন না করে নতুন করে মাদ্রাজ সিকিউরিটিজ প্রিন্টার্সের সাথে করা চুক্তি নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। চুক্তির বিষয়ে ভোক্তা কণ্ঠের প্রতিনিধির সাথে কথা বলতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন বিআরটিএ-র একাধিক কর্মকর্তা।
জানা গেছে, নতুন এই প্রতিষ্ঠানের সাথে পাঁচ বছরের জন্য চুক্তি বদ্ধ হয়েছে বিআরটিএ। প্রতিষ্ঠানটি শুধুমাত্র নতুন আবেদনকারীদের লাইসেন্স সরবরাহ করবে। চুক্তি অনুসারে, মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স পাঁচ বছরে ৪০ লাখ স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহ করবে।