দেশের বাজারে ক্রমাগত বেড়েই চলছে তেল ও চিনির দাম। বিশ্ববাজারের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে দর সমন্বয় করতে গিয়ে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে দাবি করছেন ওইসব পণ্যের মিল মালিকরা। কিন্তু দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে এখন তাদের সবার ‘পোয়াবারো’। অন্যদিকে প্রতি কেজি চিনি ৮৫ টাকা আর তেল প্রতি লিটার ১৫৩ টাকায় কিনে কষ্টে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে যে, এ অবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকবে? সরকার এমন গুরুত্বপূর্ণ ভোগ্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি সামাল দেওয়ার ব্যাপারে কতটা আন্তরিকভাবে কাজ করছে? অন্যদিকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে দর সমন্বয়ের বিষয়টা এ দেশের মিল মালিকরা কতোটা সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে করছেন সে খেয়াল রাখছে কোনো সংস্থা?
জানা গেছে, কয়েক দফা বাড়ানোর পরে আবারও তেল ও চিনির দাম বাড়াতে সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছেন মিল মালিকরা। যেখানে সর্বশেষ সেপ্টেম্বরেও বাড়ানো হয়েছে দুটি পণ্যের দাম, এরপরও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তাদের প্রস্তাব আমলে নিয়েছে, যা পর্যালোচনার জন্য বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এ দফায়ও মিলমালিকরা বিশ্ববাজারে ঊর্ধ্বগতির সময়ে দাম কেজিপ্রতি ৪ থেকে ৬ টাকা দাম বাড়াতে চেয়েছেন।
যদিও আন্তর্জাতিক বাজারের তথ্য বিশ্লেষণ করলে নতুন করে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা যায় না। কারণ টানা বৃদ্ধির পরে এখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে অপরিশোধিত সয়াবিনের দর টনপ্রতি এক হাজার ৩১৪ ডলার, যা এক মাস আগে ছিল এক হাজার ৩৪৫ ডলার। অর্থাৎ প্রতি টনে ৩১ ডলার বা ২.৩০ শতাংশ কমেছে।
অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, গত এক মাসে দেশে ভোজ্যতেলের দাম ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। গত এক বছরে প্রতি কেজি ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত। চিনির দাম বেড়েছে ২৪ শতাংশ।
যদিও ট্যারিফ কমিশনের এ দরের তুলনায় বাজারে পণ্যগুলোর দাম আরও বেশি। সে বিষয় মাথায় নিলে এ পরিসংখ্যানের হার আরও বাড়বে।
সরকার যেহেতু মিল মালিকদের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারছে না। তাদের নির্ধারিত দামও কার্যকর করা যাচ্ছে না। সেজন্য ভ্যাট ট্যাক্সের পরিমাণ কমিয়ে দিলে দাম কমবে।
অর্থাৎ সবমিলে বিশ্ববাজারে যে হারে তেল ও চিনির দাম বাড়ছে, দেশে সমন্বয় হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি। অধিকাংশ সময়ই বিশ্ববাজারের বৃদ্ধিকে অনৈতিক সুবিধা হিসেবে নিচ্ছেন মিল মালিকসহ পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। ওই অজুহাতে রাতারাতি দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।
অন্যদিকে আইনে রয়েছে বলে সরকারকে বারবার দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনা দেওয়া হয়, যা লোকদেখানো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ কোনোবারই ওই প্রস্তাবনা পাসের জন্য দর আটকে থেমে থাকছে না কোম্পানিগুলো। প্রস্তাব পাসের আগেই গোপনে দাম বাড়ানো হয়েছে প্রতিবারই।
এ দফায়ও ব্যতিক্রম হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেষ প্রস্তাবে তেল ও চিনির দাম চার থেকে ৬ টাকা বাড়াতে চেয়েছে কোম্পানিগুলো। কিন্তু বর্তমানে বাজারের নতুন বোতলজাত তেলের গায়ে দাম প্রতি লিটারে ৪ টাকা এরই মধ্যে বেড়েছে। যেখানে আগে প্রতি লিটার তেলের দাম ছিল ১৪৯ টাকা, সেটা হয়েছে ১৫৩ টাকা। চিনির ক্ষেত্রেও দাম বেড়ে হয়েছে ৮২ থেকে ৮৬ টাকা।
পাশাপাশি তারা সামনের দিনগুলোতে দুই পণ্যের দাম বাড়াবে বলে বাজারে প্রতিনিধিদের মাধ্যমে চাউর করছে।
যদিও গত রোববার এবং শেষ সপ্তাহের মঙ্গলবারও এ বিষয়ে ট্যারিফ কমিশনে বৈঠক হয়েছে। কিন্তু দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়নি; অথচ বাজারে তা কার্যকর হয়েছে।
সরকারের দাম মানা হচ্ছে না
এক মাস আগে তেল ও চিনির মিল মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে সরকার তেল-চিনির যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল তাও মানা হচ্ছে না। সরকার দাম বেঁধে দিলেও বাজারে বাড়তি দামেই এ দুই পণ্য বিক্রি হচ্ছে।
সরকার নির্ধারিত দাম কেন মানা হয় না সেটার জন্য খুচরা, পাইকারি আর মিল মালিকরা একে অপরকে দুষছেন। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেশি দামে পাইকারিতে কিনতে হচ্ছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল থেকে বেশি দামে কিনছেন তারা। মিলারদের দাবি, তারা সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করছেন।
গত ৫ সেপ্টেম্বর প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১২৯ টাকা নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম ৭৪ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনি ৭৫ টাকা ঠিক করে দেয় সরকার। কিন্তু বাজারে তেলের দাম এর থেকে লিটারে ২৪ টাকা ও চিনির দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেশি।
সরকার নির্ধারিত দাম কেন মানা হয় না সেটার জন্য খুচরা, পাইকারি আর মিল মালিকরা একে অপরকে দুষছেন। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেশি দামে পাইকারিতে কিনতে হচ্ছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল থেকে বেশি দামে কিনছেন তারা। মিলারদের দাবি, সরকারের নির্ধারিত দামে তারা বিক্রি করছেন। এ যেন হ-য-ব-র-ল।
মঙ্গলবার মৌলভীবাজারের পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী সোনালী ট্রেডার্সের ম্যানেজার অরুণ কুণ্ড বলেন, মিলগেট থেকে প্রতি কেজি চিনি কিনছি ৭৬ টাকা ৬০ পয়সায়। ২০ পয়সা লাভ করে বিক্রি করি। তাহলে কীভাবে সরকারের দামে বিক্রি করবো। দাম বাড়ানোর জন্য দায়ী মিলগুলো।
এদিকে মিলগেটে বাড়তি দামের বিষয় অস্বীকার করে সিটি গ্রুপের পরিচালক বলেন, আমরা বাড়তি দামে বিক্রি করছি না। কী দামে প্রতিদিন তেল ও চিনি বিক্রি হচ্ছে সেটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্যারিফ কমিশন ও জাতীয় ভোক্তা অধিকারে তথ্য দেওয়া হচ্ছে।
গা বাচাতে দরহীন ডিও দিচ্ছে মিল
প্রকৃতপক্ষে এ দুই পণ্যের দাম সরকার নির্ধারিত দামের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় চলছে একধরনের লুকোচুরি খেলা। কয়েকদিন ধরে মিল মালিকরা তেল-চিনির ডিওতে (ডেলিভারি অর্ডারে) পণ্যের দাম উল্লেখ করছেন না। অর্থাৎ তারা কি দামে তেল-চিনি মিলগেটে বিক্রি করছেন, তার কোনো প্রমাণ রাখা হচ্ছে না!
এমন পরিস্থিতিতে গত সোমবার ট্যারিফ কমিশনের মিটিংয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরা অভিযোগ দিয়েছেন মিল মালিকদের এ অনৈতিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা বলেন, দাম বাড়ানোর পর থেকে মিল মালিকরা ডিওতে দাম উল্লেখ করছেন না। যাতে তারা সিন্ডিকেটের দায়ে দায়ী না হয়। তাতে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ফাঁসবেন। আমরা ট্যারিফ কমিশনে এ নিয়ে অভিযোগ দিয়েছি।
সমাধান নেই!
তিনি বলেন, আমরা তারপরও বাজারের তেল-চিনির সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করে দিয়েছি। এরপরও বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে। আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রেখেছি। মিল মালিকদের সঙ্গে বসেছি। তারা একটা রিপোর্ট দিয়েছে। সেটা ট্যারিফ কমিশন পর্যালোচনা করবে। দেখা যাক কি করা যায়।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, আবারও এক দফায় দাম বাড়ানোর পক্ষে কাজ চলছে। ট্যারিফ কমিশন মিল মালিকদের সুবিধা দিচ্ছে। তাদের বিষয়ে কঠোর নয় সংস্থাটি।
এর আগে বাণিজ্যমন্ত্রীও বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশে কমে আসবে বলে জানিয়েছিলেন।
শুল্ক কমানো দরকার
অপরিশোধিত তেল-চিনি আমদানিতে প্রতি মেট্রিক টনে স্পেসিফিক ডিউটি ৩ হাজার টাকা, আরডি ৩০ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ ও এটি ৪ শতাংশ আরোপিত রয়েছে, যা দীর্ঘদিন ধরে কমানোর কথা বলে আসছেন ব্যবসায়ীরা। সেগুলোর শুল্ক কমানোর বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠিও দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু কার্যকর হয়নি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভোজ্যতেল ও চিনির মূল্যবৃদ্ধির পেছনে এসব ভ্যাট-ট্যাক্স অন্যতম একটি কারণ। এখন সরকারকে দাম কমাতে এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ মুহূর্তে এই দুটি পণ্যের দাম কমানোর ক্ষেত্রে এটি ভালো বিকল্প হতে পারে।
এ বিষয়ে গোলাম মাওলা বলেন, সরকার যেহেতু মিল মালিকদের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারছে না। তাদের নির্ধারিত দামও কার্যকর করা যাচ্ছে না। সেজন্য ভ্যাট ট্যাক্সের পরিমাণ কমিয়ে দিলে দাম কমবে। অথবা সেটা না হলে উৎপাদন পর্যায়ে লিটারপ্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণের ভর্তুকি দিয়ে দাম কমাতে হবে।