ঢাকা, ১৫ জুন শনিবারঃ গত বৃহস্পতিবার ১৩ মে, জাতীয় সংসদে ২০১৯ – ২০ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপিত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম. মুস্তফা কামাল ৪০ মিনিট উপস্থাপনের পর অসুস্থতার কারণে বাকি অংশ উপস্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য পাঁচ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করা হয়েছে। বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভ্যাট থেকে আদায় করা হবে ১ লাখ ১৭ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা, যা মূলত ভোক্তাকেই দিতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্র গুনতে হবে অতিরিক্ত টাকা,ফলে বাড়বে জীবন যাত্রার ব্যয়।
বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতার করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকা অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে। গত ৪ বছর ধরে ব্যক্তি করদাতার করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকায় আটকে আছে, এ সময় মূল্যস্ফীতির গড় ছিল ৫ শতাংশ। করমুক্ত সীমা আড়াই লাখ টাকায় স্থির রাখার উদ্দেশ্যই হচ্ছে নতুন করদাতার সংখ্যা বাড়ানো। কিন্তু মধ্যবিত্তের বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ব্যয়, খাদ্যসামগ্রী, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দামসহ অন্য খরচ বাড়লেও আগের নিয়মেই এলাকাভেদে সর্বনিম্ন ৩-৫ হাজার টাকা বার্ষিক কর দিতে হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে যেসব বাড়ির মালিক রিটার্ন জমা দেন না, তাদের খুঁজে বের করে করের আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে আয়কর অফিস সম্প্রসারণ করা হবে। আগামী বছর ৮০ লাখ নতুন করদাতা তৈরির বিষয়ে বাজেটে রূপরেখা দেবেন বলে বাজেট ঘোষণাকালে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
আইনগত সংস্কারের অংশ হিসেবে ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে এনবিআর। এ আইন বাস্তবায়ন হলে কিছু পণ্যের দাম বাড়তে পারে। নতুন আইনে ট্যারিফ ভ্যালু প্রথা বাতিল হবে। বর্তমানে উৎপাদন পর্যায়ে ৮৫টি পণ্যে ট্যারিফ মূল্য বহাল আছে। গুঁড়া দুধ, গুড়া মসলা, বিস্কুট, কেক, রুটি, আচার, টমেটো সস, ফলের জুস, এলপি গ্যাস, নিউজপ্রিন্ট সহ সব ধরনের কাগজ, এলইডি লাইট, টিউব লাইট, চশমা, সানগ্লাস, নির্মাণসামগ্রী যেমন রড, ইট রয়েছে। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে এসব পণ্যের ট্যারিফ মূল্য থাকবে না। ট্যারিফ মূল্য না থাকলেও প্রকৃত দামের ওপর ভ্যাট দিতে হবে, ফলে পণ্যের দাম কিছুটা বাড়তে পারে। অবশ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সংবেদনশীল পণ্যের তালিকা করেছে এনবিআর। রড, ওষুধ, ভোজ্যতেল, পেট্রোলিয়াম পণ্যের মতো ৮-১০টি পণ্যের জন্য ২ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হবে।
এবার সয়াবিন তেল, পামওয়েল, প্লাস্টিক সামগ্রীসহ বেশ কিছু পণ্যে নতুন করে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, যা কম আয়ের লোকদের চাপে ফেলবে।সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর ৫ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। নতুন ভ্যাট আইনের চাপটুকুও মধ্যবিত্তের ওপরেই বেশী পরবে।
এছাড়া, উবার ও পাঠাওয়ের মতো রাইড শেয়ারিংয়ে খরচ বাড়ছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেটে রাইড শেয়ারিংয়ের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর আগে এ হার ছিল ৫ শতাংশ।
বাজেটে ঘাটতি থাকছে জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ। এ ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। শুন্যতা পূরণে, বৈদেশিক ঋণ ধরা হয়েছে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া হবে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্রসহ ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে নেওয়া হবে ৩০ হাজার কোটি টাকা।
যেহেতু, বাংলাদেশের কর কাঠামো পুরোটাই মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) উপর দাঁড়িয়ে আছে। অর্থনীতির আয়ের যোগান আসছে পরোক্ষ কর থেকে। অথচ, সুযোগ আছে প্রত্যক্ষ করের আওতা বৃদ্ধির। প্রস্তাবিত বাজেটে এবারও কর্পোরেট করের ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন আসেনি। জনপ্রশাসন খাতে এবার সবচেয়ে বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা দিতে গিয়ে রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেটের ১৮ শতাংশের বেশি সরকারকে খরচ করতে হবে।
সব ধরনের পরিবহন রেজিস্ট্রেশন, রুট পারমিট নবায়ন, ফিটনেস সনদ, মালিকানা সনদ নিতে এবং নবায়ন করতে বিআরটিএ নির্ধারিত সেবামূল্যের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের কারণে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ফি বাড়বে। মোবাইল ফোন সিম কার্ড, রিম কার্ডের ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে মোবাইলে কথা বলার খরচ বাড়বে। আইসক্রিম এর ওপর ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। আমদানি করা গুঁড়া দুধের ওপর আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে সব ধরনের আমদানি করা গুঁড়া দুধের দাম বাড়বে। উৎপাদন পর্যায়ে ট্যারিফ মূল্যের পরিবর্তে ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করায় এলপি গ্যাস, গুঁড়া মসলা, টমেটো কেচাপ, চাটনি, ফলের জুস, টয়লেট টিস্যু, টিউবলাইট, চশমার ফ্রেমের দাম বেড়ে যাবে। পোশাকের মূল্যের ওপর আড়াই শতাংশ ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাবের ফলে জামা-কাপড়ের দাম বাড়তে পারে। পোশাক কেনার পাশাপাশি তৈরি করতেও খরচ বাড়তে পারে। পোশাক তৈরির ওপর ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে এখন থেকে।
সামগ্রিকভাবে, সাধারণ মানুষ তথা নির্দিষ্ট আয়ের ভোক্তাদের ওপর বাজেট পরবর্তী প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক হবে বলেই মনে করছেন সবাই।