।। ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক ।।
পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে ওঠা প্লাস্টিক বর্জ্যকে জ্বালানি তেলে রূপান্তরের কৌশল বিশ্বজুড়ে আশার আলো দেখাচ্ছে। দূষণ প্রতিরোধ ও ক্রমবর্ধমান তরল জ্বালানির চাহিদা মেটাতে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, ভারতে প্ল্যান্ট স্থাপনের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে (প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে) তৈরি হচ্ছে ডিজেল ও কেরোসিন। বাংলাদেশেও প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি তেল তৈরির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। খবর ভোরের কাগজ।
প্রতি বছর দেশে যে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে তা থেকে উৎপাদিত জ্বালানি তেল গৃহস্থালি ছাড়াও ব্যবহার করা যাবে কারখানায়। পাশাপাশি পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে বাণিজ্যিকভাবে উন্নতমানের জ্বালানি তেল তৈরির ব্যাপক সম্ভাবনার কথা বলছেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়াস্ট টেকনোলজিস এলএলসির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী ড. মইনউদ্দিন সরকার ও সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী পরিচালক ড. আনজুমান সেলী।
‘ন্যাচারাল স্টেট রিসার্চ ইনকরপোরেশন’ (এনএসআর) কোম্পানির মাধ্যমে নিউইয়র্কে ২০১০ সাল থেকে এই বিজ্ঞানি দম্পতি পরিবেশবান্ধব ও সালফারবিহীন উন্নতমানের এনএসআর ফুয়েল (ডিজেল, কেরোসিন, এলপিজি) উৎপাদন করে আসছেন। বর্তমানে ২০ থেকে ৩০ কোটি ব্যারেল তেল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে তারা কাজ করছেন। বিশ্বের ১৯৩টি দেশে বাণিজ্যিকভিত্তিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশেও প্রকল্প স্থাপনে মাঠ যাচাইয়ের কাজ করছেন। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগেরও চেষ্টা করছেন।
ড. মইন বলেন, বিশ্বসভ্যতার হুমকি হিসেবে চিহ্নিত প্লাস্টিক বর্জ্যরে ভয়াবহতা কমাতে ও মানবিক দায়বদ্ধতা থেকেই এ কাজ শুরু করেছি। এশিয়ার দেশগুলোতে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ঢাকায় প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা করেছি। এর মাধ্যমে এক টন বর্জ্য থেকে ১৩০০ লিটার তরল জ্বালানি, ১০ সিলিন্ডার এলপিজি ও ২৩ লিটার জেট ফুয়েল উৎপাদন করা যাবে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতা চেয়ে ড. মইন বলেন, প্ল্যান্ট স্থাপন করলে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ, বহন, ধোয়ার কাজে কর্মসংস্থান হবে। সেই সঙ্গে পরিবেশ দূষণ রোধের মাধ্যমে গ্রিন টেকনোলজির প্রসারসহ জ্বালানি খাতও সমৃদ্ধ হবে।
এদিকে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইউএনইপির (ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম) গেল পরিবেশ দিবসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এর কিছু অংশ নদ-নদী দিয়ে চলে যাচ্ছে সাগরে আর বৃহৎ অংশই জমে উঠছে জলে-স্থলে। যা বড় শহরগুলোর জলাবদ্ধতাকে ভয়াবহ করে তুলছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার (ইএসডিও) এক জরিপে দেখানো হয়েছে, বর্তমানে দেশের জলে-স্থলে জমে আছে ৬৫ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য। এর সঙ্গে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে তিন হাজার টন করে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, প্লাস্টিক বর্জ্যের ভয়াবহতা রোধে উৎপাদন হ্রাস ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে জোর দেয়া হলেও তরল জ্বালানি তৈরির উদ্যোগ নেই। ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিডিএম (পরিচ্ছন্ন উন্নয়ন পদ্ধতি) প্রকল্পের দুটি পর্যায়ে ২০১০ সাল থেকে দেশের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর জৈব বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে এ প্রকল্পে সীমিত পরিমাণে জৈব সার ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না।
সূত্র মতে, দেশে প্লাস্টিক বর্জ্যকে জ্বালানি তেলে রূপান্তরের কৌশল উদ্ভাবন নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে গবেষণা চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের আওতায় পলিথিন থেকে জ্বালানি তেল তৈরির প্রকল্পে অর্থ সহায়তাও দেয়া হয়েছে। পরিত্যক্ত টায়ার থেকেও তৈরি হচ্ছে জ্বালানি।
তবে প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে ডিজেল বা কেরোসিন উৎপাদনের গবেষণায় একমাত্র সরকারি অর্থ সহায়তা পেয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘সিলেকটিভ ক্যাটালিক ডিগ্রিডেশন অব ওয়েস্ট প্লাস্টিকস টু গ্যাসোলিন এন্ড ডিজেল ফুয়েল’ প্রকল্পের মাধ্যমে করা তার গবেষণার ফলাফল ২০১৬ সালের ৫ এপ্রিল জমা দেন জবি উপাচার্য ড. মীজানুর রহমানের কাছে।
গবেষণায় এক কেজি প্লাস্টিক থেকে সালফারমুক্ত অর্ধ লিটার জ্বালানি তেল তৈরির কথা বলেন। যদিও উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগে এক লিটারের বেশি তেল পাওয়ার সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ করা হয়। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক এ গবেষণাকে স্বাগত জানিয়ে তখন বাস্তবায়নে সহায়তার আশ্বাসও দিয়েছিলেন।
ড. মাহমুদুর রহমান ঢাকার কেরানীগঞ্জে জবির নিজস্ব জমিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের (ইপিআরসি) কাছে চলতি বছরে অর্থ সহায়তা চান। তবে তার গবেষণা অবাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে মতামত দেয় ইপিআরসির মডারেটর কমিটি ও রিভিউ কমিটির বিশেষজ্ঞরা। এরপর আর আলোর মুখ দেখেনি প্রকল্পটি।
ইপিআরসির নিয়ম অনুযায়ী বাস্তবায়নযোগ্য এবং লাভজনক হলেই কেবল উদ্যোক্তার মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। এ ব্যাপারে ইপিআরসির কর্মকর্তারা জানান, গবেষণাটির বিষয়ে মডারেটর কমিটি ও এক্সপার্টদের কোনো সাড়া না পাওয়ায় ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, গবেষণার প্রায়োগিক ক্ষেত্রের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। এখন কাটিয়ে ওঠেছি। প্লাস্টিক বর্জ্যকে জ্বালানি তেলে রূপান্তর এখন জ্বালানি খাতের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় শিল্প।
ডহসাব মতে, প্লাস্টিক বর্জ্য প্ল্যান্টে শতভাগ উৎপাদন সম্ভব হলে দেশে প্রতিদিনের লক্ষাধিক টন জ্বালানি তেলের চাহিদার তিন শতাংশ পূরণ সম্ভব হবে। এ ছাড়া জলে-স্থলে জমে থাকা বর্জ্যরে অর্ধেকও কাজে লাগানো গেলে এক মাসেরও বেশি সময়ের জ্বালানি তেলের জোগান পাওয়া যাবে।
সরকারের জ্বালানি খাতের গবেষণা সহায়ক সংস্থা ইপিআরসির চেয়ারম্যান (সচিব) শাহিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, প্লাস্টিক বর্জ্য আমাদের পরিবেশের জন্য বড় হুমকি। একে জ্বালানি তেলে রূপান্তর করা গেলে এ খাতে যেমন সম্ভাবনা দেখা দেবে, তেমনি পরিবেশ দূষণ রোধে ইতিবাচক পদক্ষেপ হবে।
তবে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান পরিত্যক্ত টায়ার থেকে জ্বালানি তেল তৈরিতে পরিবেশের মারাত্মক দূষণের বিষয় উল্লেখ করে ভোরের কাগজকে বলেন, পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্যকে তেলে রূপান্তর করা গেলে পরিবেশ দূষণমাত্রা অনেক কমে আসবে। এ খাতে সরকারের সহায়তা করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।