সারাদেশে এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে ভেজাল পণ্যের দৌরাত্ম্য। এমন কোনো খাবারের জিনিস নেই, যেখানে ভেজাল মেশানো হয় না। এ নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে যেমন সচেতনতা নেই, তেমনি নেই যথাযথ আইনের প্রয়োগ।
খাবারে কী পরিমাণ ভেজাল আছে, তা পরীক্ষার জন্য জাতীয় জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি ইনস্টিটিউট সারাদেশ থেকে ৪৩টি ভোগ্যপণ্যের মোট ৫ হাজার ৩৯৬টি নমুনা সংগ্রহ করে। তাতে সবপণ্যেই কোনো না কোনো ভেজাল পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৩টি পণ্যে ভেজালের হার ছিল প্রায় শতভাগ।
শুধু ভোগ্যপণ্য নয়; শিশুখাদ্য, প্রসাধনসামগ্রী, এমনকি জীবনরক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল। চালে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত ক্যাডমিয়াম। আটায় চক পাউডার। পোলট্রি মাংস ও ডিমে সহনীয় মাত্রার ৩-৪ গুণ বেশি ক্রোমিয়াম। গরু মোটাতাজা করতে খাওয়ানো হয় স্টেরয়েড ট্যাবলেট। মাছ, মাংস, দুধ ও ফলে মেশানো হচ্ছে মরণঘাতী ফরমালিন। ছানার পানির সঙ্গে খাওয়ার সোডা, বিষাক্ত পারঅক্সাইড ও কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি করা হয় কৃত্রিম দুধ। সয়াবিন তেলে মেশানো হয় পাম অয়েল। মরিচের গুঁড়া, সাবান তৈরির ক্যাস্টার অয়েল ও কেমিক্যাল ঝাঁজ দিয়ে তৈরি হয় সরিষার তেল। মিষ্টিকুমড়া-গাজর পিষে, রঙ, ফ্লেভার ও প্রিজারভেটিভ মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে গাওয়া ঘি। মরিচের গুঁড়ার সঙ্গে ইটের গুঁড়া, ধনের সঙ্গে মেশানো হয় কাঠের গুঁড়া আর ধানের ভুসি। হলুদের রঙ উজ্জ্বল করতে দেওয়া হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল কিংবা কাপড়ের রঙ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অস্ট্রেলিয়ার ওলিংগং বিশ্ববিদ্যালয় যৌথ গবেষণা জরিপ করে দেখেছে, রাজধানীর ৯৬ শতাংশ মিষ্টি, ২৪ শতাংশ বিস্কুট, ৫৪ শতাংশ পাউরুটি, ৫৯ শতাংশ আইসক্রিম ভেজাল বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে নমুনা পরীক্ষা করে প্রায় ৫০ শতাংশ খাদ্যপণ্যে স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান পেয়েছে জাতীয় জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি ইনস্টিটিউট।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্য মতে, ঢাকায় বিক্রি হওয়া আমের ৯৪ শতাংশ এবং লিচু ও জামের শতভাগেই ফরমালিন। ক্ষতিকর এসব বিষ ক্রমাগত খেতে খেতে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে। প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে হয়তো কর্মক্ষম লোক খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়বে।
বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে অসুস্থ হয়। এর মধ্যে মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার। দূষিত খাদ্য গ্রহণজনিত কারণে ৫ বছরের কম বয়সের আক্রান্ত হওয়া ৪৩ শতাংশ শিশুর মধ্যে মৃত্যুবরণ করে সোয় লাখ।
পরিবেশ বাঁচাও অন্দোলনের (পবা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ভেজাল খাদ্যগ্রহণের কারণে প্রতি বছর দেশে ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে, ২ লাখ কিডনি রোগে আর দেড় লাখ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এমনকি হেপাটাইটিস, লিভার ও ফুসফুস সংক্রমিত রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়েরা ১৫ লাখ বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মদান করেন বছরে।