ঢাকা, ৪ মার্চ বুধবারঃ গতকাল মঙ্গলবার (৩ মার্চ) রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক সংবাদ সম্মেলনে ক্যাবের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অভিযোগ অনুসন্ধান ও গবেষণা কমিশনের ফলাফল তুলে ধরতে গিয়ে,‘কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)’ অনুসন্ধান কমিশন জানিয়েছে “বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে প্রকৃতপক্ষে ৫ লাখ ৪৮ হাজার টন কয়লা চুরি গেছে, যা সরকারি তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি।”
কমিশনের প্রধান সৈয়দ আবুল মকসুদ এই প্রতিবেদন পড়ে শোনান। অন্যদিকে, ক্যাব উপদেষ্টা অধ্যাপক এম. শামসুল আলম, কমিশনের সদস্য অধ্যাপক বদরুল ইমাম, অধ্যাপক এমএম আকাশ, অধ্যাপক সুশান্ত কুমার দাস ও সদস্য সচিব স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
কি ছিল সেই প্রতিবেদন? সেই উত্তর ভোক্তাকণ্ঠের পাঠকদের দেবার জন্য, ‘ক্যাব’ গঠিত তদন্ত কমিশন প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনটি হুবহু প্রকাশ করা হলঃ
তদন্তে বিবেচ্য বিষয়ঃ
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অভিযোগ অনুসন্ধান ও গবেষণা কমিশন বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কয়লা চুরির অভিযোগ স্ব-প্রণোদিত হয়ে তদন্ত করে। তদন্তে দেখা যায়, ‘ইয়ার্ডে কয়লা নেই। অথচ কেউই তা দেখেনি এবং জানেও না যে, ১.৪৪ লক্ষ মেট্রিক টন কয়লার হিসাব নেই। এ কয়লা প্রথমে মজুদ দেখানো হয়। পরে চুরি অভিহিত করে ১৯ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলা তদন্তের দায়িত্ব দুদক গ্রহণ করে। সে তদন্ত প্রতিবেদন মতে ২১.৭.২০১৯ তারিখে ১.৪৪ লক্ষ মেট্রিক টন কয়লা আত্মসাতের অভিযোগে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানী লিঃ (বিসিএমসিএল)-এর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে সর্বমোট ২৩ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দাখিল করা হয়। অথচ বিসিএমসিএল-এর ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে হিসাবে না থাকা কয়লা চুরি নয়, সিস্টেম লস বলে অভিহিত করা হয়। অর্থাৎ মামলার বাদী বিসিএমসিএল নিজেই কয়লা চুরির অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্তদের পক্ষ নেয় এবং মামলাটিকে প্রহসনে পরিণত করে, যা অন্যায় এবং সামঞ্জস্যহীন।
বিদ্যুৎকেন্দ্রেব জন্য কয়লা মজুদ না রাখার অভিযোগ তদন্ত কমিটির ২৫.০৭.২০১৮ তারিখের প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় স্বার্থে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বিসিএমসিএল কর্তৃক কয়লা মজুদ রাখা জরুরী ছিল। কিন্তু তা গুরুত্ব পায়নি। খোলা বাজারে কয়লা বিক্রি অধিক গুরুত্ব পায়। কয়লার মজুদ কখনই পরিমাপ করা হয়নি। ফলে এই সুযোগে কয়লা পাচার বা জালিয়াতি হতে পারে, এমন আশংকা থাকা সত্তেও তা খতিয়ে দেখা হয়নি। বরং কয়লা ঘাটতিকে সিস্টেম লস গণ্য করে বিসিএিমসিএল-এর পরিচালনা বোর্ড, পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সম্মিলিতভাবে কয়লা চুরির অভিযোগ নিস্পত্তির উদ্যোগ নেয়। বড়পুকুরিয়া খনির কয়লা সরবরাহে সিস্টেম লস নির্ধারণ কমিটির ২০.১১.২০১৮ তারিখের প্রতিবেদনে সিস্টেম লস ১-৩% প্রস্তাব করা হয়। সে-প্রস্তাব এখন পেট্রোবাংলার সুপারিশসহ জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগের বিবেচনাধীন। কমিশনের বিবেচনায় ওই উদ্যোগ অসংগতিপূর্ণ।
তদন্তে উদ্ঘাটিত অসংগতিসমূহঃ
(১) কয়লা না থাকা সত্ত্বেও কোল-ইয়ার্ডে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহ করার মত পর্যাপ্ত মজুদ কয়লা আছে, এমন তথ্য সংশ্লিষ্ট মহলকে বারংবার অবহিত করে বিভ্রন্তি সৃষ্টি করা হয় এবং নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে খোলা বাজারে কয়লা বিক্রি অব্যাহত রাখা হয়। ফলে কয়লার অভাবে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয় এবং সারা উত্তরবঙ্গ বিদ্যুৎ সংকটে পড়ে,
(২) বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা সংকট মোকাবেলায় কয়লা সরবরাহ ও মজুদ বৃদ্ধি না করে খোলা বাজারে কয়লা বিক্রি বৃদ্ধি করা হয়,
(৩) তিন শত টন কয়লা আত্মসাতের অভিযোগ দুদকের তদন্তে প্রমানিত হওয়া সত্তে¡ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আনীত মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়,
(৪) শর্তে বর্ণিত মানের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা হয়নি। সরবরাহকৃত কয়লায় অবাঞ্চিত দ্রব্যাদি সরবরাহ করা হয়, নির্ধারিত মাত্রা অপেক্ষা কয়লায় অধিক ময়েশ্চার সম্পৃক্ত করা হয় এবং তা বিলে সমন্বয় না করে বেশী বিল আদায় করা হয়,
(৫) কেমিস্টের সব পদ শূন্য রেখে কয়লায় সম্পৃক্ত ময়েশ্চার পরিমাপে কারচুপি করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়,
(৬) কয়লা ইনভেন্টরী বা জমা-খরচের হিসাব না রেখে কয়লা চুরির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়,
(৭) একাধিক কমিটি গঠন করা হলেও সিস্টেম লস নির্ণয় বা নির্ধারণ পদ্ধতি তৈরী করা হয়নি। অথচ এই অজুহাতে কয়লার ফিজিক্যাল স্টক ভেরিফিকেশন এবং সিস্টেম লস হিসাবভূক্ত না করে কয়লা চুরির সুযোগ রাখা হয়,
(৮) বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যসব ভোক্তাকে দেয়া কয়লার ওজন পরিমাপের সাথে কয়লায় সম্পৃক্ত ময়েশ্চার পরিমাপ না করে অনধিক ১০% ময়েশ্চারে কয়লা সরবরাহ করার পরিবর্তে গড়ে ১৫% এরও অধিক ময়েশ্চারে কয়লা সরবরাহ করা হয়। ফলে ভোক্তা মাপে কয়লা কম পায়,
(৯) চুরি/আত্মসাতের সুযোগ রেখে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে কয়লা বিক্রির নীতিমালা তৈরী করায় ঢালাওভাবে কয়লা খোলা বাজারে বিক্রি অব্যাহত থাকে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন চরম কয়লা সংকটে পড়ে,
(১০) পানি নিষ্কাশন ড্রেনেজ সিস্টেমের সাথে গুড়া কয়লা আহরণের জন্য সেটেলিং পন্ড তৈরী না করে কয়লা ব্যবসায়ীদের জন্য এই কয়লা আহরণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়,
(১১) এখতিয়ারবিহীন সুপারিশের ভিত্তিতে ইস্যুকৃত ডিও (ডেলিভারি অর্ডার)-এর কয়লায় খনি এলাকায় কয়লার কালোবাজার সৃষ্টি করা হয়,
(১২) বিসিএমসিএল-এর প্রাপ্ত কয়লায় সম্পৃক্ত অগ্রহণযোগ্য ময়েশ্চার কয়লার বিলে সমন্বয় করে বিল দেয়া হলেও তা একদিকে যেমন হিসাবভূক্ত করা হয়না, অন্যদিকে তেমন বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ভোক্তা পর্যায়ে কয়লার বিলে অগ্রহণযোগ্য ময়েশ্চার সমন্বয় না করে বাড়তি বিল আদায় করা হয়, এই উভয় প্রক্রিয়ায় ভোক্তা প্রতারিত হয়,
(১৩) লিয়াঁজো অফিসের নামে ঢাকায় মাত্রাতিরিক্ত জনবল ও গাড়ী ব্যবহার করে সরকারি অর্থ অপচয় ও তসরূপ করা হয়,
(১৪) পেট্রোবাংলার সার্ভিস চার্জ তার রাজস্ব চাহিদার ভিত্তিতে নয়, ইচ্ছামাফিক পেট্রোবাংলা নিজেই নির্ধারণ করে। তাতেও অযৌক্তিক ব্যয়বৃদ্ধি পায়,
(১৫) বিসিএমসিএল কয়লা খনি কোম্পানী নয়, মূলতঃ কয়লা বিপনন কোম্পানী। কোম্পানীর কর্মকর্তা-কর্মচারী দ্বারা কয়লা উৎপাদন নিশ্চিত করা ব্যতিত খনি ভাতা, ভূ-গর্ভস্থ ভাতা ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি ভাতা দেয়া হয়। তাতেও অযৌক্তিক ব্যয়বৃদ্ধি পায় এবং তাঁরা অনুপার্জিত আয় ভোগের সুযোগ পান,
(১৬) সরকারি কর্মকর্তা হিসাবে পদাধিকার বলে যাঁরা বিসিএমসিএল-এর শেয়ারহোল্ডার এবং পরিচালনা বোর্ড সদস্য, তাঁদেরকে বিসিএমসিএল-এর অর্থ নানাভাবে প্রদান করে অযৌক্তিক ব্যয়বৃদ্ধি করা হয় এবং তাঁরাও অনুপার্জিত আয় ভোগের সুযোগ পান,
(১৭) দক্ষ জনবল তৈরী ও কয়লা উৎপাদনের লক্ষ্যে ১৯৯৪ সাল থেকে বিসিএমসিএল বড়পুকুরিয়া খনি চালাচ্ছে। এ দীর্ঘ সময়ে কয়লা উত্তোলনসহ খনি ম্যানেজমেন্ট, মেইনটেন্যান্স এবং প্রভিসনিং সার্ভিসেসে কোন অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সক্ষমতা বিসিএমসিএল অর্জন করেনি, খনন কাজে তদারকি করতেও শেখেনি। বরং কয়লা উৎপাদনে নয় মূলতঃ বিপননে নিজের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখে অযৌক্তিক ব্যয়বৃদ্ধি করে এবং প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে অপচয় করে,
(১৮) খনি পরিচালনা ব্যয়ে সব মিলিয়ে প্রায় ৭০টি খাত/উপখাত রয়েছে। এ-সব খাত বা উপখাতে ব্যয় ও ব্যয়বৃদ্ধির ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা নিশ্চিত নয়। বরং তা অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি অব্যাহত রেখে অযৌক্তিক ব্যয়বৃদ্ধি করায় ভোক্তা স্বার্থ ও অধিকার খর্ব হয়,
(১৯) স্ব-অর্থায়নে হলেও বড়পুকুরিয়া খনি এলাকায় ভূ-গর্ভে ব্যাক ফিলিং করে ভূমি অবনমন প্রতিরোধ করা জরুরি ছিল, কিন্তু তা করা হয়নি, ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণও পায়নি,
(২০) যেহেতু বর্তমানে একই ওয়িং স্কেলে পরিমাপ করে একই ওজনে ও এক মাত্রায় ময়েশ্চার সম্পৃক্ত (৫.১%) কয়লা বিসিএমসিএল ও বিদ্যুৎকেন্দ্র উভয়ই গ্রহণ করে, সেহেতু বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃক এ-কয়লা কন্সোর্টিয়ামের নিকট থেকে সরাসরি গ্রহণের শামিল। ফলে কয়লা সরবরাহ ব্যয়বিহীন ও সিস্টেমলসহীন। অথচ কন্সোর্টিয়ামের নিকট থেকে যে মূল্যহারে বিসিএমসিএল যে-কয়লা ক্রয় করে, সেই মূল্যহার অপেক্ষা ৪৯ ডলার বেশী মূল্যহারে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিকট ওই একই কয়লা বিসিএমসিএল বিক্রি করে,
(২১) বোর্ড সিদ্ধান্ত ও তাগাদা থাকা সত্তে¡ও সিএসআর তহবিলের জন্য নীতিমালা প্রনয়ণ করা হয়নি। নীতিমালা ছাড়াই এ-তহবিলের অর্থ ব্যক্তি বিশেষের ইচ্ছাধীনে বিলি-বন্টন করা হয়, যা অপচয়/তসরূপের শামিল,
(২২) ডাবলিউপিএফ-এর অর্থ কর পরবর্তি মুনাফার অংশ হলেও হিসাবে খরচের অংশ দেখানো হয়। শ্রমিকের হক হলেও এ-তহবিলের অর্থ শ্রমিক পায়না। কেবলমাত্র বিসিএমসিএল-এর স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পান,
(২৩) ডাবলিউপিএফ-এর বন্টনকৃত অর্থ থেকে গৃহীত চাঁদা নানা অন্যায় ও অপরাধমূলক কার্যক্রমে ব্যয় করা হয় এবং বিসিএমসিএল-এ সুশাসন সংকট বৃদ্ধি পায়,
(২৪) বিসিএমসিএল-এর কর পরবর্তি মুনাফা ৪০% এবং ডাবিøউপিএফ থেকে জনপ্রতি ৯ বছরে লভ্যাংশ পায় ৮৯ লক্ষ টাকা,
(২৫) কয়লার ক্রয়-বিক্রয় মূল্যহার বাজার প্রতিযোগিতায় নয় সরকারের নির্বাহী কর্তৃত্বে নির্ধারিত হয়,
(২৬) উৎপাদনযন্ত্রের উৎপাদনক্ষমতার অধিক এবং লক্ষ্যমাত্রা অপেক্ষা বেশী কয়লা উৎপাদন সম্পর্কিত অভিযোগ নিষ্পত্তিতে কারিগরি বিবেচনা উপেক্ষিত। ফলে বাড়তি কয়লার মূল্য পরিশোধে আর্থিক অনিয়ম হয় এবং সরকার আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়, এবং
(২৭) ন্যায্য দামে, মাপে ও মানে কয়লা পাওয়া ভোক্তার অধিকার হলেও কয়লার ন্যায্য ক্রয়-বিক্রয় মূল্য এবং কয়লায় সম্পৃক্ত ময়েশ্চারের সঠিক মাত্রা নিশ্চিত না করে ভোক্তাকে অধিকার বঞ্চিত করা হয়।
কমিশনের অভিমত ও সুপারিশঃ
তদন্তে বিসিএমসিএল (বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোঃ লিঃ)-এর কার্যক্রমে যে-সব অসংগতি উদ্ঘাাটিত হয়েছে, সে-সব কমিশনের বিবেচনায় দেশের প্রচলিত আইনে বিচারযোগ্য অপরাধ। বড়পুকুরিয়া খনির সম্পদ রক্ষা ও ভোক্তা অধিকার সুরক্ষায় কেবলমাত্র সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারী নয়, পরিচালনা বোর্ড, শেয়ার হোল্ডারগণ, পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ব্যর্থ। দুদকের অভিযোগপত্রে বর্ণিত অভিযোগ মতে কয়লা সম্পদ আত্মসাতের অভিযোগে বিসিএমসিএল-এর ৭জন এমডিসহ ২৩ জন কর্মকর্তা অভিযুক্ত। তবে কমিশনের মতে কেবল ওই ২৩ জনই নন, পরিচালনা বোর্ডের সদস্যবৃন্দ, বিসিএমসিএল-এর শেয়ার হোল্ডারবৃন্দ এবং পেট্রোবাংলাসহ জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দের দায়িত্বে অবহেলার কারণে কয়লা আত্মসাতের ঘটনাসহ আলোচ্য অপরাধমূলক কার্যক্রম ঘটেছে। ফলে ওই ২৩ জনের মত অন্যরাও এ-সব অভিযোগে অভিযুক্ত বিধায় তাঁরা উক্ত অভিযোগপত্রভূক্ত হবেন। পেট্রোবাংলা তথা প্রজাতন্ত্রের কতিপয় কর্মচারীর পদের বিপরীতে ১টি করে শেয়ার ক্রয়ক্রমে ওই পদে অধিষ্ঠিত কর্মচারীরা সরকারী মালিকানাধীন কোম্পানী বিসিএমসিএল-এর মালিক হন। তবে ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানীর মালিক/মালিকগণ নিজের সম্পত্তি হিসাবে কোম্পানীকে যেভাবে সুরক্ষা দেন এবং কোম্পানীর লাভ-ক্ষতি দেখেন, ওইসব সরকারি কর্মচারীরা বিসিএমসিএল-এর মালিক হিসাবে বিসিএমসিএল’কে সেভাবে সুরক্ষা দেননি এবং ভালমন্দও দেখেননি। ফলে তাঁদের ভূমিকা ছিল ভোক্তা স্বার্থ ও অধিকার বিরোধী এবং সংবিধানের ৭, ১৩ এবং ১৪৩ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। অতএব জনস্বার্থে বিসিএমসিএলসহ সরকারী মালিকাধীন সকল কোম্পানীসমূহ পরিচালনা নীতি ও আইনী কাঠামো সংস্কার জরুরি।
বিসিএমসিএল সুশাসন সংকটের শিকার। সুশাসন নিশ্চিত হতে হলে আলোচ্য অপরাধমূলক কার্যক্রম প্রতিরোধসহ বিসিএমসিএল’কে দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে।
সেজন্য করণীয়ঃ
১) পিডিবি ব্যতিত অন্যকোন ভোক্তার নিকট কয়লা বিক্রি স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ হতে হবে। সেজন্য বিদ্যমান কয়লা বিক্রির নীতিমালা বাতিল হতে হবে। কয়লা পরিমাপের সাথে কয়লায় সম্পৃক্ত ময়েশ্চারও স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিমাপ হতে হবে। সেই সাথে অনলাইন মনিটরিং-এর ব্যবস্থা থাকতে হবে।
২) বিদ্যুৎকেন্দ্রের ‘কোল’ মিলে সরবরাহকৃত কয়লার ওজন পরিমাপের সাথে সে কয়লায় সম্পৃক্ত ময়েশ্চারও স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিমাপ হতে হবে। অনলাইন মনিটরিং-এর ব্যবস্থা থাকতে হবে। অনলাইন মনিটরিং-এ ভোক্তাদেরও একসেস থাকতে হবে।
৩) কয়লায় সম্পৃক্ত গ্রহণযোগ্য ময়েশ্চারের সঠিক মাত্রা ৫.১% এর পরিবর্তে ২.৩% নিশ্চিত হতে হবে।
৪) বিএসএমএল মাইনিংসহ মাইন ম্যানেজমেন্ট, মেইনটেন্যান্স এবং প্রভিসনিং সার্ভিসেসে দক্ষতা ও সক্ষমতা শতভাগ অর্জন এবং এতদ্সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম চীনা কন্সোর্টিয়ামের নিকট থেকে বুঝে না নেয়া অবধি খনি ভাতা, ভূ-গর্ভস্থ ভাতা ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি ভাতাসহ সকল প্রকার বোনাস এবং পেট্রোবাংলার সার্ভিস চার্জ রহিত হতে হবে।
৫) একই ওজনে ও একই মাত্রায় ময়েশ্চার সম্পৃক্ত কয়লা বিসিএমসিএল ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র উভয়ই গ্রহণ করে এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র এককভবে সমূদয় কয়লা গ্রহণ করে। কয়লা উৎপাদনের মতই সরবরাহ বা বিপননে বিসিএমসিএল-এর উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা নেই। ফলে সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব ঠিক রেখে সরবরাহ ব্যয় যৌক্তিক করে কয়লার বিক্রয় মূল্যহার ন্যায্য ও যৌক্তিক হতে হবে।
৬) বিসিএমসিএল’এর জনবল ও অপারেশনাল ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনতে হবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী পদাধিকার বলে যাঁরা বিসিএমসিএল-এর বোর্ড সদস্য ও শেয়ারহোল্ডার, সরকারি বিধি-বিধান উপেক্ষা করে তাঁদেরকে যে আর্থিক সুবিধাদি দেয়া হয়, তা রহিত হতে হবে।
৭) পেট্রোবাংলার সার্ভিস চার্জ তার রাজস্ব চাহিদার ভিত্তিতে নির্ধারণ হতে হবে।
৮) বিদ্যমান অবস্থায় বিসিএমসিএল-এর সিএসআর ফান্ড ও কল্যান তহবিল রদ হতে হবে। ডাবলিউপিএফ-এর শতভাগ অর্থ কেবলমাত্র স্থায়ী-অস্থায়ী ও আউট-সোর্সিং শ্রমিকদের মধ্যে নির্বিশেষে বন্টন হতে হবে। কন্সোর্টিয়ামে নিয়োজিত বাঙ্গালী শ্রমিকদেরও এ-অর্থের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত হতে হবে।
৯) যেহেতু ব্যক্তি খাত কোম্পানীর অনুরূপ সরকারি কোম্পানীর মালিক ব্যক্তি নয় সরকার, সেহেতু সরকারি কোম্পানীর পরিচালনা বোর্ড, বোর্ড চেয়ারম্যান ও শেয়ার হোল্ডারগণ ব্যক্তি খাত কোম্পানীর অনুরূপ সুযোগ-সুবিধা এবং আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা পেতে পারে না। এমন ক্ষমতা রাষ্ট্র গণ কর্মচারীকে অর্পন করতে পারে না। ফলে সরকারি কোম্পানী পরিচলানায় সংস্কার হতে হবে।
১০) বিসিএমসিএল মাইনিং-এ শতভাগ সক্ষমতা অর্জন না করা অবধি কয়লার বিক্রয় মূল্যহার কষ্টপ্লাস নয়, নো লস-নো প্রফিট ভিত্তিতে নির্ধারণ হতে হবে। বিইআরসি আইন ২০০৩ সংশোধনক্রমে জ্বালানীর সংজ্ঞায় কয়লা অন্তর্ভূক্ত হতে হবে এবং কয়লার মূল্যহার জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগ নয়, বিইআরসি কর্তৃক বিইআরসি আইনের আওতায় প্রবিধানমালা দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্ধারণ হতে হবে।
১১) বিসিএমসিএল-এর নিজস্ব অর্থায়নে ব্যাক ফিলিং করে ভূমি অবনমন প্রতিরোধসহ খনির কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণও নিশ্চিত হতে হবে।
১২) চীনা কন্সোর্টিয়ামের নিকট থেকে বিসিএমসিএল কর্তৃক ক্রয়কৃত কয়লার মূল্যহার ন্যায্য ও যৌক্তিক কিনা তা নাগরিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত স্বার্থসংঘাত মুক্ত কমিটি দ্বারা যাচাই বাছাই হতে হবে।
১৩) ন্যায্য দামে, মাপে ও মানে কয়লা পাওয়া ভোক্তার অধিকার। সে অধিকার সুরক্ষায় কয়লার সঠিক ক্রয়-বিক্রয় মূল্য এবং কয়লায় সম্পৃক্ত ময়েশ্চারের সঠিক মাত্রা নিশ্চিত হতে হবে।
মন্তব্যঃ
বিসিএমসিএল তথা বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতে অপরাধমূলক কার্যক্রম প্রতিরোধসহ দুর্নীতি প্রতিরোধে উল্লিখিত সুপারিশগুলি কার্যকর করা রাষ্টের পক্ষে তখনই সম্ভব হবে, যখন বিদ্যুৎ বিভাগ এবং জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে আপস্ট্রীম তথা পলিসি রেগুলেটরের দায়িত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে এ-খাতকে স্বার্থসংঘাত মুক্ত করা সম্ভব হবে। সেজন্য উভয় বিভাগের কর্মকর্তাদের সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানীর পরিচালনা বোর্ড থেকে অবমুক্ত হতে হবে।
তদন্তের ফলাফলঃ
কমিশনের পর্যালোচনায় দেখা যায়, উৎপাদনের শুরু থেকে ১৯ জুলাই ২০১৮ অবধি বিসিএমসিএল চুক্তিতে গ্রহনযোগ্য ৫.১% ময়েশ্চার ধরে ১০১.৬৬ লক্ষ টন কয়লার বিল পরিশোধ করে এবং এই পরিমাণ কয়লাকে চীনা কন্সোর্টিয়ামের নিকট থেকে প্রাপ্ত কয়লার পরিমাণ হিসাবে দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে কয়লায় গড়ে ১০.৫% ময়েশ্চার ছিল। এর অর্থ বিসিএমসিএল কর্তৃক গৃহীত কয়লার পরিমাণ ১০১.৬৬ লক্ষ টনের বেশী। কিন্তু ১০.৫% ময়েশ্চারে গৃহীত এই কয়লার পরিমানের কোন রেকর্ড নেই। কমিশনের হিসেবে ১০.৫% ময়েশ্চারে বিসিএমসিএল কর্তৃক প্রাপ্ত কয়লার পরিমাণ ১০৭.৩১ লক্ষ টন, যা বিসিএমসিএল কর্তৃক রেকর্ডভূক্ত কয়লার চেয়ে বেশী। বিসিএমসিএল কয়লা ব্যবহার ও বিক্রি করে ১০০.২২ লক্ষ মেট্রিক টন। সে অনুযায়ী ঘাটতি দেখায় ১০১.৬৬ -১০০.২২ =১.৪৪ লক্ষ মেট্রিক টন। কিন্তু কমিশনের হিসাবে এ ঘাটতি ১০৭.৪৬- ১০০.২২= ৭.০৯ লক্ষ টন। পেট্রোবাংলার প্রস্তাব মতে কয়লা সরবরাহে সিস্টেম লস গড়ে ১.৫% অর্থাৎ ১.৬১ লক্ষ টন ধরে নিলেও কয়লা ঘাটতি/অত্মসাৎ ৭.০৯- ১.৬১ = ৫.৪৮ লক্ষ টন।
আবার বিসিএমসিএল-এর রেকর্ড মতে বিক্রয়কৃত কয়লায় সম্পৃক্ত ময়েশ্চারের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ১০%। অথচ সে-কয়লায় ময়েশ্চার থাকে ১৫%। ফলে ৫% ময়েশ্চার হিসাবের বাইরে রেখে ভোক্তার নিকট থেকে ৫.০২ লক্ষ মেট্রিক টন কয়লার বাড়তি বিল আদায় করা হয়। ফলে ভোক্তা প্রতারিত হয় ।
প্রকৃতপক্ষে বড়পুকুরিয়া খনির কয়লায় সম্পৃক্ত ময়েশ্চারের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ২.৩% । কিন্তু বিসিএমসিএল চীনা কন্সোর্টিয়ামের নিকট থেকে ৫.১% ময়েশ্চারে কয়লা ক্রয় করে। ফলে ২.৮% অগ্রহণযোগ্য বাড়তি ময়েশ্চার কয়লায় সম্পৃক্ত থাকায় বিসিএমসিএল কন্সোর্টিয়ামকে ২.৮৫ লক্ষ মেট্রিক টন কয়লার বিল বেশি দেয়।
তাছাড়া কমিশনের বিবেচনায় কয়লা ক্রয় ও বিক্রয় মূল্যহার ন্যায্য ও যৌক্তিক নয়। কয়লার সরবরাহ ব্যয় ন্যায্য ও যৌক্তিক করা হলে মূল্যহার হ্রাস পাবে। তাতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় যেমন কমবে, তেমন সরকারের রাজস্বও বাড়বে। সরকারি মালিকাধীন কোম্পানী বিসিএমসিএল ব্যক্তি মালিকাধীন কোম্পানীর নিয়ম-নীতিতে পরিচালিত হওয়ায় এমন সব অসংগতি।