ড. কামরুল হাসান মামুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের আশা আছে। সেই আশা কি পূরণ হচ্ছে? শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, অপরাজনীতি, নির্যাতন, দুর্নীতি সবই আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসব বন্ধে প্রশাসনের খুব একটা তোড়জোড় দেখা যায় না। প্রশাসন সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হয় শিক্ষক নিয়োগে।
শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া
পৃথিবীর ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলুন, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ কেবল মাত্র একটি স্তরে একটি ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, শিক্ষার্থীদের উপর একজন ভালো শিক্ষকের ভূমিকা ও গুরুত্ব কতটা তা কি এই যুগে এই সময়ে ব্যাখ্যা করার দরকার আছে?
একজন উন্নত মানের নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক খাদে পরা অনেক শিক্ষার্থীর জীবনের মোর ঘুরিয়ে দিতে পারে। আবার একজন খারাপ শিক্ষক ভাল শিক্ষার্থীকে হতাশায় নিমজ্জিত করতে পারে। তাই শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশন নীতিমালা একাধিক স্তরে বিভক্ত হতে হয় যেন কোনোভাবেই ভালোকে ডিঙিয়ে খারাপ মানের কেউ শিক্ষক হয়ে যেতে না পারে।
এ জন্যই শিক্ষক নিয়োগের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো সংশ্লিষ্ট বিভাগের। বিভাগের নেতৃত্বে একটি সার্চ কমিটি থাকতে হয়। যেই কমিটিতে দেশ বিদেশের খ্যাতিমান স্কলাররা সদস্য হিসেবে থাকবে। তারা প্রার্থীদের সব কাগজপত্র, গবেষণাপত্র দেখে একটি শর্টলিস্ট করবে।
সেই শর্টলিস্টে যারা থাকবে বিভাগ তাদের ডেকে ইন্টারভিউ নেবে, দিনব্যাপী সেমিনার আয়োজন করবে যেখানে ছাত্র শিক্ষক সবাই থাকবে এবং সব শেষে সবার মতামত নেবে। সেই মতামতের ভিত্তিতে আরেকটি শর্টলিস্ট করবে যাদেরকে উচ্চতর নিয়োগ বোর্ডে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকা হবে এবং সেই ইন্টারভিউয়ের ভিত্তিতে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করবে। এইভাবে করলে রাজনৈতিক নিয়োগ, ভোটার নিয়োগ ইত্যাদি একদম কমে যাবে।
শিক্ষক নিয়োগের শর্ত আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতা বিশেষ গুরুত্ব পায়। যাদের পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতা আছে বুঝতে হবে তারাই শর্টলিস্টেড।
এছাড়া, শিক্ষক নিয়োগের শর্ত আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতা বিশেষ গুরুত্ব পায়। যাদের পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতা আছে বুঝতে হবে তারাই শর্টলিস্টেড।
পোস্ট-ডক একটা স্বীকৃতি। তাই যার যত বছরের পোস্ট-ডক আছে তাকে অন্তত তত বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা হিসেবে ধরতে হবে। একজন পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শিক্ষক পাওয়া একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দারুণ ব্যাপার কারণ তাকে পিএইচডি-র জন্য বেতন সহকারে ছুটি দিতে হবে না। তাকে পোস্ট-ডকের জন্য পূর্ণ বেতনে ছুটি দিতে হবে না।
পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শিক্ষক, পূর্ণাঙ্গ শিক্ষক, যার একাধিক সুপারভাইজারের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা আছে যা শিক্ষকতা ও গবেষণার জন্য সেরা ট্রেনিং হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
এখন এই রকম পিএইচডি ও পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ শিক্ষক পেলে তাকে কি সাধারণ বেতন দিলে হবে? আমরা কি উচ্চ মাধ্যমিক পাস আর অনার্স পাস করা শিক্ষকদের সমান বেতন দেব? আমরা কি অনার্স পাস এবং মাস্টার্স ডিগ্রিধারীদের সমান বেতন দেব বা দেই?
এইগুলোর সুরাহা না করলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কখনোই বিশ্বমানের হবে না। আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বমানের না করলে দেশে সত্যিকারের উন্নয়ন হবে না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা পাস করে বের হবে তারাই দেশকে নেতৃত্ব দেবে।
ছোট্ট একটা দেশ সিঙ্গাপুর, এত উন্নত হতে পেরেছে কারণ তাদের একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় আছে। একই কথা বলা চলে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, চীন এবং জাপানের ক্ষেত্রে। বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত কোনো জাতি উন্নত হতে পারে না।
যেমন বিশ্ববিদ্যালয় আমি চাই
আমি চাই বিশ্ববিদ্যালয় হবে শিক্ষা, গবেষণা, আড্ডা, বিতর্ক, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে মুখর। আবাসিক হলগুলোয় কোনো অপরাজনীতি থাকবে না। ইচ্ছে হলে আদর্শের ভিত্তিতে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কেউ কেউ ছাত্র রাজনীতি করবে এবং তার ভিত্তিতে নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকবে।
রাজনীতি করার জন্য, মিছিলে যাওয়ার জন্য, হলের সিটের জন্য কোনো জোরাজুরি থাকবে না। প্রথম বর্ষের ছাত্রদের সিট বরাদ্দে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। সব আবাসিক শিক্ষার্থীর ঘুমানোর জন্য একটি বিছানা, পড়ার জন্য একটি টেবিল, কাপড় চোপড় রাখার জন্য একটি ওয়ারড্রব থাকবে।
শিক্ষার্থীরা ভর্তি হবে, হলে সিট বরাদ্দ পাবে, রুমের একটি চাবি পাবে তারপর শুরু হবে শৃঙ্খলার সাথে রুটিন জীবনযাপন। যদি উপরে উল্লিখিত ব্যবস্থা করা যেত তাহলে হল চালানোর জন্য শিক্ষকদের দায়িত্ব দেওয়ার প্রয়োজন হতো না।
গুটিকয়েক কর্মকর্তাই যথেষ্ট ছিল। এমনকি সিনিয়র ক্লাসের শিক্ষার্থীরাও পার্ট-টাইম এই কাজ করতে পারতো। এর মাধ্যমে দরিদ্র শিক্ষার্থীরা আর্থিক সহায়তা পেত। শিক্ষকরা অনেক বাড়তি কাজ থেকে মুক্ত হতে পারতো। বেঁচে যাওয়া এই সময় শিক্ষা ও গবেষণার কাজে ব্যয় করতে পারতো।
শিক্ষকরা যদি ন্যূনতম ভারত পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম পরিমাণ বেতন পেত এবং একই সাথে শিক্ষকদের পার্ট-টাইম শিক্ষকতা যদি নিষিদ্ধ করা হতো তাহলে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের প্রতি, লেখাপড়া ও গবেষণার প্রতি বেশি মনোযোগী হতো। তাহলে বিদ্যমান শিক্ষকদের মান দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান অনেক উন্নত করা যেত।
আমি চাই বিশ্ববিদ্যালয় হবে শিক্ষা, গবেষণা, আড্ডা, বিতর্ক, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে মুখর। আবাসিক হলগুলোয় কোনো অপরাজনীতি থাকবে না…
‘ট্যালেন্ট শিক্ষক হান্ট’ নামে একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়ে আমাদের ছেলে-মেয়েরা যারা দেশের বাইরে ভালো করছে তাদের দেশে ফিরে আসতে উৎসাহিত করা গেলে শিক্ষার মান বাড়তো।
শিক্ষকরা উন্নত মানের গবেষণা জার্নালে আর্টিকেল প্রকাশ করলে আর্থিক প্রণোদনা দিলে গবেষণার মান বৃদ্ধি পেত।
প্রত্যেক বিভাগে ভালো মানের ফেলোশিপ দিয়ে পিএইচডি ছাত্র ও পোস্ট-ডক নিয়োগ দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান বাড়ত। ভালো ফেলোশিপ দিলে বিদেশিরাও পোস্ট-ডক নিয়ে আসতো এবং এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকারের একটি আন্তর্জাতিক পরিবেশ তৈরি হতো। এই পোস্ট-ডকদের বিভাগের শ্রেণিকক্ষে পাঠদানেও কাজে লাগানো যেত। প্রতিটি বিভাগে যদি শিক্ষক সহকারী নিয়োগ দেয়া যেত তাহলে আরও ভালো হতো।
এইসব কোনোকিছুই আমার মনগড়া নয়। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বে সেরা হয়েছে তারা এইসব নিয়ম চালু করেই সেরা হয়েছে। এইগুলো প্রমাণিত পদ্ধতি। এই পদ্ধতি ছাড়া উচ্চশিক্ষায় ভালো করার ভিন্ন কোনো পথ নেই।
উপরের সিস্টেম চালু করতে পারলে অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যেত না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হতো। ব্রেইন ড্রেইন কমতো।
ড. কামরুল হাসান মামুন, অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।