ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক: আসন্ন রমজান মাস উপলক্ষে চাল, ডাল, তেল, চিনি, পিঁয়াজ, সবজি, ফল, ডিম, মুরগিসহ ৪০ পণ্যের পাইকারি ও খুচরা মূল্য বেধে দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।
রমজানে কৃষিপণ্যের সরবরাহ ও দাম স্বাভাবিক রাখতে ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। বৈঠকে রমজান উপলক্ষে রাজধানীর বাজারগুলোতে এ তালিকা টানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানিয়েছে, রমজানে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন ও আমদানি স্বাভাবিক আছে। কোনো পণ্যের ঘাটতি নেই। তার পরও বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হলে কঠোর অবস্থানে যাবে সরকার। রমজানজুড়ে সাঁড়াশি অভিযানে থাকবে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা
বৈঠকে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, পণ্যের সরবরাহ এখন স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে, ঘাটতি নেই। প্রতি বছর রমজানে দফায় দফায় সরকারের সংস্থাগুলো বৈঠক করলেও নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না। এজন্য মূলে হাত দিতে হবে। অযৌক্তিকভাবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার চাপ সইতে হচ্ছে ভোক্তাকেই। অন্যদিকে মধ্যস্বত্বভোগী ও ফড়িয়া ব্যবসায়ীর দৌরাত্ম্য এবং পুলিশ ও পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আছে।
বৈঠকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানিয়েছে, রমজাননির্ভর ছয় পণ্য- ছোলা, পিঁয়াজ, ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, চিনি ও খেজুরের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পর্যাপ্ত মজুত গড়ে তোলা হয়েছে। রমজান মাসের চাহিদার তুলনায় এসব পণ্যের সরবরাহ বেশি রয়েছে। এ ছাড়া আমদানি প্রক্রিয়ায়ও রয়েছে বিপুল পরিমাণ পণ্য। আমদানিও বেড়েছে। ফলে বাজারে রমজাননির্ভর এসব পণ্যের কোনো ধরনের সংকট নেই।
রমজান মাস সামনে রেখে ছয় পণ্যের মজুত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।
সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর দেশে চিনির চাহিদা ১৮ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু রমজানে চাহিদা ৩ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে দেশে উৎপাদন হয়েছে ৪০ হাজার টন। আমদানি করতে হয় প্রায় ১৯ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ৪ লাখ ৮৮ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে। এটা গত বছর একই সময়ের তুলনায় ২ লাখ ৬০ হাজার টন বেশি।
একইভাবে বছরে মসুর ডালের চাহিদা পাঁচ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু রমজান মাসে চাহিদা ৭০ হাজার টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হয়েছে দুই লাখ ৬০ হাজার টন। বছরে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টন আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকের হিসাব অনুযায়ী এক লাখ ৩২ হাজার টন মজুত আছে যা গত বছর একই সময়ের তুলনায় ৫০ হাজার টন বেশি।
অন্যদিকে মার্চের প্রথম সপ্তাহের তথ্যমতে, মটর ডালের মজুত আছে এক লাখ ৫০ হাজার টন, যা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি। বছরে ছোলার চাহিদা এক লাখ টন। এর মধ্যে রমজান মাসে চাহিদা ৮০ হাজার টন। স্থানীয়ভাবে দেশে উৎপাদন হয়েছে ৬ হাজার টন। বাকিটা আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে দেশে গত জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এক লাখ ৭৮ হাজার টন ছোলা আমদানি করা হয়েছে। ফলে দেশে ছোলার চাহিদার তুলনায় সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে।
দেশে বছরে প্রায় ২৫ লাখ টন পিঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রোজার মাসের চাহিদা ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয়েছে ৩৫ লাখ ৪ হাজার টন। তবে পিঁয়াজের ২০-২৫ শতাংশ সাধারণত সংরক্ষণকালে নষ্ট হয়। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত ৪ লাখ ২৭ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। ফলে চাহিদার তুলনায় পেঁয়াজ বেশি আছে।
বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। শুধু রোজার মাসে চাহিদা আড়াই থেকে সর্বোচ্চ ৩ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে ২ লাখ ৩ হাজার টন উৎপাদিত হয়। বাকি ১৮ লাখ টন আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের চিত্র বলছে, অর্থবছরের জুলাই থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত ৯ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে বর্তমানে ভোজ্যতেল চাহিদার তুলনায় সরবরাহ পর্যাপ্ত। দেশে প্রতি বছর ৪০ হাজার টন খেজুরের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রোজার মাসে ২৫ হাজার টন দরকার হয়। প্রতি বছরই চাহিদার চেয়ে বেশি খেজুর আমদানি হয়।
আমদানি তথ্যের পাশাপাশি ৪০টি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য- মোটা চালের খুচরা মূল্য ৪৭ টাকা, মসুর ডাল (মোটা) ৯৮ টাকা, ছোলা ৭২ টাকা, সয়াবিন তেল (খোলা) ১৩০ টাকা, সয়াবিন তেল (ক্যান লিটার) ১৬০ টাকা, চিনি (সাদা আমদানি) ৭৪ টাকা, দেশি পিঁয়াজ ৩৬ টাকা, আমদানি করা পিঁয়াজ ৪৭ টাকা, ফার্মের ডিমের হালি ৩৬ টাকা, ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৬৪ টাকা এবং সোনালি মুরগির কেজি ২৮৯ টাকা। মূল্য তালিকা না টানালে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়।
পণ্যমূল্য সহনীয় রাখতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সাতটি সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সমুদ্র ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এবং শুল্ক্ক স্টেশনে রমজানকে সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য খালাসে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার, ফেরি পারাপারে পণ্য পরিবহনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার, পণ্য পরিবহনে পুলিশের সহায়তা, টিসিবির কার্যক্রমে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহায়তা, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেওয়া, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও মজুতকারীদের বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বাড়ানো এবং বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা।
বৈঠকে ব্যবসায়ীরা বলেন, শুধু ব্যবসায়ীদের দায়ী না করে উৎপাদন খরচও কমাতে হবে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পণ্য পরিবহন ও ক্রয়-বিক্রয়ের সময় বিভিন্ন জায়গায় মধ্যস্বত্বভোগী ও পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাই মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে ফয়দা লোটেন।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আ. গাফ্ফার খান বলেন, যৌক্তিক মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভোক্তা অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। যেখানে এই খুচরা মূল্যকে ভিত্তি ধরে খুচরা দাম পর্যবেক্ষণ করা হবে। কোনো অনিয়ম পেলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে।