।। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ডেস্ক ।।
অপারেশনে পেট কেটে অর্থাৎ সিজারিয়ান পদ্ধতিতে শিশু জন্ম হার ক্রমেই বাড়ছে। ২০০১ সালে দেশে সিজারিয়ানে সন্তান জন্মের হার ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। দেড় দশকের ব্যবধানে তা বেড়ে হয়েছে ৩১ শতাংশ। এ সিজারিয়ানের বড় অংশই আবার হচ্ছে উচ্চ ব্যয়ে বেসরকারি হাসপাতালে। আর এ ব্যয় নির্বাহে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে পরিবারগুলো।
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট) ও আইসিডিডিআর,বির সর্বশেষ মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপের তথ্য বলছে, যেসব পরিবারের শিশু হাসপাতালে জন্ম নিচ্ছে, সেগুলোর প্রায় ২০ শতাংশ ঋণের জালে জড়াচ্ছে। মূলত সিজারিয়ানে সন্তান প্রসব করাতে গিয়েই ঋণগ্রস্ত হচ্ছে পরিবারগুলো। খবর বণিক বার্তা।
বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর ব্যবসায়িক প্রবণতা এর বড় কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রোগী ও চিকিৎসকের ধৈর্যের অভাবও এজন্য দায়ী। পাশাপাশি ঘাটতি রয়েছে দক্ষ মিডওয়াইফেরও।
কয়েক মাস আগে সিজারিয়ানে সন্তানের জন্ম দেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আবদুস সালামের স্ত্রী। এজন্য তার খরচ হয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা। এ ব্যয় নির্বাহে কর্মস্থল থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন আবদুস সালাম।
শিশুজন্মে স্বাভাবিকের তুলনায় সিজারিয়ান পদ্ধতির ব্যয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঁচ গুণ বেশি। ফলে এর ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে আবদুস সালামের মতো অনেক পরিবারই এখন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। কেউ কেউ সম্পদ বিক্রি করেও ব্যয় নির্বাহে বাধ্য হচ্ছেন।
জরিপের তথ্য বলছে, দেশে হাসপাতালে বা বিভিন্ন হেলথ ফ্যাসিলিটিতে জন্ম নেয়া নবজাতকদের পরিবারগুলোর ১৯ দশমিক ৭ শতাংশকে এর আংশিক বা পূর্ণ ব্যয় নির্বাহে ঋণ নিতে হয়। পাশাপাশি সম্পদ বিক্রি করে অর্থসংস্থানে বাধ্য হয় ১ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবার। সম্পদ বন্ধক রাখে দশমিক ৫ শতাংশ। পারিবারিক তহবিল থেকে ব্যয়ের একাংশের সংস্থান করে ৮১ শতাংশ পরিবার। এছাড়া আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে পাওয়া উপহার ও অন্যান্য নানা উৎস থেকে পাওয়া অর্থও ব্যয় করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস ও গাইনি বিভাগের অধ্যাপক ডা. নাহরীন আক্তার বলেন, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুর জন্ম বেড়েছে কথাটা সত্যি। ১৫ বছর আগেও আমরা প্রসব বলতে স্বাভাবিক প্রসবকেই বুঝতাম। এখন তো অস্ত্রোপচারের হারই বেশি। স্বাভাবিক প্রসবের জন্য চিকিৎসককে অনেক সময় দিতে হয়। বিদেশে সাধারণত মিডওয়াইফরা রোগীকে সারাক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে স্বাভাবিক প্রসব করিয়ে থাকেন। আমাদের দেশে দক্ষ মিডওয়াইফের সংখ্যা এখনো অনেক কম। এছাড়া রোগীরাও এখন আর ব্যথা সহ্য করতে চান না। চিকিৎসক ও রোগীর কম ধৈর্যের কারণে অস্ত্রোপচারে শিশুজন্মের হার বাড়ছে।
দেশে সিজারিয়ান প্রসবের ৭৯ শতাংশই আবার হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয়। এসব হাসপাতালে স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসবের গড় ব্যয় ৬ হাজার ৮০০ টাকা হলেও সিজারিয়ানে ব্যয় দাঁড়ায় গড়ে প্রায় ২০ হাজার টাকা। সরকারি ও এনজিও পরিচালিত হাসপাতালগুলোয় স্বাভাবিক প্রসবে ব্যয় হয় যথাক্রমে ৩ হাজার ও ২ হাজার ৬০০ টাকা। বিপরীতে সিজারিয়ানে গড় ব্যয় প্রায় ১২ হাজার টাকা। অন্যান্য খরচ যোগ করে এ ব্যয়ের পরিমাণ আরো বেড়ে যায়।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর ৩১ লাখ শিশু জন্ম নেয়। এর মধ্যে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম হয় সাড়ে নয় লাখ শিশুর। এর মধ্যে সাড়ে সাত লাখই জন্ম নেয় বেসরকারি হাসপাতালে। একেকটি সিজারিয়ানের গড় ব্যয় ২০ হাজার টাকা ধরলেও দেখা যায়, দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলো শুধু সিজারিয়ানেই আয় করছে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি।
সিজারিয়ানের কারণে ঋণগ্রস্ত হতে হয়েছে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার শিউলী বিশ্বাসের পরিবারকে। নির্ধারিত সময়ের আগে জটিলতা দেখা দেয়ায় সিলেটের একটি হাসপাতালে সিজারিয়ানের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিতে বাধ্য হন এ গৃহবধূ। জন্মের পর ওজন কম হওয়ার পাশাপাশি শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা থাকায় দুদিন এনআইসিইউতে রাখতে হয় কন্যাসন্তানটিকে। চারদিনে ব্যয় হয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা। এ টাকার সংস্থানে ঋণ করতে হয় তার পরিবারকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, গর্ভকালীন সমস্যা বা প্রসবে জটিলতা দেখা দিলে মা ও সন্তানের জীবন রক্ষায় অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। একটি জনগোষ্ঠীতে সর্বোচ্চ ১০-১৫ শতাংশ সন্তান প্রসবে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে। এর বেশি হলে তা অপ্রয়োজনীয়। এ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুজন্মের হার এখন ডব্লিউএইচও নির্ধারিত হারের দ্বিগুণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপ্রয়োজনীয়ভাবে অস্ত্রোপচার করে শিশু জন্ম দেয়া হলে তাতে মা ও শিশু উভয়েরই স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে। অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ানের ফলে মায়ের দেহে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়া ছাড়াও রক্ত পরিসঞ্চালনে সমস্যা, জরায়ু অপসারণ ও মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের হার আবার উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিতদের মধ্যে বেশি। সর্বশেষ মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপের তথ্য অনুযায়ী, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিচ্ছেন ৫৬ শতাংশ উচ্চবিত্ত মা। অস্ত্রোপচারে শিশুজন্মের হার সবচেয়ে বেশি খুলনা বিভাগে। এখানে জন্ম নেয়া শিশুর ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ সি-সেকশনে। এ হার সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে, ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ।
।