সুমন ইসলাম
সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী দুর্ঘটনা তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ—বিআরটিএ। এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে করোনা পরবর্তী নানা কারণে এখনও বিষয়টি মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিলেও সংসদে পাস হয়নি। দ্রুত সময়ের মধ্যে বিধিমালাটি অনুমোদন হলো প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করবে বিআরটিএ।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, সব পক্ষের সহযোগিতা পেলে দ্রুতই তহবিল চূড়ান্ত হবে। বিধিমালা প্রণয়ন হওয়ার পর এটি কার্যকর হবে। এজন্য সরকারের কাছে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। তবে ক্ষতিপূরণের অর্থের মূল যোগানদাতা হবেন যানবাহনের মালিকরা।
সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ৫৪(১) উপধারা অনুযায়ী সরকার ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।গত ৩১ অক্টোবর বিআরটিএ সদর কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে বিআরটিএ ও ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের সভাপতিত্বে ট্রাস্টি বোর্ডের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন বিধিমালা চূড়ান্ত হওয়ার আগপর্যন্ত তহবিল গঠনের জন্য প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকা সরকারি অনুদান পেতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
আবেদনঃ
মোটরযানে দুর্ঘটনার ফলে কোনও ব্যক্তি আঘাতপ্রাপ্ত হলে বা মারা গেলে তিনি বা ক্ষেত্রমত তার উত্তরাধিকারীদের পক্ষে মনোনীত ব্যক্তি ট্রাস্টি বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে চিকিৎসার খরচ প্রাপ্য হবেন। এজন্য বোর্ডের কাছে লিখিত আবেদন করতে হবে। বোর্ড ওই আবেদন যাচাই করে ক্ষতিপূরণ দেবে।
ক্ষতিপূরণের উৎসঃ
আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠনের উৎস হবে— সরকারি অনুদান, মোটরযান মালিকের চাঁদা, সড়ক পরিবহন আইনের অধীন জরিমানার অর্থ, মালিক সমিতি ও শ্রমিক সংগঠনের অনুদান এবং অন্যান্য বৈধ উৎস।
ক্ষতিপূরণের পরিমাণঃ
প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন বিধিমালা অনুযায়ী দুর্ঘটনায় নিহত হলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে এককালীন অন্যূন ৫ লাখ টাকা। গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গহানি হলে অন্যূন ৩ লাখ টাকা। গুরুতর আহত ও চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা না থাকলে অন্যূন ৩ লাখ টাকা, গুরুতর আহত কিন্তু চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকলে অন্যূন এক লাখ টাকা। তবে সরকারের অনুমোদনক্রমে ট্রাস্টি বোর্ড প্রয়োজনে এর পরিমাণ কমাতে-বাড়াতে পারবে।
কোন পর্যায়ে আছে সড়ক পরিবহন বিধিমালা?
সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২১ এর খসড়া ইতোমধ্যে লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগে পাঠানো হয়েছে। পরে প্রস্তাবিত খসড়ায় লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ কিছু পর্যবেক্ষণ পাঠায়। পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সংশোধন করতে বিআরটিএ সচিবকে সভাপতি করে ৫ সদস্যের কমিটি করা হয়। পর্যবেক্ষণগুলোর সংশোধনের জন্য প্রস্তাবসহ বিআরটিএর চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিবেদন দেয় কমিটি। ওটা আবার অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগে। সেখানে অনুমোদন পেলে বিধিমালা চূড়ান্ত হবে বলে জানিয়েছে বিআরটিএ।
ট্রাস্টি বোর্ডের আলাদা জনবল কাঠামোঃ
ট্রাস্টি বোর্ডের জন্য পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ দেওয়া হবে ও এতে কী কী করা হবে তা নিয়ে কাজ করছে বিআরটিএ। আপাতত বনানীর বিআরটিএ অফিসটিই ট্রাস্টি বোর্ডের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হবে। স্থায়ী কার্যালয়ের জন্য রাজউক থেকে পূর্বাচলে ১০ কাঠা জমি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। তিনমাসে অন্তত একবার বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হবে।
বোর্ডের সদস্য যারাঃ
১২ সদস্যের কমিটিতে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হবেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান, যিনি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অন্যূন যুগ্মসচিব পদমর্যাদার হবেন। সদস্যরা হলেন- জননিরাপত্তা বিভাগের অন্যূন যুগ্মসচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের অন্যূন যুগ্মসচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকার বিভাগের অন্যূন যুগ্মসচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর কর্তৃক মনোনীত অন্যূন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা, হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর মনোনীত একজন কর্মকর্তা, সরকার কর্তৃক মনোনীত সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও সড়ক পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের একজন করে প্রতিনিধি, একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং সদস্য সচিব হবেন বিআরটিএ সচিব।
কোন যানের চাঁদা কতঃ
খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, আর্থিক তহবিল গঠনে মোটরসাইকেলের মালিককে এককালীন ৫০০ টাকা দিতে হবে। বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানের মতো বড় যানের চাঁদা বছরে এক হাজার টাকা। বছরে ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হবে মিনিবাস, মিনিট্রাক, পিকআপের। কার, জিপ ও মাইক্রোবাসের বার্ষিক চাঁদা ৩০০ টাকা। অটোরিকশাসহ থ্রি হুইলার এবং অন্যান্য যানের বার্ষিক চাঁদা হবে ২০০ টাকা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, তাঁরা বার্ষিক চাঁদা দিতে প্রস্তুত। সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা আগে তেমন কোনো ক্ষতিপূরণ পেত না। তহবিল গঠন করা হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব হবে।
বিআরটিএর তথ্যনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে সাড়ে ৪৫ লাখ যানবাহন আছে। প্রতিবছর গড়ে পাঁচ লাখ নতুন যানবাহন যুক্ত হচ্ছে। সব মিলিয়ে আগামী এক বছরের মধ্যে শতকোটি টাকার ওপরে তহবিল গঠন সম্ভব।
বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এসব দুর্ঘটনার কারণে বছরে মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২ থেকে ৩ শতাংশ হারাচ্ছে বাংলাদেশ।
সূত্র জানায়, আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠন নতুন সড়ক পরিবহন আইনের ভালো দিক। তবে পরিবহনমালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপ, বিআরটিএ এবং পুলিশের সক্ষমতার ঘাটতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে এগুলো বাস্তবায়নই মূল চ্যালেঞ্জ।