বিগত ১১ বছরে ১০ দফায় বিদ্যুতের পাইকারি দাম ১১৮ শতাংশ ও খুচরা দাম ৮৯.৬৩ শতাংশ বেড়েছে বলে সোমবার কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ–ক্যাব ও ভোক্তাকণ্ঠ আয়োজিত জ্বালানি রূপান্তরে ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা শীর্ষক এক ওয়েবিনারে জানানো হয়। এছাড়াও প্রতি বছর বিদ্যুৎ খাতে ৭ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়–যা দামের সঙ্গে যুক্ত হলে বিদ্যুতের প্রকৃত মূল্য আরো বেশি হয় বলে আলোচকরা মত দেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ–ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমানের সভাপতিত্বে এবং ভোক্তাকণ্ঠ সম্পাদক কাজী আব্দুল হান্নান ও ক্যাব সংগঠক সৈয়দ মিজানুর রহমানের যৌথ সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাংবাদিক মনজুরুল আহসান।
লিখিত প্রবন্ধে মনজুরুল আহসান বলেন, পিডিবি ভেঙে দুটি কোম্পানী হওয়ায় জনবল বাবদ ব্যয় বেড়েছে। তারা যে তথ্য-উপাত্ত দেয় তাতে এই ব্যয়ের বিষয়গুলো দেখা। কিন্তু অনিয়মের অনেক খবর আড়াতে থেকে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানীগুলোর শেয়ার বিক্রি করে বেসরকারি মালিকানায় দেওয়া হচ্ছে। এই কোম্পানীগুলোর অর্থ বিভিন্ন ব্যাংকে অর্থ এফডিআর করে রাখা হচ্ছে। পরবর্তীতে কিন্তু এই শেয়ারের অর্থ কোথায় যাচ্ছে তা কেউ জানে না। বিগত বছরগুলোতে ভোক্তাসংশ্লিষ্ঠ সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে দেখানো হয়েছে যে, বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর প্রয়োজন নেই, বরং তা কমানো যেতে পারে। অথচ বিদ্যুতের দাম গত ১১ বছরে ১০ দফায় বৃদ্ধি করা হয়েছে।
পিডিবি বা কোম্পানীগুলোর সঙ্গে আমলাতন্ত্রের সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ধরে সাংবাদিক মনজুরুল বলেন, অনিয়ম-অসঙ্গতিতে কোম্পানীর বোর্ড সদস্যদের দায় থাকে না। লাভ-লসের দায় তারা নেন না। কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের কথা বলতে গিয়ে তিনি দেখান যে, একই ব্যক্তি যখন সচিবালয়ে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি যখন আবার কোম্পানীতে এসে মূল্য নির্ধারণ করেন তখন নিয়ন্ত্রণ ও ভারষাম্য বা চেক এন্ড ব্যালান্স বাধাগ্রস্ত হয়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা ও ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ বা জ্বালানি সঠিক দাম ও মানে পাওয়া আমাদের অধিকার। একইসঙ্গে পরিবেশ রক্ষার দিকটিও সংবিধান নিশ্চিত করেছে।
তিনি জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টেনে বলেন, আমাদের দেশের চেয়ে তাদের দেশে বিদ্যুতের মূল্য কম। তিনি বলেন, জ্বালানি খাত উন্নয়নে রূপান্তরের বিষয়ের প্রশ্ন আসছে, রূপান্তর নিয়ে দেশে ১৭ বছর আগে কাজ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানীকে বশে আনতে সরকার দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। কোম্পানীগুলোকে নূন্যতম মূল্যহার নির্ধারণ করা হলেও তা কোম্পানীগুলো তোয়াক্কা করছে না।
রেগুলেটরি কমিশনের দায়িত্ব ছিল ভোক্তা অধিকার রক্ষা করা এবং বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসা। এখন দেখা যাচ্ছে, বিনিয়োগের প্রফিট মার্জিন এত বেশি রাখা হয়েছে যে এখানে বিনিয়োগের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। দুর্নীতির জন্য প্রকৃত দামের চেয়ে দুই থেকে আড়াই গুণ দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সভাপতি ও অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, কোম্পানীসংশ্লিষ্টরা চায় জ্বালানি খাতে পরিকল্পিত হস্তক্ষেপ কমুক ও বাজার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকুক। মূল প্রবন্ধের উদ্বৃতি দিয়ে তিনি বলেন, গত ১১ বছরে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বেড়েছে ১১৮ শতাংশ। এই পাইকারি দাম বৃদ্ধি প্রভাব ফেলেছে ভোক্তাপর্যায়ে। এখানে কুইক রেন্টালসহ বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকৃত খরচ কেউ জানে না।
সরকার বিদ্যুৎ খাতে একটি ইনডেমনিটি আইন করেছে–যেটি গ্রহণযোগ্য নয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মলয় ভৌমিক বলেন, যে সম্পদের মালিক জনগণ সে সম্পদকে লুটেরা ও ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। কোম্পানীগুলোর বোর্ড সদস্যদের অনিয়মকে আমরা নিষ্ক্রিয় থেকে বৃদ্ধি করছি। নতুন সংযোগসহ বিদ্যুৎসংক্রান্ত সেবা পেতেও ভোক্তাদের ভোতান্তিতে পড়তে হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ক্যাবের মতামতকে উপেক্ষা করা হয়েছে তুলে ধরে তিনি ক্যাবকে ভবিষ্যত করণীয় নির্ধারণ করতে আহবান জানান।
দৈনিক বণিক বার্তার উপব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাংবাদিক মুসা মিয়া বলেন, বিদ্যুতের দাম বাংলাদেশে কতকম রাখা যায় তা নিয়ে ভোক্তাপর্যায় থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ত করার আহবান জানান। দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, তারা বেশিমূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে স্বল্পমূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। তিনি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভিয়েতমানের কথাও উল্লেখ করে বাংলাদেশকে শিক্ষা নেওয়ার আহবান জানান।
সভাপতির বক্তব্যে গোলাম রহমান বলেন, আমাদের জ্বালানি খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। যতক্ষণ না সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় ততক্ষণ আমাদের সোচ্চার থাকতে হবে। শুধু ক্যাবকে কথা বললে হবে না সকলকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
ওয়েবিনারে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, গণমাধ্যমের সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মি ছাড়াও ক্যাবের জেলা পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।