।। বিশেষ প্রতিনিধি ।।
মোবাইল অ্যাপসভিত্তিক পরিবহন সেবা ‘পাঠাও’য়ের বিরুদ্ধে নানামুখী অভিযোগ উঠেছে। ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেয়া ছাড়াও অভিযোগ উঠেছে তাদের সেবার মান নিয়েও। ভাড়া নির্ধারণ ও অর্থ আদায়ে প্রতারণার অভিযোগও তুলেছেন অনেক ভোক্তা।
মোবাইলে চালু করা পাঠাও অ্যাপ-এর মাধ্যমে গ্রাহকের ফোনে থাকা এসএমএস, ফোন নম্বর (কনট্যাক্টস), অ্যাপ তালিকার মতো ব্যক্তিগত তথ্য পাঠাও তাদের সার্ভারে সংগ্রহ করছে। মেসেজের মতো গুরুত্বপূর্ণ একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় বাণিজ্যিক কোম্পানির সার্ভারে সংরক্ষণের বিষয়ে ভোক্তারা আতঙ্কিত। ব্যক্তির ফোন নম্বরের তালিকা কেন কোম্পানিটি সংগ্রহ করছে, এ নিয়েও প্রশ্ন গ্রাহকদের। তাছাড়া এসব তথ্য বেহাত হতে পারে, এগুলো বিশ্লেষণ করে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন অধিকাংশ ব্যবহারকারী। ‘ডিলিট পাঠাও’ শীর্ষক হ্যাশট্যাগ ক্যাম্পেইনও শুরু হয়েছে।
তথ্য সংরক্ষণের অভিযোগের সূত্র ধরে পাঠাওয়ের সেবা নিয়েও উঠেছে বিস্তর অভিযোগ। কোম্পানিটি প্রতিনিয়ত গ্রাহকদের ঠকাচ্ছে মর্মে অভিযোগ তুলেছেন ভোক্তারা। গন্তব্য ও দূরত্ব একই হওয়া সত্ত্বেও এককে সময় একেক রকম দূরত্ব দেখায় এবং ভাড়াও কাটে একেক রকম। কোম্পানির পক্ষ থেকে যে অফার বা মোশনাল ছাড় দেয়া হয়, সেখানেও রয়েছে কারসাজি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভোক্তারা লিখেছেন, একই গন্তব্যে একই দূরত্বে ভাড়া কমবেশ হওয়ার কোন কারণ না থাকলেও প্রতিদিন নিঋষ্ট সময়ে একমই গন্তব্যে যাওয়ার বেলায় ভাড়ার হার ভিন্ন ভিন্ন দেখায়। তাছাড়া কোম্পানিটি ৬০% ছাড়ের মেসেজ পাঠালেও পরে দেখা যায় ২০০ টাকার ভাড়ায় মাত্র ৪০ টাকা ছাড় দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে মেসেজে ৪০ টাকার কথা উল্লেখ থাকে, কিন্তু ৬০% দেখে ভোক্তা বিভ্রান্ত হন।
আহমদ মোস্তফা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পাঠাও কি থার্ড পার্টির কাছে ভোক্তাদের ইনফর্মেশন বেচে কোন ধরণের টাকা কামানোর ধান্ধা করছে? নাকি তাদের আরো বড় কোন ধরনের উদ্দেশ্য আছে?’ জবাবে তিনি লিখেছেন, আপনার ম্যাসেজ এবং কনটাক্ট লিস্টে এমনসব তথ্য থাকে যা দিয়ে আপনি মানুষ হিসেবে কেমন, আপনার সোশ্যাল এবং ফাইনান্সিয়াল স্ট্যাটাস কিরকম খুবই রিজনেবল একুরেসি দিয়ে বলে দেওয়া সম্ভব।
উদাহরণ দিয়ে তিনি লেখেন, ফোনের কনটাক্ট লিস্ট, মেসেজ লিস্ট ও অ্যাপস লিস্টের সাহায্যে ব্যক্তি কোথায় পড়াশুনা করেছেন, কোথায় কোথায় যান, তার ফ্রেন্ড সার্কেল কিরকম, তিনি দামী রেস্টুরেন্টে গিয়ে খান নাকি সাশ্রয়ী রেস্টুরেন্টে খান, তার ব্যাংকে কত টাকা জমা হচ্ছে, কত টাকা উঠানো হচ্ছে, ক্ষমতা কাঠামোয় ওই ব্যক্তির গুরুত্ব কেমন, কি ধরনের অফারে তিনি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখান, এসব কিছু ডাটা মাইনিং করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বলে দিতে পারবে। সিলেটের তথ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আশিক ইশতিয়াকের প্রচার করা একটি কারিগরি ভিডিওর সূত্র ধরে পাঠাওয়ের বিরুদ্ধে প্রথম এ ধরনের অভিযোগ ওঠে এবং পরবর্তীতে ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়।
ভিডিওটি ব্যাপক প্রচার পেলে তার সূত্র ধরে ভোক্তারা নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতে থাকেন। জাহান সাফল্য লিখেছেন, ‘এমনকি একবার চার্জ দেখে তারপর প্রমো কোড এপ্লাই করুন আর চার্জ দেখুন ৷ দেখবেন অদ্ভুত ভাবে ভাড়া বেড়ে গেছে। যেখানে ৬০ কমার কথা, মূল ভাড়া বাড়িয়ে কমবে ২০ টাকা।’ সুদীপ্ত বিশ্বাস বিভু প্রত্যুত্তরে লিখেছেন, ‘আমি কাল স্ক্রিনশট মেরে ওদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিলাম। রিপ্লাই নাই।’ তিনি আরও লেখেন, ‘কাল আমি বাড্ডা লিংক রোড থেকে বাংলামোটর যাই। ভাড়া দেখালো একটা আর ট্রিপ শেষে পে করলাম এর চাইতে বেশি। মাঝখানে কারওয়ান বাজারে রেলক্রিসিং এ জ্যামে পড়ি দশ মিনিট। হুদাই আমার কাছ থেকে বিশ টাকা বেশি নেয়। অথচ আগে এইরকম ছিলনা। এক সপ্তাহ যাবত হচ্ছে এইসব।’
জানা গেছে, কারওয়ানবাজার থেকে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার দূরত্ব (জিএফএক্স) সাড়ে সাত কিলোমিটারের মতো। কাজের প্রয়োজনে একজন যাত্রী প্রায়ই অ্যাপভিত্তিক একটি রাইড শেয়ার করে যাতায়াত করেন। কিন্তু কখনও দূরত্ব ৭.৮২ কিলোমিটার, কখনও ৭.৩০ আবার কখনও বা ৩.২৭ কিলোমিটার দেখায়। এর ফলে ভাড়ার তারতম্য দেখা যায়। তবে অধিকাংশ সময় ভাড়া বেড়ে যায়। বেশিরভাগ এলাকার নিয়মিত পাঠাও ব্যবহারকারীরা এ ধরনের অভিযোগ তুলছেন।
পাঠাও অবশ্য বলছে, জিপিএস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সিস্টেম হওয়ায় অনেকসময় তা ঠিকমত কাজ না করতেও পারে। এজন্য ভাড়া এদিক-সেদিক হয়। জিপিএসের কাঁধে দায় চাপানোর পাশাপাশি তথ্য সংরক্ষণের অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটি অস্বীকার করেছে। পুলিশ ইতোমধ্যে তথ্য সংরক্ষণের অভিযোগটি তদন্ত করছে। কিন্তু ভোক্তা পাঠাওয়ের সেবা নিতে গিয়ে প্রতিদিন যেসব প্রতারনার অভিযোগ তুলছেন, সুগুলো সমাধানের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
এ ক্ষেত্রে ভোক্তাদের সহায়তার সুযোগ রয়েছে বলে জানান ক্যাব-এর ভোক্তা অভিযোগ কেন্দ্র : কল সেন্টারের ম্যানেজার অরুণিমা ইসলাম। ভোক্তারা যদি পাঠাওয়ের বিরুদ্ধে প্রমাণসহ অভিযোগ পাঠান তাহলে কল সেন্টারের সহায়তায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে সেই অভিযোগ দুই সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পত্তি করা হবে। অভিযোগ প্রমাণ হলে ভোক্তা প্রতিকার/ক্ষতিপূরণ পাবেন। এজন্য ভোক্তারা সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে কল সেন্টারের ০১৯৭৭০০৮০৭১ বা ০১৯৭৭০০৮০৭২ নম্বরে ফোন করে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন বলে জানান তিনি।