ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: পুরান ঢাকার খাজা দেওয়ান দ্বিতীয় লেন। বাড়ি নম্বর ৫৩/২। এ বাড়ির নিচতলায় রিজার্ভ ট্যাংকির ওপর দুটি মোটর লাগানো। এর মধ্যে একটি মোটর ওয়াসার লাইন থেকে পানি টেনে রিজার্ভে রাখে। আরেকটি মোটর রিজার্ভ থেকে ছাদে পানির ট্যাংকিতে ওঠাতে ব্যবহার হয়।
ওই বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী শাহাজাহান বলেন, এই দুটি মোটর ব্যবহারে প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল বাবদ গড়ে তিন হাজার টাকা গুনতে হয়। ওয়াসার সরবরাহ করা পানি যদি সরাসরি রিজার্ভে চলে আসতো তাহলে এত পরিমাণ বিদ্যুৎ বিল আসতো না। এর বাইরে ওয়াসার পানির বিলতো আছেই। সব মিলে এই চাপ ভাড়াটিয়াদের ওপর গিয়ে পড়ে।
মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের ৪৫/৫ নম্বর হোল্ডিং। বাড়িটির নিচতলায় সিঁড়ি ঘরের নিচে তিনটি মোটর লাগানো। এর মধ্যে দুটি মোটরই ওয়াসার লাইন থেকে পানি টেনে আনতে ব্যবহার হয় বলে জানিয়েছেন বাড়ির ব্যবস্থাপক হেদায়েতুল ইসলাম। তিনি বলেন, সাধারণত বর্ষা মৌসুমে পানির চাহিদা বেশি থাকে। কিন্তু সব সময় ওয়াসার লাইনে পানি পাওয়া যায় না। প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে ওয়াসা লাইনে পানি ছাড়ে। তখন সব বাড়ির মালিক একসঙ্গে পানি রিজার্ভে নিতে মোটর ছাড়েন। এতে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না। তাই ওয়াসার লাইনের সঙ্গে দুটি মোটর লাগানো হয়েছে। পানি সংগ্রহ করতে তেমন সমস্যা হয় না। যদিও এ জন্য বিদ্যুৎ বিল বেশি দিতে হয়।
উত্তর বাড্ডার ২১৪ নম্বর বাড়ি। আটতলা বাড়িটির ১৬টি ফ্ল্যাটে ভাড়াটিয়া থাকেন। তাদের জন্য দিনে চারবার রিজার্ভ থেকে পানি টেনে ছাদে ওঠান বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী সামছুল আলম। তিনি বলেন, শীতকালে দিনে তিনবার পানি ওঠাই। কিন্তু গ্রীষ্মকালে পানির চাহিদা বেশি থাকে। এই পানি আবার ওয়াসার লাইন থেকে টেনে আনতে হয়। অনেক সময় মধ্যরাতে বা ভোরে ওয়াসার লাইনে পানি আসে। তখন সারারাত পানি টেনে আনার জন্য বসে থাকতে হয়।
ওয়াসার পানি সংগ্রহের এ পদ্ধতি পুরো ঢাকা শহরেই। প্রতিটি বাড়িতে ওয়াসার লাইন থেকে পানি টেনে আনতে আলাদা মোটর রয়েছে। এতে দ্বিগুণ বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে। বাড়ির মালিকদের অভিযোগ, অধিকাংশ সময় ওয়াসার লাইনে পানি থাকে না। মোটর দিয়ে টেনেও পানি পাই না। ওয়াসার লাইন থেকে যদি সরাসরি বাড়ির রিজার্ভ ট্যাংকির পানি চলে আসতো তাহলে ভোগান্তি কমতো। এখন পানি টেনে আনতে দ্বিগুণ বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে। আবার এক-দুই বছর পরপরই পানির বিল বাড়াচ্ছে ওয়াসা। কিন্তু সে অনুযায়ী নাগরিকরা সেবা পাচ্ছে না।
তবে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান বলেন, এখন ঢাকা শহরে পানি সরবরাহে নেটওয়ার্ক পদ্ধতি নতুন করে সাজাচ্ছে ওয়াসা। ডিস্ট্রিক্ট মিটার এরিয়া বা ডিএমএ নামে একটি নেটওয়ার্ক পদ্ধতির কাজ চলছে। সে কাজের দুই-তৃতীয়াংশ শেষ হয়েছে। এটির কাজ পুরোপুরিভাবে শেষ হলে নাগরিকদের আর পানি টেনে রিজার্ভ ট্যাংকিতে নিতে হবে না। ওয়াসার লাইন থেকে পানি গড়িয়ে রিজার্ভে যাবে। ডিএমএ-এর কাজ যেসব এলাকায় শেষ হয়েছে, সেখানে এই সেবা পাচ্ছেন নাগরিকেরা।
আজিমপুর চায়না বিল্ডিং গলিতে ছয় বছর আগে একটি ছয়তলা ভবন নির্মাণ করেন রুহুল আমিন মিয়াজি। সম্প্রতি আলাপকালে তিনি জানান, বাড়ি নির্মাণের আগ থেকেই তার হোল্ডিংয়ে পানির সংযোগ ছিল। ওই সংযোগ থেকে নিয়মিত পানি পাওয়া যেত না। বাড়ি নির্মাণের সময়ও তীব্র পানি সংকটে পড়তে হয়েছিল। এখন ওয়াসা আজিমপুর এলাকায় পানির নতুন লাইন (ডিএমএ) বসিয়েছে। এখন পানির সংকট নেই। তবে বাড়ির রিজার্ভে আগের মতোই পানি টেনে আনতে হচ্ছে।
দেশে বিদ্যুতের মতো পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গ্যাসের দাম। এমন উচ্চমূল্যের গ্যাস পুড়িয়ে ওয়াসার পানি ফুটিয়ে তারপর পান করা হয়। কেউ কেউ আছেন, যারা ফুটানো পানি পুনরায় ফিল্টার করে নেন। তা না হলে ওয়াসার সরবরাহ করা পানি কেউ সরাসরি পান করলে ডায়রিয়ারসহ অন্য রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
২০১৯ সালে ঢাকা ওয়াসার অনিয়ম-দুর্নীতি ও গ্রাহকসেবার বিভিন্ন ঘাটতির দিক নিয়ে ‘ঢাকা ওয়াসা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসা পাইপলাইনের মাধ্যমে সুপেয় পানি সরবরাহে ব্যর্থ। ৯১ শতাংশ গ্রাহক পানি ফুটিয়ে পান করেন। পানি ফুটিয়ে পানের উপযোগী করতে বছরে ৩২২ কোটি টাকার গ্যাস খরচ হয়। অর্থাৎ, ওয়াসা যদি পানের উপযোগী পানি সরবরাহ করতো তাহলে এত বিপুল অর্থের গ্যাস সাশ্রয় হতে পারতো।
যদিও ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘নগরবাসীর চাহিদা-ঢাকা ওয়াসার সক্ষমতা’ শীর্ষক এক সংলাপে ওয়াসার এমডি ভুল স্বীকার করেন। জানান, তার বাসার পানিতেও দুর্গন্ধ থাকে। এর আগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি দাবি করেছিলেন, ওয়াসার সরবরাহ করা পানি বিশুদ্ধ।
রামপুরায় উলন রোডের বাসিন্দা জসিম উদ্দিন। চার বছরের বেশি সময় ধরে এ এলাকায় পরিবার নিয়ে বাস করেন তিনি। আলাপকালে তিনি বলেন, শুষ্ক মৌসুমে ওয়াসার পানি বেশি নোংরা থাকে। পানিতে বিভিন্ন ধরনের ময়লা আসে। অনেক সময় পানির রং পরিবর্তন হয়ে যায়। আবার গ্রীষ্মকালে পানি কিছুটা ভালো থাকে। কিন্তু তারপরও এই পানি সরাসরি পান করার মতো থাকে না। গ্যাস পুড়িয়ে পানি ফুটাই। তারপর আবার ফিল্টার করে পান করি। এই পানির পিছনেই মাসে হাজার হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে। অথচ দেশে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পর গ্যাসের দামও বেড়েছে।
দেশের নাগরিকদের অধিকার আদায়ে কাজ করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির বাজার বিশ্লেষক কাজী আব্দুল হান্নান বলেন, নাগরিকেরা অর্থ পরিশোধ করে ওয়াসার পানি কিনছে। সেই পানি আবার লাইন থেকে আলাদা মোটর দিয়ে টেনে আনতে হচ্ছে। আবার ওয়াসার পানি ফুটিয়ে পান করতে হচ্ছে। এতে নাগরিকের বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল বেশি দিতে হচ্ছে, এটা অন্তত দুঃখজনক। এর মধ্যে আবার গ্যাস ও বিদ্যুৎতের দামও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ওয়াসাকে কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে।
সৌজন্যে, জাগো নিউজ।