ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: প্রতি বছর রমজানে অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি চাহিদা বাড়ে বিভিন্ন ধরনের মসলার। এর আড়াই মাস পর ঈদুল আজহায় চাহিদা থাকে তুঙ্গে। রোজা আসতে বাকি এখনো এক মাসের বেশি সময়। এরই মধ্যে চড়া মসলার বাজার। কোনো কোনো মসলার দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। তবে কারণ হিসেবে রমজান কিংবা চাহিদা বাড়ার চেয়ে আন্তর্জাতিক বাজার ও ডলারের দামকে বেশি দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের সংকট ও অতিরিক্ত মূল্য মসলার দাম বাড়ার ক্ষেত্রে বেশি প্রভাব ফেলছে। দামের কারণে কমেছে মসলার আমদানি ও বিক্রি। আবার আমদানি মসলার দাম বাড়ায় এর প্রভাব পড়েছে দেশে উৎপাদিন অন্য মসলার ওপর। অন্য পণ্যের দামও বাজারে বেশি থাকায় অনেকে মসলা কেনাও কমিয়ে দিয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ডিউটি কমানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন আমদানিকারকরা।
রামপুরা কাঁচাবাজারে গরম মসলা ব্যবসায়ী হাসান মিয়া আগে প্রতি কেজি জিরা বিক্রি করতেন ৪শ টাকায়। এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় এ মসলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭০০ টাকা। তিনি একশ গ্রামের প্যাকেটে জিরা বিক্রি করছেন ৭০ টাকা দরে।
তিনি বলেন, শুধু জিরা নয়, একমাস ধরে মরিচের গুঁড়া, হলুদ, লবঙ্গ ও জয়ত্রীর দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। মরিচ গুঁড়া এখন আড়াইশো থেকে বেড়ে ৫শ টাকা হয়েছে। শুকনো মরিচের দামও বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।
একই অবস্থা হলুদের। কাঁচা হলুদের দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতি কেজি হলুদ গুঁড়ার দাম বেড়েছে প্রায় একশ টাকা। এখন হলুদ বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ২৪০-২৮০ টাকায়।
একইভাবে লবঙ্গ ও জয়ত্রীর দাম দেড় থেকে দুই গুণ বেড়েছে। বাজারে প্রতি কেজি লবঙ্গ এখন ১২শ থেকে ১৪শ টাকা এবং জয়ত্রী ১৭শ থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছে।
রাজধানীর চকবাজারের একজন গরম মসলা আমদানিকারক আবুল কালাম বলেন, এক মাস আগে কয়েক পদের মসলার জন্য এলসি খুলেছি। তখন ডলারপ্রতি খরচ হয় ১১২ টাকা। এলসির টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে এমন খরচ হয়েছে। ডলারের এই বাড়তি দাম মসলার দাম বাড়ার প্রধান কারণ।
কালাম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারেও মসলার দাম বেড়েছে। এজন্য আমদানি কমছে। সরবরাহ সংকটে দাম বেড়ে গেছে। অতিরিক্ত দামের কারণে কমেছে মসলা বিক্রিও। রমজানেও এ নিম্নমুখী ভাব থাকবে। অন্য পণ্যের দাম চড়া হওয়ার কারণে মানুষ মসলার ব্যয় কমিয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ পাইকারি গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এনায়েত উল্লাহ বলেন, ডলারের দাম বাড়ায় মসলা ব্যবসায়ীরা দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মসলার এলসি ও নিষ্পত্তিতে খরচ বেড়েছে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত। এছাড়া মসলার ক্ষেত্রে ডলারের দামের ওপর ভিত্তি করে আমরা ডিউটি দিচ্ছি। সেখানে রেট ধরা হচ্ছে ১০৮ টাকা প্রতি ডলার। যেটা আগে ৮৪ টাকা ধরা হতো। এ রেটের কারণে ডিউটি বাড়ছে ২০ শতাংশের বেশি।
তিনি বলেন, গরম মসলার ক্ষেত্রে প্রকারভেদে উচ্চ কাস্টমস ট্যারিফ নির্ধারিত রয়েছে। অর্থাৎ, আমি যে দামেই জিরা কিনি না কেন, জিরার ক্ষেত্রে ১৯শ ডলার মূল্য ধরে কাস্টমস ট্যারিফ নির্ধারিত হবে। সেটা হবে ডলারের চলমান রেটে। অর্থাৎ, আগে যেটা ৮৪ হাজার টাকা ডিউটি হতো এখন সেটা বেড়ে হয়েছে এক লাখ আট হাজার টাকা।
এই ব্যবসায়ী জানান, মসলার ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ থেকে শুরু করে ১১০-১২০ শতাংশ পর্যন্ত ডিটটি নির্ধারিত হয়েছে। এটা বেশি।
এনায়েত উল্লাহ বলেন, এসব বিষয়ে আমরা সরকারকে বারবার বলেছি। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে বৈঠকেও বলেছি। কিন্তু কোনো সুফল পাইনি। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সমস্যার কারণেই মসলার দাম বাড়ছে।
দেশে গরম মসলা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় সামাজিক ও করপোরেট অনুষ্ঠান এবং হোটেল-রেস্তোরাঁয়। এছাড়া ঘরে ঘরে বেশ কিছু মসলা প্রতিদিন ব্যবহার হয়। এর মধ্যে দেশে সাত ধরনের গরম মসলার চাহিদা বেশি। এগুলো হলো- এলাচ, জিরা, দারুচিনি, লবঙ্গ, গোলমরিচ, জায়ফল ও জয়ত্রী। তবে এসব মসলা পুরোপুরিই আমদানিনির্ভর। দেশে মসলার মধ্যে তেজপাতা ও ধনিয়া উৎপাদন হচ্ছে।
যেকোনো সময়ের তুলনায় দেশে আদা, রসুন ও শুকনা মরিচের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, দেশে গত এক বছরের ব্যবধানে রসুনের দাম ১৪০ শতাংশ, আদার দাম ১৫০ শতাংশ এবং শুকনা মরিচের দাম ১৪৮ শতাংশ বেড়েছে।
যদিও টিসিবির এ দামের ব্যবধানের চেয়ে সরেজমিনে নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা আরও বেশি দেখা যায়। খুচরা বাজার ঘুরে প্রতি কেজি দেশি রসুন ১৬০-১৮০ ও আমদানি করা রসুন ২০০-২২০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এছাড়া দেশি আদা ১২০-১৪০ টাকা ও আমদানি করা আদা ২৮০-৩০০ এবং দেশি ও আমদানি উভয় মরিচ ৪৬০-৫২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে গত এক দশকের ব্যবধানে আদার চাহিদা পাঁচগুণ, রসুনের তিনগুণ বেড়েছে। তবে উৎপাদন না বাড়ায় পণ্যগুলোর আমদানিনির্ভরতা কমছে না। অন্য পণ্যের মতোই ডলার সংকটে বাড়ছে এগুলোরও আমদানি খরচ। ভোক্তার পকেট থেকেও যাচ্ছে বাড়তি টাকা।
এসব বিষয়ে পুরান ঢাকার শ্যামবাজারকেন্দ্রিক মসলাজাতীয় পণ্যের আমদানিকারক ও বিক্রেতা আবদুল মাজেদ বলেন, দেশি আদা-রসুনের চেয়ে এখন বিদেশির (আমদানি) চাহিদা বেশি। সেখানে ডলার সমস্যা। যে কারণে কখনো আনতে সংকট হলেই দাম বেড়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, দেশি জাতের আদা-রসুন ছোট। সেগুলো এখন মানুষ কম খায়। মানুষ বড় আকারের আদা-চীনা রসুন কিনতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সেগুলো সহজে কাটা-বাটা যায়। নির্ঞ্ঝাট মনে করে। ফলে এগুলোর চাহিদা থাকবেই। সে কারণে বাজারে দেশি আদা-রসুন দাম পায় না। কম দামেও ক্রেতারা কিনতে চান না। যার প্রভাব পড়ে বাজারে।
সৌজন্যে, জাগো নিউজ।