ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: দেশের চিনির বাজার এখনো অস্থিতিশীল। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামেই চিনি কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। এমনকি ২৬ ফেব্রুয়ারি চিনি আমদানিতে যে শুল্ক প্রত্যাহার হয়, তারও কোনো সুফল মিলছে না। ওই সময় আমদানি করা অপরিশোধিত চিনির ওপর থেকে কেজিপ্রতি সাত টাকা এবং পরিশোধিত চিনি থেকে ১০ টাকা শুল্ক প্রত্যাহার হয়। তারপরও বেশি দামে চিনি বিক্রি হতে দেখা যায়।
বাজারের পণ্যমূল্যের হিসাব সংরক্ষণ করা সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, গত এক বছরের ব্যবধানে চিনির দাম বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। গত বছরে (২০২২) এই সময় দেশে প্রতি কেজি চিনি ৭৮-৮০ টাকার মধ্যে পাওয়া যেত। অথচ এই প্রতিবেদন লেখার সময় রাজধানীর বাজারে খোলা চিনি বিক্রি হতে দেখা গেছে ১২০ টাকায়। আর প্যাকেটজাত চিনি ১৪০ টাকায়। যদিও সরকার নির্ধারিত দরে প্রতিকেজি খোলা চিনি ১০৭ টাকা এবং প্যাকেট চিনি ১১২ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা।
এদিকে সামনে রমজান মাস। এসময় দেশে চিনির চাহিদা বেড়ে যায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, রোজার মাসে চিনির চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় আড়াই থেকে তিন লাখ টন। আর এই সুযোগটা লুফে নেন দেশের ব্যবসায়ীরা। ফলে এখন রমজানকে কেন্দ্র করে অধিক মুনাফা প্রত্যাশী ব্যবসায়ীরা চিনির বাজারে বাড়তি সুবিধা নিচ্ছেন। শুরুতে দাম নিয়ন্ত্রণে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু তৎপরতা দেখা গেলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা শিথিল হয়ে যায়। ফলে আসন্ন রমজানে স্বাভাবিক দরে চিনি খাওয়া যাবে না এমন শঙ্কা রয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের মাঝে।
এদিকে চিনির বাজারে অস্থিরতার জন্য একে অপরকে দোষারোপ করছেন ব্যবসায়ীরা। মিল মালিকরা বাজার সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন। আর বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিলগেট থেকেই তাদের বেশি দামে চিনি কিনতে হচ্ছে।
এরমধ্যে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে দেশে ডলার ও জ্বালানি সংকট দেখা দেয়। এ কারণে গত বছরের (২০২২) জুলাই থেকে অস্থিরতা দেখা দেয় চিনির বাজারে। এ অবস্থায় একই বছরে সেপ্টেম্বরে সরকার প্রথমবারের মতো চিনির দাম বেধে দেয়। এরপর তিন দফা দাম বাড়ায় সরকার। তারপরও দাম নিয়ন্ত্রণে না আসায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কমায় এনবিআর। এছাড়া প্রতি টন অপরিশোধিত চিনি আমদানির ওপর তিন হাজার টাকা ও পরিশোধিত চিনিতে ছয় হাজার টাকা আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করে সংস্থাটি। যার প্রভাব পড়ার কথা খালাস করা চিনিতে। অর্থাৎ দাম কমার কথা।
দেশে মূলত সিটি গ্রুপ তীর ব্র্যান্ডে, মেঘনা গ্রুপ ফ্রেশ ব্র্যান্ডে, আব্দুল মোনেম গ্রুপ ইগলু ব্র্যান্ডে বাজারজাত করে চিনি। এছাড়া টিকে গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপ চিনির ব্যবসা করে।
চিনির দামের বিষয়ে দেশবন্ধু গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, নতুন যে চিনি আসবে সেগুলোতে শুল্ক প্রত্যাহারের সুবিধা পাওয়া যাবে। এখন সেগুলো আসছে। রমজানের বাজার স্থিতিশীল রাখতে এ কাজটা যদি সরকার আরও তিনমাস আগে করতো তবে ঠিক সময় সুফল মিলতো।
তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে চিনির দাম আরও বেড়েছে। এছাড়া কোনো সন্দেহ নেই, দেশেও এখন চিনির দাম বেশি। এর কারণ মার্কেটিং, মানুষ মনে করছে ডলার ক্রাইসিস, দাম বাড়তে পারে সবকিছু মিলে একটা সমস্যা। তারপরও মিলগেটে কিন্তু চিনির দাম বাড়েনি। সরকারি দামেই বিক্রি হচ্ছে। উল্টো গত কয়েকদিনে কমেছে দুই টাকা।
গোলাম মোস্তফা বলেন, মার্কেটিংয়ের সমস্যায় সেই সুফল ভোক্তারা পান না। ট্রেডারদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তারা মিল থেকে নিয়ে মার্কেটে বেশি দামে বিক্রি করে। এমন নিত্যপণ্য শুধুমাত্র ডিলারদের মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা করা উচিত। যেভাবে সরকার সারের মূল্য ঠিক রাখে। তাহলে কোথায় দাম বাড়ছে সেটা ধরা যাবে।
এদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারের বেধে দেওয়া দামে তারা পাইকারি বাজার থেকে চিনি কিনতে পারছেন না। আর পাইকারি বাজারের বিক্রেতারা বলছেন, তারাও নির্ধারিত দামে মিলগেট থেকে চিনি কিনতে পারছেন না।
এদিকে আসন্ন রমজানে চিনির কোনো সংকট হবে না বলে জানিয়েছে সরকার। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (পিএমও) জনসাধারণকে আতঙ্কিত হয়ে বাড়তি কেনাকাটা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, সরকার চিনি আমদানির কর কমানোয় এবং ট্যারিফ ভ্যালু তুলে দেওয়ায় রমজানে চিনির মূল্য কম থাকবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৮-২০ লাখ টন। রোজায় এ চাহিদা আরও বেড়ে যায়। অথচ দেশে সব মিলিয়ে উৎপাদিত হয় মাত্র ৩০-৩৫ হাজার টন। শুধু রোজার মাসে চিনির চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় আড়াই থেকে তিন লাখ টন। দেশে উৎপাদন না থাকায় চাহিদার বড় অংশই জোগান দেওয়া হয় আমদানির মাধ্যমে।