ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: সংকট তৈরি করে চিনির দাম বাড়ানো হয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে খোলা চিনির দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। আর প্যাকেটজাত চিনি প্রায় উধাও হয়ে গেছে।
বাজার পর্যবেক্ষণে লক্ষ্যকরা গেছে, চিনির সংকট যেমন সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে উদ্বেগ উৎকন্ঠা তৈরি হয়েছে, তেমনি খাদ্যপণ্য তৈরিতেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। ক্রেতারা বলছেন, জনগণকে জিম্মি করে ব্যবসায়ীরা খেলায় মেতেছেন। তারা সরকারের কোনো নিয়ম-নীতি মানছে না। নিজেদের ইচ্ছা মতো দাম বাড়াচ্ছে। আর ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সঙ্কটের কারণে তাদের উৎপাদন কমেছে। যার জন্য বাজারে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
পাইকারি বাজারে টাকা দিয়েও মিলছে না চিনি। চাহিদার অনুপাতে যোগান কম হওয়ায় চরম সংকট তৈরি হয়েছে চিনির সরবরাহ চেইনে। এতে হু হু করে বাড়ছে অন্যতম এ ভোগ্যণ্যের দাম। ১০ দিনের ব্যবধানে প্রতি মণ চিনিতে বেড়েছে ৩০০-৩৫০ টাকা।
বাজার পর্যবেক্ষণে লক্ষ্য করে গেছে, সরকার গ্যাসে রেশনিং করার কারণে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ কমায় চিনির উৎপাদনে ধস নেমেছে। আবার নিত্যপণ্যের বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার টিসিবির জন্য চিনি সংগ্রহ করছে স্থানীয় বাজার থেকে। এতে চাহিদা ও জোগানে ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। ডলার সংকটে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও বাজারে মূল্য না পেয়ে লোকসানের অযুহাতে সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার অভিযোগও আছে উৎপাদকদের বিরুদ্ধে। গ্যাসের সংকট বাদেও ডলার সংকটসহ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি এবং আমদানিতে শুল্ক বেশি হওয়া চিনির দাম বাড়ার প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।
ক্যাবের সরেজমিন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, রাজধানীর বেশির ভাগ দোকোনে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা কেজিতে। এক সপ্তাহ কিংবা তিনদিন আগের কেনা চিনি কিছু কিছু দোকানে বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১০৫ টাকা কেজিতে। তবে এ সময় বাজার ও দোকানগুলোতে প্যাকেটজাত চিনির দেখাই মেলেনি। পাড়া-মহল্লার এসব দোকানগুলোতে এক সপ্তাহ আগেও চিনি বিক্রি হয়েছে ৯০-৯৫ টাকা কেজিতে। আর প্যাকেটজাত চিনি ছিল ৯৫ টাকা কেজি।
অথচ গত ৬ অক্টোবর সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খোলা চিনি ৯০ টাকা এবং প্যাকেটজাতের দাম ৯৫ টাকায় বিক্রির জন্য দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু তা বাস্তবে কার্যকর হয়নি। বরং এখন উল্টো দাম বাড়ছে।
তার আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর খোলা চিনির দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮৪ টাকা আর প্যাকেটজাত ৮৯ টাকা। নির্ধারিত দামে চিনি সরবরাহ না দেওয়ায় দাম বাড়াতে বাধ্য হয় সরকার। কিন্তু সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে চিনি।
সরকারি তথ্য মতে, দেশে চিনির মোট চাহিদার বড় একটি অংশ মেটানো হয় আমদানি করা চিনির মাধ্যমে। এই চিনি আমদানি হয় মূলত সিটি, মেঘনা, এস আলম, ইগলু ও দেশবন্ধু গ্রুপের হাত ধরে। এই ব্যবসায়ীরা এখন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের অজুহাতে চিনির দাম বাড়াচ্ছেন।
প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে চিনির সব ধরনের কাঁচামাল রয়েছে কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে চাহিদা অনুসারে চিনি উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এর সঙ্গে উৎপাদন খরচও বাড়ছে। এ কারণে চাহিদার তুলনায় চিনি সরবরাহ কম থাকায় চিনির দাম বাড়ছে।
দেশে প্রায় ২০ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় ১৫ চিনি কল থেকে বছরে আসে ৩০ হাজার টনের চেয়ে কম পরিশোধিত চিনি। যে কারণে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি করে নিজেদের কারখানায় রিফাইন করে বাজারের চাহিদা মেটানো হয়। পরিশোধনের জন্য প্রায় ২২ লাখ টনের বেশি ‘র’ সুগার আমদানি করে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, আবদুল মোনেম কোম্পানি, দেশবন্ধু সুগার এবং এস আলম সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ।
চিনির বাজারে প্রায় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি অংশীদারত্ব রয়েছে সিটি গ্রুপের, ৩১ শতাংশের বেশি বাজার রয়েছে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ চিনির। তাছাড়া আবদুল মোনেম কোম্পানির প্রায় ১১ শতাংশ, দেশবন্ধু সুগারের ৯ শতাংশ ও চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের রয়েছে ৯ শতাংশের মতো বাজার।
মৌলভী বাজারের একজন ডিলার অভিযোগ করেন, ১০০ টাকা কেজিতে ৫ বস্তা মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ চিনির অর্ডার দিয়েছেন ৫ দিন আগে। এরপর কোম্পানির আর কোনো খবর নেই। দাম বাড়ছে, এখন অর্ডার দিয়ে মাল পাচ্ছি না, আর যখন দাম কমবে জোর করে দিয়ে যায় কোম্পানিগুলো।
তিনি বলেন, কোম্পানির কাছে জানতে চাইলে কোম্পানি জানিয়েছে, গ্যাস সংকটের কারণে চিনির উৎপাদন কমে গেছে। আগের যেখানে দিনে ৫ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন হতো এখন ১ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন হচ্ছে। এ কারণে চাহিদা অনুসারে চিনি পাচ্ছি না।
প্রায় একই কথা বলছেন আমিন ব্রাদার্সের ডিলার আমিনুল। তিনি বলেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটের কারণে চিনির উৎপাদন কমেছে। যে চিনি একদিনে দেওয়া যেতো এখন সেই চিনি দিতে ৭ থেকে ৮ দিন সময় লাগে।
খাতুনগঞ্জের আড়তদার ও ডিও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১০ দিনের ব্যবধানে প্রতি মণ চিনির দাম বেড়েছে ৩০০-৩৫০ টাকা। আবার নগদ টাকা দিয়েও চাহিদামাফিক রেডি চিনি মিলছে না। ডিও কিনে কারখানার গেটে অবস্থানের পর মিলছে চিনি। এর মধ্যে এস আলমের চিনির ডিও কিনে কারখানা থেকে সরবরাহ পেতে দু-তিন দিন সময় লাগছে। চিনির বড় বাজার যাদের দখলে সেই সিটি ও মেঘনা গ্রুপের চিনি পেতে কারখানার সামনে অবস্থান করতে হচ্ছে ১৫ দিনের মতো। বিশেষ করে গ্যাস সংকটের কারণে কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় চিনিতে প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রামে খাতুনগঞ্জের ডিও ব্যবসায়ী মো. করিম বলেন, বর্তমানে বাজারে সামান্য কিছু রেডি চিনি রয়েছে। চাইলেও এক থেকে দুই টনের বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকায় দেশবন্ধুর রেডি চিনি থাকলেও প্রতি মণ ৩৭শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে শনিবার দুপুরে এস আলমের ডিও বিক্রি হয়েছে প্রতি মণ ৩ হাজার ৬৭০ টাকায়। এগুলো ইছানগর কারখানা থেকে ডেলিভারি নিতে দু-তিন দিন লাগছে। আবার ঢাকার সিটি ও মেঘনার চিনি ডেলিভারি পেতে লাগছে ১৫ দিনের মতো।
আরেক ডিও ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘শনিবার খাতুনগঞ্জে সিটি ও ফ্রেশ চিনির ডিও বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৪৭৫ টাকায়। কিন্তু ডেলিভারি অনেক দেরিতে। ১০ দিন আগেও বাজারে দাম ৩০০-৩৫০ টাকা কম ছিল। এখন বাজারে রেডি চিনি মিলছে না। চাইলেও টাকা দিয়ে এক ট্রাক রেডি চিনি ম্যানেজ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
ঢাকার চট্টলা ট্রান্সপোর্টের মালিক মিজানুর রহমান বলেন, ‘সিটি ও মেঘনা চিনি মিলে আজ (শনিবার) গাড়ি দিলে ডেলিভারি পাওয়া যাচ্ছে ৫ নভেম্বর। যারা এই সময় মানছেন তারা সিটি ও মেঘনা মিলে গাড়ি পাঠাচ্ছেন।’
খাতুনগঞ্জের চিনির আড়তদার ব্যবসায়ী ইমাম শরীফ ব্রাদার্সের মালিক মো. আকবর বলেন, ‘বাজারে চাহিদা অনুযায়ী যোগান না থাকলেও নিয়ম অনুযায়ীই দাম বেড়ে যাবে। আগে ঢাকার প্রত্যেক মিল দিনে ২শ গাড়ি করে চিনি ডেলিভারি দিতো। এখন তারা ৫০ গাড়িও দিতে পারছে না। কিন্তু মানুষতো চিনি খাওয়া ছেড়ে দেয়নি। চিনির চাহিদা কখনো কমবে না। যোগান কমে গেলেই সংকট তৈরি হবে। এখন বাজারে চিনির যোগান সংকট রয়েছে। তাছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানান বৈশ্বিক কারণেও চিনি আমদানিতে প্রভাব তৈরি করছে। ফলে বাজারে সংকট তৈরি হচ্ছে, দামও বাড়ছে।’
খাতুনগঞ্জে তেল-চিনির বড় ব্যবসায়ী আর এম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ জানান, ‘কারখানাগুলোতে গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় তারা চিনির উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। আগে দিনে ৫শ ট্রাক চিনি বাজারে আসতো। এখন দুইশ ট্রাকও আসছে না। যে কারণে চিনির সংকট তৈরি হচ্ছে, বাজারে দাম বাড়ছে।’
এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘শুধু গ্যাস সংকট নয়। সরকার টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকিমূল্যে বাজারে চিনি বিক্রি করছে। কিন্তু টিসিবি এসব চিনি সংগ্রহ করছে দেশি কারখানাগুলো থেকে। এতে চিনির যোগান সংকট কাটছে না। তারা বিদেশ থেকে চিনি আমদানি করে বাজারে ছাড়লে এ সংকট অনেকটা সামাল দেওয়া যেত।’
কথা হলে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি)র একেকটি কার্যাদেশ তিন-পাঁচ হাজার টনের হয়। টিসিবি কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমরা উন্মুক্ত টেন্ডারের মাধ্যমে চিনি সংগ্রহ করি। ট্রেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতার কাছ থেকে এসব চিনি সংগ্রহ করা হয়। বর্তমানে এস আলম, সিটি ও মেঘনা গ্রুপ থেকে চিনি সংগ্রহ করা হচ্ছে।’
বেসরকারি চিনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম কোম্পানির বাণিজ্যিক বিভাগের প্রধান আজিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, বর্তমানে কয়েকটি কারণে বাজারে দাম বাড়ছে। গ্যাসের কারণে কারখানার উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না। বর্তমানে যে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে তাতে ৫০ শতাংশ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে যোগানে সমস্যা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির বুকিং রেটও এখন বেশি। গত মাসে মাত্র একটি জাহাজ এসেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘এখন ডলার সংকটও আরেকটি কারণ। আমরা বিগত কয়েক মাসে কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়েছি।’
কোম্পানিতে চিনির কাঁচামালের কোনো সংকট নেই। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না হওয়ায় চিনি উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে মেঘনা গ্রুপের প্রধান বিক্রয় কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন আহমেদ জানান, কোম্পানিতে চিনির কাঁচামালের কোনো সংকট নেই। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় চিনি উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
তিনি জানান, কোম্পানির দিনে ৫ হাজার মেট্রিক টন চিনি পরিশোধনের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু পরিশোধন করছে মাত্র ১ হাজার টন। ফলে বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলেই বাজারে দাম স্বাভাবিক হবে বলে জানান তিনি।