এসএম আলমগীর: দেশের প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো পণ্যের ভোক্তা। সে অর্থে প্রায় ১৭ কোটি মানুষই ভোক্তা। এই ভোক্তার অধিকার রক্ষায় একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার নাম ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর’।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালকসহ মাত্র ১০১ জন কর্মকর্তা সামলান এই ১৭ কোটি ভোক্তাকে। সে হিসাবে ১৭ লাখ মানুষের জন্য রয়েছেন মাত্র একজন কর্মকর্তা। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে স্বল্প সংখ্যক কর্মকর্তা দিয়ে ভোক্তার অধিকার সুরক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য অধিদফতর থেকে জনবল বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। কিন্তু আজও তার কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে বাজার অভিযান থেকে শুরু করে অধিদফতরের প্রাত্যহিক কাজে চরম ব্যাঘাত ঘটছে।
অন্যদিকে কয়েক মাস আগে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতারণা ও ক্রেতা ঠকানোর কারণে ভোক্তা অধিদফতরের কর্মকর্তাদের ব্যস্ত থাকতে হয় ই-কমার্স নিয়ে। সে সময় অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় অনলাইনে পণ্য কিনে প্রতারিত হওয়া ক্রেতার অভিযোগ নেওয়া ও নিষ্পত্তিতে। তবে গত রোজার আগে থেকে ভোক্তা অধিদফতরের কর্মকর্তাদের পুরো নজর দিতে হয় নিত্যপণ্যের বাজারে। কারণ ভোজ্য তেলসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের মূল্য বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে, সেই সঙ্গে বেড়েছে ব্যবসায়ীদের নানা রকম প্রতারণা ও কূটকৌশলও। এ জন্য ভোক্তা অধিদফতরের কর্মকর্তাদের একেবারে মিল পর্যায় থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা বাজারে ব্যাপকহারে অভিযান চালাতে হয়। অধিফতরে বিদ্যমান যে জনবল রয়েছে তা দিয়েই সামলাতে হয় পরিস্থিতি। তবে এই সঙ্কটকালে ব্যবসায়ীরা যেভাবে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছে তাতে ভোক্তা অধিদফতর যদি একযোগে সারা দেশে ব্যাপকহারে অভিযান চালতে পারত তাহলে ব্যবসায়ীরা এতটা বেপরোয়া হতে পারত না বলে মনে করেন বাজার বিশ্লেষকরা। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির জনবল বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন তারা।
ভোক্তা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে মহাপরিচালকসহ প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা রয়েছেন ১৪ জন। এর মধ্যে পরিচালক ২ জন, উপ-পরিচালক ৪ জন, সহকারী পরিচালক ৬ জন এবং ১ জন সহকারী প্রোগ্রামার। বিভাগীয় কার্যালয়ে উপ-পরিচালক আছেন ৭ জন এবং সহকারী পরিচালক আছেন ১৬ জন। এ ছাড়া ৬৪ জেলায় ৬৪ জন সহকারী পরিচালক রয়েছেন। মূলত এই ১০১ জন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার মাধ্যমেই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সব ভোক্তার অধিকারের সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। কারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পরিচালক, উপ-পরিচালক এবং সহকারী পরিচালকরাই শুধু বাজারে অভিযান চালান এবং ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯-এর বিভিন্ন ধারা মতে অপরাধ ভেদে জরিমানা ও শাস্তি প্রদান করেন। তা ছাড়া ভোক্তার লিখিত অভিযোগ নেওয়া, শুনানি করা এবং শুনানি শেষে জরিমানা দায়েরের কাজও করেন এই কর্মকর্তারা।
যদিও অধিদফতরে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির মোট ১৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, কিন্তু তারা বাজারে অভিযান পরিচালনা করতে পারেন না। তারা শুধু ওই ১০১ কর্মকর্তার সহযোগী হয়ে কাজ করতে পারেন।
২০০৯ সালে ভোক্তা অধিদফতরের যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকেই এভাবে জনবল সঙ্কটে ধুঁকছে প্রতিষ্ঠানটি। জনবল সঙ্কট কাটাতে ২০১৯ সালে ২ হাজার ৬৫ জন জনবল নিয়োগের প্রস্তাব পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ে। তারও আগে ২৪০ জন জনবল নিয়োগের প্রস্তাব পাঠানো হয়। সব মিলে দুই দফায় ২ হাজার ৩০৫ জনের প্রস্তাব পাঠানো হলেও আজ অবধি নতুন করে কোনো জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অনেক দেন-দরবারের পর গত বছর ১৪৮ জন নন ক্যাডার অফিসারের পদ অনুমোদন হলেও আজও চূড়ান্ত হয়নি। পরে অবশ্য ১২ জন নন ক্যাডার অফিসার চূড়ান্ত নিয়োগ পেয়ে যোগদান করেছেন।
ভোক্তা অধিদফতরের জনবল সঙ্কটের বিষয়ে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ সময়ের আলোকে বলেন, অধিদফতরে জনবল নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অনেক কাজ এগিয়েছে, দ্রুতই ভোক্তা অধিদফতরে জনবল বাড়ানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের জনবল সঙ্কট আছে। তবে অধিদফতরের জনবল বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, আশা করব দ্রুত এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে।
তিনি আরও বলেন, জনবল সঙ্কট থাকলেও আমরা কিন্তু বসে নেই। দেশের মানুষ দেখছে এখন সারা দেশের বাজারে ভোক্তা অধিদফতর প্রতিদিন অভিযান চালাচ্ছে। এর সুফল অবশ্যই পাচ্ছেন ভোক্তারা। আমরা আমাদের যে জনবল রয়েছে তা দিয়েই রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছি।
তবে ভোক্তা অধিদফতরের অনেক কর্মকর্তাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে জানিয়েছেন, শুধু জনবল বাড়ালেই হবে না, কর্মকর্তাদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণেরও প্রয়োজন রয়েছে। কারণ বাজার অভিযানের সময় অনেক পণ্যের গুণাগুণ মান যাচাই করা লাগে। যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় এক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হয়। বিশেষ করে ই-কমার্স নিয়ে সঙ্কটের সময় উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে অধিদফতরের কর্মকর্তাদের। কারণ এর আগে কখনও এই জটিল পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়নি তাদের। এ বিষয়ে যথাযথ জ্ঞানও নেই কর্মকর্তাদের। অনেকটা ধারণার ওপর ভর করেই এ বিষয়ে কাজ করতে হচ্ছে অধিদফতরের কর্মকর্তাদের। চলমান ভোগ্যপণ্যের বাজারেও অভিযান চালাতে গিয়ে নানা রকম সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে।
ভোক্তা অধিদফতরের ভয়াবহ জনবল সঙ্কটের কারণে কী সমস্য হচ্ছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সময়ের আলোকে বলেন, দেশের ১৭ কোটি ভোক্তার অধিকার সরাসরি দেখভাল করার একমাত্র প্রতিষ্ঠান ভোক্তা অধিদফতর। ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ খুবই ভোক্তাবান্ধব আইন। এর সঠিক প্রয়োগ করা গেলে ভোক্তার অনেক অধিকার নিশ্চিত করা যাবে। কিন্তু অধিদফতরের জনবল সঙ্কটের কারণে এই আইনের সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তা। তাই প্রতিষ্ঠানটির জনবল বাড়াতে হবে। তা ছাড়া শুধু জনবল বাড়ালেই হবে না, ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় অধিদফতরকে আরও জোরালোভাবে সারা দেশে কার্যক্রম চালাতে হবে।