ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: ডলারের উত্তাপে নিত্যপণ্যের বাজারও গরম হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গত কয়েক মাস ধরে পণ্যের দাম কমলেও স্থানীয় বাজারে কমছে না। বরং ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। এ অজুহাতে সর্বশেষ চিনি ও সয়াবিন তেলের দাম ফের বাড়ানো হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার পর থেকে যেসব পণ্যের এলসি খোলা হয়েছিল সেগুলো দেশে আসতে শুরু করেছে। যেখানে এগুলোর দাম কমার কথা, সেখানে ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে বাড়ানো হচ্ছে। এতে একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা।
অন্যদিকে দাম বাড়ায় ক্রেতার কষ্ট বেড়েছে। নানা অজুহাতে প্রায় সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। অথচ এসব ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত কোনো বিশ্লেষণ হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়টি সেভাবে তদারকি হচ্ছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতিসংঘের কৃষি বিষয়ক সংস্থা ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল অরগানাইজেশনের (এফএও) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে অক্টোবর এই ৪ মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম ১২ শতাংশ, সয়াবিনের দাম ১৮ শতাংশ, চিনির দাম ২২ শতাংশ কমেছে। এছাড়া ডালের দাম ৬ শতাংশ, ডিমের দাম ৮ শতাংশ কমেছে। তবে এক বছরের হিসাবে খাদ্যপণ্যের দাম এখনও গড়ে ১২ শতাংশ বেশি রয়েছে।
জুনে আমদানির জন্য ডলারের দাম ছিল ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা। বর্তমানে প্রতি ডলার ১০৭ টাকা। ওই সময়ে প্রতি ডলারের দাম বেড়েছে ১৩ টাকা ৫৫ পয়সা। অর্থাৎ টাকার মান কমেছে ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ।
করোনার পর খাদ্যপণ্যের দাম এক দফা বেড়েছে। এর ধকল কাটিয়ে উঠার আগেই ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর প্রভাবে মার্চ থেকে খাদ্যপণ্যের দাম আরও লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে। ফলে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়তে থাকে।
এলসি খোলার পর ওই পণ্য দেশে আসতে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ মাস সময় লাগে। ওইসব পণ্য দেশীয় কারখানায় পরিশোধন হয়ে বাজারে আসতে আরও ১ মাস পার হয়। এ হিসাবে আমদানি পণ্য বাজারে আসতে ৪ থেকে ৫ মাস সময় লাগে। তবে তৈরি পণ্য হলে ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে বাজারে আসে। বাড়তি দামে মার্চে যেসব পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে সেগুলো বাজারে এসেছে জুন-জুলাইয়ে। সেগুলো পরিশোধ হয়ে বাজারে এসেছে জুলাই-আগস্টে। কিন্তু পণ্যের দাম বেড়েছে এপ্রিল থেকেই।
জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করে। আগস্টে এসে বেশ কমে যায়। কম দামে জুলাইয়ে যেসব পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে সেগুলো সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বাজারে এসেছে। কিন্তু দাম তেমন একটা কমেনি। বরং কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলারের দাম বাড়লে আমদানি পণ্যের খরচ বেশি পড়ে। তবে কত বেশি পড়ে সেটি নির্ধারণ করতে গবেষণা হওয়া উচিত। এর একটি স্থায়ী পলিসি দরকার। ডলারের দাম কত বাড়লে কেজিতে কত বাড়বে- বর্তমানে এ ধরনের কোনো পলিসি নেই। দেখা যাচ্ছে সেপ্টেম্বরের তুলনায় এখন ডলারের দাম কমেছে। কিন্তু পণ্যের দাম ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে বাড়ানো হয়েছে। এ ধরনের ব্যবস্থা হলে ভোক্তার সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচরণ হবে না। ডলারের মূল্য যেহেতু অস্থির, সে কারণে আগেই একটি পলিসি করা দরকার ছিল। আগে যেহেতু হয়নি, দ্রুত করা উচিত। ভোক্তার স্বার্থে এটি প্রয়োগ করাও জরুরি।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়লে দেশের বাজারেও প্রভাব পড়বে। কারণ অনেক পণ্য আছে যা আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়। তবে বিশ্ববাজারে কিছু পণ্যের দাম কমছে। তার প্রভাব দেশের বাজারে পড়েনি। এর একটা কারণ হতে পারে, ডলার সংকট ও মূল্য বৃদ্ধি। তাই বিশ্ববাজারে দাম কমলেও ডলারের দাম বেশি হওয়ায় দেশীয় ব্যবসায়ীদের বেশি দরেই কিনতে হচ্ছে। পাশাপাশি এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট আছে। তারা অতি মুনাফা করতে পণ্যের দাম কমলেও বেশি দরে বিক্রি করে। তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। সঙ্গে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
এদিকে জুনে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা। ২১ জুলাই তা বেড়ে হয় ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা। ৮ আগস্ট আরও বেড়ে ৯৫ টাকা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর এক লাফে বেড়ে হয় ১০৮ টাকা। ৩১ অক্টোবর তা আরও কিছুটা কমে দাঁড়ায় ১০৩ টাকা। এখন ব্যাংক ভেদে ১০১ থেকে ১০৭ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। সরকারি ব্যাংকগুলো বর্তমানে আমদানির এলসি বেশি খুলছে। এসব ব্যাংকে প্রতি ডলার ১০৫ থেকে ১০৭ টাকা।
বাড়তি দামে ডলার কিনে এলসি খুললেও পণ্যের দাম সঙ্গে সঙ্গে বাড়ার কথা নয়। বাড়তি দামে ডলার কিনে এলসি খুলে পণ্য দেশে আসার পর বাড়ার কথা। কিন্তু তার আগেই পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ডলারের দাম ১০০ টাকার উপরে উঠেছে সেপ্টেম্বরে। ওই সময়ে যেসব পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগই এখনও দেশে আসেনি। দেশে আসার পর এগুলো পরিশোধন হয়ে বাজারে যেতে সময় লাগবে আরও এক মাস। এ হিসাবে ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব ডিসেম্বরে পড়ার কথা।
কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও চিনির দাম যখন কমেছে তখন ১৭ নভেম্বর শুধু ডলারের দাম ১০০ টাকার উপরে চলে গেছে এই অজুহাতে দাম বাড়ানো হয়েছে। ওই দিন প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ১২ টাকা বেড়ে ১৯০ টাকা এবং চিনির দাম কেজিতে ১৩ টাকা বেড়ে ১০৮ টাকা করা হয়েছে। অথচ এই দামেও বাজারে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। এখন প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকা। যা এক মাস আগে (অক্টোবর) ছিল ১০৫ টাকা। সেপ্টেম্বরে বিক্রি হয়েছে ৯৫ টাকা, আগস্টে ৯০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। অথচ অক্টোবরের তুলনায় এখন ডলারের দাম কমেছে। তাহলে এখন যেসব পণ্যের এলসি খোলা হচ্ছে সেগুলোর দাম কি ৩-৪ মাস পর কমবে। উত্তর সহজ-কমবে না। তখন অন্য অজুহাতে দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলবে।
আন্তর্জাতিক দাম কমার কারণে যেখানে দেশেও কমতির দিকে থাকার কথা, সেখানে চার মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি চিনি কিনতে একজন ক্রেতাকে ২৫ টাকা বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কমতির মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম ৮৪ টাকা ও প্যাকেট চিনি ৮৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ৬ অক্টোবর প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম ছয় টাকা বাড়িয়ে ৯০ ও প্যাকেট চিনি ৯৫ টাকা করা হয়। সর্বশেষ ১৭ নভেম্বর বৃহস্পতিবার দাম আরেক দফা বাড়ানো হয়। নতুন মূল্য হচ্ছে প্রতি কেজি ১০২ টাকা এবং প্যাকেট চিনি ১০৮ টাকা।
২৬ জুন প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৮০ টাকা, বোতলজাত সয়াবিনের মূল্য ছিল ১৯৯ টাকা। মে থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম কমেছে। কিন্তু দেশের বাজারে ২৮ আগস্ট এক দফা মূল্য কমিয়ে প্রতি লিটার খোলা ১৭৫ ও বোতলজাত সয়াবিন ১৯২ টাকায় নামিয়ে আনা হয়। বিশ্ববাজারে দাম আরও কমার পরিপ্রেক্ষিতে ৩ অক্টোবর লুজ সয়াবিনের লিটার ১৫৮ টাকা ও বোতলজাত সয়াবিনের মূল্য ১৭৮ টাকায় নামানো হয়।
তবে কিছু দিন বাজারে সরকার ঘোষিত মূল্য কার্যকর থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে বিক্রেতারা কারসাজি করে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১৭০ ও বোতলজাত ১৮০ টাকায় বিক্রি করে। সর্বশেষ ১৭ নভেম্বর নতুনভাবে দাম বাড়ানো হয় ভোজ্যতেলের। এক লাফে লিটারপ্রতি ১২ টাকা বাড়িয়ে খোলা সয়াবিনের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১৭২ টাকা এবং বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতিলিটারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৯০ টাকা।
তবে বাজার পরিস্থিতি পর্যালচনা করে দেখা গেছে-শুক্রবার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ১৮৫ টাকা। এক মাস আগে (অক্টোবর) বিক্রি হয়েছে ১৬৬ টাকা। এছাড়া বোতল সয়াবিন প্রতি লিটার বিক্রি হয়েছে ১৯০ টাকা। যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ১৮৫ টাকা।
জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সব ধরনের আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে। সেই প্রভাব দেশেও পড়ছে। তবে কেউ দাম নিয়ে অসাধুতা বা কারসাজি করতে না পারে সেদিকে তদারকি করা হচ্ছে। কোনো অনিয়ম পেলেই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খোলা আটা বিক্রি হয়েছে ৬২ টাকা। যা এক মাস আগে (অক্টোবর) ছিল ৫৮ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে কমায় সেপ্টেম্বরে কমে ৫৫ ও আগস্টে বিক্রি হয়েছে ৫২ টাকায়। তিন মাস ২৫ দিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি আটা খুচরা বাজারে ১০ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি খোলা ময়দা প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৭৫ টাকা।
যা এক মাস আগে (অক্টোবর) বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকা। মাসের ব্যবধানে কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরে ৬২ টাকা, আগস্টে বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা কেজি। সেক্ষেত্রে ৩ মাস ২৫ দিনের ব্যববধানে প্রতি কেজি খোলা ময়দা কিনতে একজন ক্রেতাকে ১৫ টাকা বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। অথচ ওই সময়ে বিশ্ববাজারে গমের দাম কমেছে। মাঝারি মানের মসুর ডালের কেজি এখন ১৪০ টাকা। এক মাস আগে ছিল ১৩০ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে ডালের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। শুধু ডলারের দাম ও জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধির অজুহাতে চার মাসে ডালের দাম কেজিতে ৩০ টাকা বাড়ানো হয়েছে।