ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: ঈদ মানেই ভারতসহ বিদেশি ব্র্যান্ডের দাপট। সময়ের ব্যবধানে সেই চিত্র বদলে গেছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বর্তমানে বাজারের বড় একটি অংশ দখল করে নিয়েছে দেশীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য। দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর কাপড় ও ডিজাইন দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে। ঈদকে সামনে রেখে এবারও আকর্ষণীয় ও নজরকাড়া পোশাক নিয়ে প্রস্তুত দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো।
রাজধানীর বসুন্ধরা শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, আজিজ সুপার মার্কেট, মিরপুরসহ রাজধানী বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দেশীয় বুটিক হাউসগুলো ঈদকে সামনে রেখে ট্রেন্ডি ও ট্রেডিশনাল লুকের নান্দনিক পোশাক রাঙিয়ে তুলেছে।
বিক্রেতারা বলছেন, রোজার শুরু থেকেই কাস্টমার আসছে। শুক্রবার থেকে পুরোদমে ঈদের বেচাকেনা শুরু হবে। ডলার সংকটের কারণে এবার দেশীয় পোশাকেও বাড়তি খরচ যোগ হয়েছে। ফলে গত বছরের চেয়ে এবার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়তি দামে পোশাক কিনতে হবে। সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে বাচ্চাদের কাপড়ে।
পোশাক তৈরির সঙ্গে যুক্তরা জানান, বাচ্চাদের পোশাক তৈরির অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এবার ডলার সংকট ও বাড়তি দামের কারণে খরচ বেড়েছে। এটা মেনেই ক্রেতারা যেন শপিং করতে আসেন- এমন পরামর্শ তাদের।
এদিকে, এবার ঈদের পোশাকে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আবহ। পাশাপাশি সময়, প্রকৃতি ও আন্তর্জাতিক ট্রেন্ডও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আড়ং, অঞ্জন’স, ইনফিনিটি কিংবা সেইলর-এর মতো দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো ঈদের বাজারে দেশীর সংস্কৃতি, আবহকে প্রাধান্য দিয়েছে। এসব ব্র্যান্ডের পণ্য কিনতে যেমন হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ক্রেতারা, তেমনি বিস্তর অভিযোগ রয়েছে দাম ও মান নিয়েও।
ক্রেতাদের অভিযোগ, দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো সাধারণ মানের কাপড় দিয়ে তৈরি পোশাকের দাম অনেক বেশি চাচ্ছে। শুধু শুধু পণ্যের গায়ে বেশি দাম লিখে রাখছে। বিশেষ করে ঈদ মৌসুমে এ প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। ফলে এক শ্রেণির ক্রেতাদের নাগালে বাইরে থেকে যাচ্ছে দেশীয় ফ্যাশন হাউজের পণ্য
বসুন্ধরা শপিং মলে লালবাগ থেকে ঈদের পোশাক কিনতে এসেছেন নাজনীন বেগম। তিনি বলেন, বিদেশি ব্র্যান্ডের পোশাক কেনার সামর্থ্য নেই বলে দেশীয় বুটিক হাউজে এসেছি। এখানে এসেও দেখি দাম বাড়তি। গত বছর বাচ্চার যে পোশাক ৭৫০ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম, সেটি এবার ৯০০ টাকার বেশি চাওয়া হচ্ছে। শুধু বাচ্চা নয়, পাঞ্জাবি, শার্ট ও শাড়ির দামও বাড়তি।
রাজধানীর শাহজাহানপুর থেকে বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের আড়ং শো-রুমে ঈদের কেনাকাটা করতে এসেছেন সাইফুল ইসলাম। ছেলে ও নিজের পাঞ্জাবি পছন্দ হলেও বাজেটের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। তার অভিযোগ, দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোতে মানুষের চাপ বেশি থাকে। এসব হাউজে পোশাক সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে। একই সঙ্গে থাকে ডিজাইনের ভিন্নতা। কিন্তু এবার কাপড় ও ডিজাইন বিবেচনায় পাঞ্জাবির দাম অনেক বেশি মনে হচ্ছে। বাইরের দুই হাজার টাকার পাঞ্জাবি এখানে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা চাওয়া হচ্ছে। আমার ধারণা, ব্র্যান্ড হিসেবে তারা বেশি দাম রাখছে। এটা দেখার কেউ নেই।
আড়ং-এর সেলসম্যান রোকসানা জানান, ঈদ বা যেকোনো উৎসবে আড়ং দাম বাড়ায় না। বরং নানা ধরনের ছাড় দেওয়া হয়। আমাদের দাম নির্ধারণ সিস্টেম খুবই পরিচ্ছন্ন। কোন পোশাকে কী কাপড় এবং কোন ধরনের নকশা করা হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে দাম নির্ধারণ করা হয়। যেমন- কাপড়ের কাজে এমব্রয়ডারি, প্রিন্ট কিংবা কী ধরনের হাতের কাজ যোগ হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে পোশাক বা পণ্যের চূড়ান্ত দাম নির্ধারণ হচ্ছে। এরপর ফিক্সড মার্কার সিস্টেম অনুসরণ করা হয়। ফলে দেশের যেকোনো আউটলেটে একই দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে। পরিপূর্ণ অটোমেটেড সিস্টেম অনুসরণ করতে হয় আমাদের। আমরা চাইলেও দাম কমাতে কিংবা বাড়াতে পারি না। ফলে অতিরিক্ত দাম নেওয়ার সুযোগ নেই।
ফ্যাশন এন্টারপ্রেনিউর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ও অঞ্জন’স-এর স্বত্বাধিকারী মো. শাহীন আহমেদ জানান, এবার ঈদে দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর দাম তেমন বাড়েনি। তবে, এসব পোশাক তৈরিতে বোতামসহ কিছু কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। ডলার সংকটের কারণে এসব জিনিসের দাম বেড়েছে। তারপরও ক্রেতাদের বিষয় মাথায় রেখে সেভাবে দাম বাড়ানো হয়নি।
রাজধানীর বসুন্ধরা শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, আজিজ সুপার মার্কেট, মিরপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেশীয় বুটিক হাউসগুলো ঈদকে সামনে রেখে ট্রেন্ডি ও ট্রেডিশনাল লুকের নান্দনিক পোশাক উপস্থাপন করেছে।
বাংলাদেশের আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখে আরামদায়ক কাপড় যেমন- সুতি, সিল্ক, লিনেন,কাতান, জ্যাকার্ড কাপড়ের চাহিদা বেশি থাকে। ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে এবারের ঈদে এসব কাপড় দিয়ে পোশাক তৈরি করা হয়েছে। দেশীয় বুটিক হাউসগুলো বিশ্বরঙ, আর্টিসেল, লা রিভ, কে-ক্র্যাফট, নিত্য উপহার, বাংলার মেলা, সাদাকালো, বিবিয়ানা, লোকজ, মেঘ, বাঙ্গাল, মেঠোপথ, ক্যানভাস, ফেরিওয়ালা, আইডিয়াস, গাঁওগেরাম, ফোর ডাইমেনশনসহ বেশকিছু বুটিক হাউস ঈদের পোশাক বাজারে এনেছে।
সাদাকালো ফ্যাশন হাউজে শিশু, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সব বয়সের পোশাক পাওয়া যাচ্ছে। ছোটদের পাঞ্জাবি ৪০০ থেকে ৯০০ টাকায়, ফতুয়া ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকায়, কুর্তা ৬২০ থেকে ২৬২০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। পাঞ্জাবির দাম রাখা হচ্ছে ৫৮০ থেকে নয় হাজার টাকার মধ্যে। মেয়েদের থ্রি পিস মিলছে ১২০০ থেকে সাড়ে চার হাজার টাকায়। সাদাকালোর শাড়ির দাম রাখা হচ্ছে এক হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে।
অঞ্জন’স ফ্যাশন হাউজে ছোটদের পাঞ্জাবির দাম ৭০০ থেকে ১৭০০ টাকা, বিয়ের শেরওয়ানি নয় হাজার টাকায়, সাধারণ পাঞ্জাবি ৯৫০ থেকে পাঁচ হাজার ৬৯০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। কটনের থ্রি পিসের দাম দেড় হাজার থেকে আট হাজার ৯০০ টাকা এবং শাড়ি ৭৫০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নাগরদোলায় ছেলেদের পাঞ্জাবি পাওয়া যাচ্ছে ৬৯০ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়, শাড়ি দেড় হাজার থেকে ছয় হাজার, ফতুয়া মিলছে ৫৩০ থেকে ৭২০ টাকায়। মেয়েদের থ্রি পিসের দাম এক হাজার থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকা এবং অন্যান্য কাপড় মিলছে ৭৫০ থেকে ছয় হাজার টাকার মধ্যে।
ক্রেতাদের অভিযোগ, দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো সাধারণ মানের কাপড় দিয়ে তৈরি পোশাকের দাম অনেক বেশি চাচ্ছে। শুধু শুধু পণ্যের গায়ে বেশি দাম লিখে রাখছে। বিশেষ করে ঈদ মৌসুমে এ প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। ফলে এক শ্রেণির ক্রেতাদের নাগালে বাইরে থেকে যাচ্ছে দেশীয় ফ্যাশন হাউজের পণ্য
বাংলার মেলা, কে ক্রাফট, নিপুণ ফ্যাশনের ব্যবস্থাপক রফিকুল মিয়া বলেন, এখানে থ্রি পিসের দাম ১২০০ থেকে চার হাজার, পাঞ্জাবি ১৩০০ থেকে ২৫০০, আর শাড়ির দাম পড়ছে ৯০০ থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকা। এছাড়া নিপুণে শার্ট ও ছোটদের পোশাকও মিলছে। বিবিয়ানা ফ্যাশন হাউজে নারীদের প্রায় সব ধরনের পোশাক পাওয়া যাচ্ছে। এখানে মেয়েদের স্যান্ডেল থেকে শাড়ি পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। শাড়ির দাম ৭০০ থেকে ছয় হাজার টাকা, পাঞ্জাবি ৫০০ থেকে ১৭০০ এবং সালোয়ার কামিজের দাম পড়ছে এক হাজার থেকে ২৬০০ টাকায়। মেয়েদের ফতুয়ার দাম পড়ছে ৪০০ থেকে ১২০০ টাকায়।
দেশাল, রঙ ও প্রবর্তনার পাঞ্জাবির দাম ৮০০ থেকে ২২০০ টাকা। ছোটদের পাঞ্জাবি মিলছে ৩৪০ থেকে এক হাজার টাকায়। মেয়েদের সালোয়ার ১৪০০ থেকে ২২০০ টাকা, প্রতি গজ কাপড় ১৯০ থেকে ২৭৫ টাকায় মিলছে। শাড়ি কিনতে খরচ পড়ছে ৪৪০ থেকে ১৬ হাজার টাকা।
এছাড়া, বিভিন্ন বুটিক হাউজে শেরওয়ানি, কটি, স্মার্ট ক্যাজুয়াল শার্ট, এথনিক শার্ট, ফতুয়া ও পোলো শার্ট; মেয়ে শিশুদের জন্য উৎসবভিত্তিক সালোয়ার, কামিজ, ফ্রক, কুর্তি, টপস, পাফি পার্টি ড্রেস, লেহেঙ্গা সেট এবং ছেলে শিশুদের জন্য পাঞ্জাবি, শার্ট, কটি, শেরওয়ানিসহ থাকছে বাহারি পোশাক। এসব পোশাকে প্যাটার্ন, ফেব্রিক ও রঙের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সৌজন্যে, ঢাকা পোস্ট।