ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর পরই ডিমের দাম রেকর্ড বেড়ে যায়। তবে বর্তমানে আচমকাই ডিমের দাম কমছে। এমনকি উৎপাদন খরচের চেয়েও কম দামে খামারিদের ডিম বিক্রি করতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পোল্ট্রি সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, প্রধানত তিনটি কারণে ডিমের দাম কমছে।
প্রথমত, শীতের মৌসুমে মাছের সরবরাহ বেশি থাকে। এ সময়ে খাল-বিলে মাছ ধরা পড়ে। এছাড়াও শীতকালীন সবজির কারণেও ডিমের চাহিদা কম থাকে।
দ্বিতীয়ত, শীতকালে খামারিরা মুরগীর নতুন বাচ্চা তোলেন না। কারণ শীতের কারণে বাচ্চা পালন করা কষ্টকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ। যার কারণে কর্পোরেট কোম্পানিগুলোও এই মৌসুমে বাচ্চা উৎপাদন করে না। সেই ডিম ভোক্তা পর্যায়ে সরবরাহ করে। চাহিদার চেয়ে বেশি সরবরাহ থাকার কারণে এ সময় ডিমের দাম কম থাকে।
তৃতীয়ত, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে মোটা অংকের টাকা তুলে নিয়েছে মধ্যসত্বভোগী ডিমের পাইকাররা। এ সময় ডিমের দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানির হুমকি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর ফলে একাধিক কোম্পানি ডিম আমদানির প্রস্তাব করেছে। তারা ছয় থেকে আট টাকার মধ্যে ডিম সরবরাহের টার্গেট দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আমদানি বন্ধের লক্ষ্যে আট টাকার মধ্যে ডিম বিক্রিতে বাধ্য করছে সিন্ডিকেট।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদ (বিপিকেআরজেপি) এবং পোল্ট্রি প্রফেশনাল’স বাংলাদেশের (পিপিবি) তথ্যমতে, মঙ্গলবার (২৯ নভেম্বর) খামারি পর্যায়ে গাজীপুরে লাল ডিম আট টাকা ১০ পয়সা এবং সাদা ডিম সাত টাকা ৪০ পয়সা, কুমিল্লায় লাল ডিম আট টাকা এবং সাদা সাত টাকা সাত পয়সা, টাঙ্গাইলে লাল ডিম সাত টাকা ৯৫ পয়সা এবং সাদা সাত টাকা সাত পয়সা, সিলেটে লাল ডিম আট টাকা আট পয়সা এবং সাদা ডিম আট টাকা সাত পয়সা, ময়মনসিংহে লাল ডিম আট টাকা এবং সাদা ডিম সাত টাকা সাত পয়সা, রাজশাহীতে লাল ডিম সাত টাকা নয় পয়সা এবং সাদা ডিম সাত টাকা চার পয়সা, চট্টগ্রামে লাল ডিম আট টাকা এক পয়সা এবং ফরিদপুরে লাল ডিম আট টাকায় বিক্রি হয়েছে।
তবে খামারিদের তথ্যমতে, মূল দামের থেকেও কম পেয়েছে তারা।
টাঙ্গাইলের মধুপুরের পোল্ট্রি খামারি জুবায়ের হিমেল ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘১০০ পিস ডিম ৭৯০ টাকায় (সাত টাকা নয় পয়সা প্রতি পিস) বিক্রি হয়েছে।’
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার খামারি আর এইচ শান্ত বলেন, ‘১০০ পিস সাদা ডিম ৭৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।’
তবে রাজশাহীর আমিনুল ইসলাম ১০০ পিস লাল ডিম ৮০০ টাকায় বিক্রি করেছেন বলে ভোক্তাকণ্ঠকে জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে পিপিবি’র দাপ্তরিক মো. সোহেল রানা ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘ডিমের মান ভেদে দামের কিছুটা পার্থক্য থাকে। তবে যে দামটা বেশি থাকে আমরা সেই দামটা দেই। যাতে খামারিরা কম দামে বিক্রি না করে। তবে উৎপাদন খরচ তাদের এর থেকে বেশি পড়ছে।’
এ বিষয়ে কথা হয় রাজশাহীর পোটিয়া উপজেলার পোল্ট্রি খামারি আমিনুল ইসলামের সঙ্গে। তার ভাষ্যমতে, তিন হাজার ৯০০টি মুরগীর পেছনে প্রতিদিন তার ৪২৫ কেজি খাদ্য (ফিড) লাগে। ৫০ কেজির এক বস্তা ফিডের দাম তিন হাজার টাকা। সেই হিসাবে দৈনিক একটি মুরগীর ছয় টাকা ৫৪ পয়সার ফিড লাগে। সেই সঙ্গে প্রতিদিন এক হাজার ৮০০ টাকা বা মুরগী প্রতি ০.৪৬ টাকার ওষুধ লাগে। অর্থাৎ শুধু খাদ্য এবং ওষুধেই মুরগী প্রতি সাত টাকা খরচ।
এছাড়াও দুই সেডে বিভক্ত এ মুরগী পালনের জন্য তিন জন কর্মচারী রয়েছে। দু’জনের বেতন ১২ হাজার টাকা করে এবং একজনের বেতন ১৫ হাজার টাকা। এছাড়াও গড়ে মাসে বিদ্যুৎ বিল আসে ১২ হাজার টাকা। খামারের জায়গা এক লাখ ৪০ হাজার টাকা দিয়ে ১০ বছরের চুক্তিতে নেওয়া। মুরগির সেড (ঘর) তৈরি করতে লেগেছে সাড়ে নয় লাখ টাকা। বাঁশের তৈরি হওয়ায় এগুলো প্রতি বছরেই মেরামত করতে হয়। সব মিলিয়ে ডিম উৎপাদনে নয় টাকার উপরে খরচ পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে গড়ে আট টাকা।
উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে ডিম বিক্রি করছেন কেন- এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ প্রান্তিক পোল্ট্রি খামারি ঐক্য পরিষদের মহাসচিব কাজি মোস্তফা কামাল ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘এখানে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট রয়েছে। তারা যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, আমাদের সেই দামেই বিক্রি করতে হয়। তেজগাঁও, কাপ্তান বাজারের ডিম ব্যবসায়ীরাই ডিমের এই দাম নির্ধারণ করে দেন। তারা এর থেকে বেশি দামে না নিলে তো কিছু করারও নেই। ডিমতো বিক্রি করতেই হবে।’
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ এগস মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের আহ্বায়ক আমানত উল্লাহ ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘ডিমের চাহিদা কমে গেছে। যার কারণে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো কম দামে বাজারে ডিম বিক্রি করছে। এ জন্য আমাদেরও কম দামে কিনতে হচ্ছে।’
তবে কর্পোরেট কোম্পানির ডিমের দাম তুলনামূলক বেশি রয়েছে। এছাড়াও প্রান্তিক খামারিদের থেকে তাদের উৎপাদন খরচ কম পড়ে। কারণ বাচ্চা এবং খাদ্য তারা নিজেরাই উৎপাদন করে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রণোদনার সুযোগ সুবিধাও তারা পেয়ে থাকে বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি নাজের হোসাইন ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে যেমন ডিমের দাম বেড়েছিল। আবার ডিম আমদানি বন্ধের কৌশলতা হিসেবেই দাম কমিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।’
বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘এখানে খামারিরা লোকসান গুনলেও মধ্যসত্বভোগীরা ঠিকই মুনাফা করে নিচ্ছে।’
এর আগে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে অগাস্টের মাঝামাঝিতে হঠাৎ করেই ডিমের দাম বেড়ে যায়। একেকটি ডিমের দাম খুচরা পর্যায়ে ১৪-১৫ পর্যন্তও উঠে যায়। এর ফলে দেশ জুড়ে প্রতিবাদ সৃষ্টি হয়। পরে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানের পর দাম কমে। সে সময়ে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে প্রয়োজনে ডিম আমদানি করা হবে বলেও হুশিয়ারী দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনসী। এর সপ্তাহ খানেক পর থেকেই ডিমের দাম কমতে থাকে।
রাজশাহীর একাধিক খামারি ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘ডিম দেওয়ার আগে একটি বাচ্চাকে চার মাস খাওয়াতে হয়েছে। এরপর প্রথম দুই মাস ডিমের সাইজ ছোট থাকার কারণে উৎপাদন খরচের দামেই বিক্রি করতে হয়েছে। তারপর থেকে মাস তিনেক লাভের মুখ দেখেছিলাম। তবে এই মাসে আবারও লোকসান গুনতে হচ্ছে ডিমপ্রতি এক টাকা ৫০ পয়সা করে।
লোকসান না দিয়ে মুরগী বিক্রি করে দিচ্ছেন না কেন- এমন প্রশ্নে তারা বলেন, ‘এতে আরও বেশি লোকসান হয়। কারণ ডিম উৎপাদনের আগ পর্যন্ত মুরগী প্রতি এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা খরচ হয়। যার কারণে লোকসান হলেও খামারিরা মুরগী বিক্রি করে দিচ্ছেন না।’
এদিকে, দেশের বাজারের ডিম সংকট ও বাড়তি দামের পরিপ্রেক্ষিতে ছয়টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ৫১ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি চেয়ে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়েছে।
আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, শুল্ক ছাড়ে আনতে পারলে ছয় টাকা পিস ডিম বিক্রি করা যাবে। আর শুল্কসহ আট টাকার মধ্যে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিম আমদানির বিষয়ে মতামত দেওয়ার জন্য ১০ নভেম্বর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে।
যে ছয়টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান চিঠি দিয়েছে, তাদের মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান ১০ কোটি করে ডিম আমদানি করতে চেয়েছে। আর একটি প্রতিষ্ঠান এক কোটি ডিম আমদানি করতে চায়। ১০ কোটি ডিম আমদানি করতে চাওয়া পাঁচটি প্রতিষ্ঠান হলো- মেসার্স সাজ্জাদ এন্টারপ্রাইজ, টাইগার ট্রেডিং, আহমেদ বিজনেস অ্যান্ড কমার্স প্রাইভেট লিমিটেড, রিপা এন্টারপ্রাইজ ও পপুলার ট্রেড সিন্ডিকেট। আর এক কোটি ডিম আমদানি করতে চায় সেভ অ্যান্ড সেফটি কোম্পানি।
এ বিষয়ে টাইগার ট্রেডিং থেকে শরিফুর রহমান ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী আমরা আবেদন করেছি। অনুমতি পেলে নির্দিষ্ট দামের মধ্যেই ডিম সরবরাহ করতে পারবো। তবে মনে হচ্ছে, আমদানি বন্ধ করার জন্য ডিমের দাম কমিছে সিন্ডিকেট।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (খামার শাখা) জিনাত সুলতানা ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘আমদানির বিষয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে আমদানি করা হলে দেশের খামারিদের ক্ষতি হবে। যেহেতু খাদ্যের দাম বেশি হওয়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেশি, তাই সেই বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।’
তবে মহিউদ্দিন আহমেদের মতে, ডিমের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সীমিত পরিসরে আমদানির অনুমতি দেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে সিন্ডিকেটের কারণে ডিমের দাম ভোক্তার নাগালের বাইরে চলে যায়। শীতের মৌসুমে ডিমের চাহিদা কিছুটা কম থাকার কারণে ডিমের দাম কমেছে। তবে মৌসুম শেষে ডিমের দাম বেড়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে প্রান্তিক খামারিদের রক্ষা করতে কর্পোরেট কোম্পানির সঙ্গে সমন্বয় করা দরকার।
তবে খামারি পর্যায়ে দাম কম হলেও ভোক্তা পর্যায়ে চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে ডিম। রাজধানীর বিজয় নগরের একাধিক দোকানে লাল ডিম বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকা ডজন (১২ পিস) বা ৪৫ টাকা হালি৷ এছাড়াও, ধলপুর যাত্রাবাড়ীর আশরাফুল স্টোরসহ বেশি কিছু দোকানে বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা ডজন বা ৪০ টাকা হালি। হাঁসের ডিম ৬৫-৭০ টাকা হালি।
২০২১ সালে প্রতি পিস লাল ডিম উৎপাদনে খরচ হয়েছে সাত টাকা ২৬ পয়সা এবং সাদা ডিম ছয় টাকা ৩০ পয়সা। অন্যদিকে ব্রয়লার এক কেজিতে খরচ ছিল ৯৯ টাকা ১৬ পয়সা। ২০২২ সালে একটি লাল ডিম উৎপাদনে খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে নয় টাকা ৭০ পয়সা এবং সাদা ডিমে নয় টাকা ৪০ পয়সা।