ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: নিত্যপণ্যের বাজারে দাম বাড়লেই আলোচনায় সিন্ডিকেট শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয়। এই শব্দের সঙ্গে আমরা কম বেশি সবাই পরিচিত। নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে মূল ভূমিকায় থাকে এই সিন্ডিকেট। কারা এই সিন্ডিকেট? তাদের কাজ কি?
সম্প্রতি চিনির বাজার নিয়ে চলছে নৈরাজ্য। সেই সঙ্গে ভোজ্য তেলের বাজার নিয়েও মাঝে মাঝে নৈরাজ্য শুরু হয়। আর এসব নৈরাজ্যের পেছনে মূল ভূমিকায় থাকে সিন্ডিকেট বলে মনে করছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা।
সাধারণ পাইকারী এবং খুচরা ব্যবসায়ী অভিযোগ করে জানায়, নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট তৈরি করছেন মিল মালিকদের। তারা বলছেন, মিল মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে সরকার নির্ধারিত কম দামে চিনিই পাচ্ছেন না তারা। মিল মালিকদের কাছ থেকে বেশি দামে কেনার কারণে বিক্রিও করতে হবে বেশি দামে। কিন্তু খুচরা ব্যবসায়ীরা বেশি দামে বিক্রি করলে সরকারি সংস্থার জরিমানার সম্মুখীন হতে হয়।
সরকার গত ৮ এপ্রিল থেকে পরিশোধিত চিনির কেজিতে ৩ টাকা কমিয়ে করেছে ১০৪ টাকা। আর প্যাকেট চিনির দাম ৩ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৯ টাকা। কিন্তু সেই দামে তো দূরের কথা রমজান মাস শেষ হলেও প্রায় দোকানে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কোথাও পাওয়া গেলেও ভোক্তাদের বেশি দাম গুনতে হচ্ছে। মিল থেকেই বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে বলে ডিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। এ জন্য খুচরা ব্যবসায়ীও ভোক্তাদের কাছে বেশি দামে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি বিক্রি করছে।
অন্যদিকে, সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৪ মে। তার কয়েক ঘণ্টা পর থেকেই বর্ধিত দামে তেল বিক্রি করা হচ্ছে। উভয় ক্ষেত্রেই মিল মালিকদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন খুচরা বিক্রেতারা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১২টাকা বাড়ানো হলে বোতলের গায়ে আগের দাম উল্লেখ থাকার পরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। কারণ মিলারদের সিন্ডিকেটের কারনে আগের সয়াবিনও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তাই বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে ভোজ্যতেল ও চিনির বাজার মিল মালিকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুরের কৃষিমার্কেট, টাউনহলসহ বিভিন্ন বাজারে গেলে এমনই ক্ষোভের চিত্র পাওয়া যাচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, বেশি দামের আশায় মিলমালিকরা কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করায় এই অবস্থা। তবে কোনো কোনো ডিলার ও পাইকাররা মিল থেকে বেশি দামে কিনে তা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন।
অপরদিকে, সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৯৯ টাকা ঘোষণার পর থেকেই বাজারে দাম বাড়তে শুরু করেছে। খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, নতুন রেটের তেল না আসলেও বাড়তি দামেই ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করতে হচ্ছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজাররের মেসার্স রতন স্টোরের মালিক রতন বলেন, আমরা কি মুখে শুধু শুনব দাম কমেছে? আর বেশি দামে কিনতে হবে? তাও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। সরকার চিনির কেজিতে তিন টাকা কমানোর ঘোষণা দেওয়ার পর আমরা পাচ্ছি না কেন। সিটিগ্রুপ, মেঘনা, দেশবন্ধুসহ কয়েকটি চিনি কলের কাছে সরকার জিম্মি হয়ে গেছে। ১৭ কোটি মানুষকেও জিম্মি করে রাখছে। তারা যা ইচ্ছা তাই করছে।
পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেন, শুধু শুনছি চিনির দাম কমেছে কিন্তু পাচ্ছি তো না। কোথাও পাওয়া গেলেও তা ১৩০ টাকা।
তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে সিটিগ্রুপ, মেঘনা, দেশবন্ধুসহ মিল মালিকদের কাউকে বক্তব্য নেওয়ার জন্য পাওয়া যায়নি।
চিনি ও তেলের ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ভোক্তাদের মধ্যেও চরমভাবে ক্ষোভ দেখা গেছে। ভোক্তারা অভিযোগ করে বলছেন, গত বছর তেল লুকিয়ে বেশি দামে বিক্রি করা হয়েছে। এবার চিনি নিয়ে চলছে ছিনিমিনি। দুই দিন থেকে আবার শুরু হয়েছে তেল নিয়ে খেলা। বাড়তি দামের রেট না আসলেও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন মাহি গণমাধ্যমকে বলেন, বাজার মনিটরিংয়ের অভাবে ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বাজারে পর্যাপ্ত ভোজ্যতেলের মজুত থাকলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে। বিশ্ববাজারে দাম কত, আমদানিতে খরচ হলো কত, সরবরাহ চেইনে বিক্রি হচ্ছে কত টাকায়, মজুত থাকলে কী পরিমাণ রয়েছে, পণ্যটিতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার রয়েছে কিনা এসব জিনিস মনিটরিং করা উচিত। দেশে মনিটরিং মানে খুচরা বা পাইকারি ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়। একে মনিটরিং বলে না।
তবে এসব বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, রমজান মাসে ব্যবসায়ীদের বলেছিলাম যার যতো চিনি লাগবে চাইলে মিল থেকে দেওয়া হবে। কিন্তু এভাবে দাম বাড়লেও কোনো ব্যবসায়ী অভিযোগ করেনি।
মিলমালিকদের ধরার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা প্রায় খাতের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সভা করে বাড়তি দামের ব্যাপারে ব্যাখ্যা চাচ্ছি। তাদের মতামত নিয়ে সরকারের কাছে দামের ব্যাপারে সুপারিশ করছি। কর্পোরেটদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। প্রতিযোগিতা কমিশন সেটা করেছে। কাজেই কর্পোরেটদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না সেটা বলা যাবে না।
বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ঈদের পর চাহিদা কম থাকার কথা, তাই বাজার অস্থির হওয়ার কোনো কারণ নেই। অথচ সরকার এডিবল অয়েলের দাম বাড়িয়েছে। সেক্ষেত্রে সাপ্লাইয়ের কোনো সমস্যা আছে কিনা- দেখতে হবে।
নিত্যপণ্যের বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দ্রব্যমূল্য মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই, এটাই বাস্তবতা। তিনি বলেন, এমন বাস্তবতায় মানুষের কষ্ট হচ্ছে। বিশেষ স্বল্প আয়ের বা নির্ধারিত আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। সুতরাং সাধারণ মানুষের আয় না বাড়লে তাদের জীবনমানের অবনতি হবে।
তিনি আরো বলেন, সরকারও দ্রব্যবমূল্যের লাগাম টানতে পারছে না। এজন্য আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট যেমন দায়ী, তেমনি অভ্যন্তরীণ যেসব নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন তা নিতে পারছে না। বিশেষ করে আর্থিক নীতি এবং মুদ্রানীতি।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি রোধ করতে মুদ্রানীতিতে যেসব পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন সেইসব পদক্ষেপ নিতে সরকার হয়তো সামর্থ নয়। অথবা কর্তৃপক্ষের যথাযথ উদ্যোগ নেই।
সর্বশেষ, গত ১ জানুয়ারি চিনির দাম বাড়িয়ে খোলা চিনির দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০৭ টাকা কেজি এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম নির্ধারণ করা হয়েছিলো ১১২ টাকা কেজি। এরপর দ্রব্যমূল্য ও বাজার পর্যালোচনা করে টাস্কফোর্স সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, পরিশোধিত খোলা চিনির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৪ টাকা কেজি। প্রতি কেজিতে দাম কমানো হয়েছে তিন টাকা।
গত ৪ এপ্রিল বোতলজাত সয়াবিন তেলের মূল্য ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ৫ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতলের দাম পড়বে ৯৬০ টাকা। অন্যদিকে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ৯ টাকা বাড়িয়ে ১৭৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর প্রতি লিটার খোলা পাম সুপার সয়াবিন তেল বিক্রি হবে ১৩৫ টাকা।
এর আগে, গত ডিসেম্বরে খুচরা পর্যায়ে সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ৫ টাকা কমিয়েছিল সরকার। এছাড়া পাম তেলের দাম ৪ টাকা কমানো হয়েছিল। সেই সময় প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৬৭ টাকা এবং বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৮৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ৫ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতলের দাম ছিল ৯০৬ টাকা। এছাড়া পাম তেলের দাম ৪ টাকা কমিয়ে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।