ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: বিশ্ববাজারে গমের দাম ৩ থেকে ৪ শতাংশ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের পাইকারী বাজারে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এতে কমে আসতে পারে দেশের আটা ও ময়দার দাম। এমনটাই মনে করছেন দেশের বাজার সংশ্লিষ্টরা।
দেশে গম আমদানির অন্যতম উৎস রাশিয়া ও ইউক্রেন। শস্য রফতানির জন্য কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো খুলে দিতে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় গত ২২ জুলাই একটি চুক্তিতে সই করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। এ চুক্তির ফলে খাদ্যশস্য নিয়ে জটিলতা কাটতে শুরু করেছে।
দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে গত দুই দিনের ব্যবধানে প্রতি মণ গমের দাম ১০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। খাতুনগঞ্জে বর্তমানে প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ভারতীয় গম বিক্রি হচ্ছে ১৪০০ টাকা দামে। যা গত সপ্তাহে ১৫০০ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে। সেই হিসেবে, চলতি সপ্তাহের প্রথম দুই দিনেই পণ্যটির দাম মণে ১০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।
অন্যদিকে মণপ্রতি ৮০ টাকা পর্যন্ত কমেছে কানাডা থেকে আমদানিকৃত গমের দামও।
এ ছাড়া বাজারে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা আটার দাম ২ হাজার ১শ’ টাকা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭শ’ টাকায়। খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়তে পারে আগস্টের মাঝামাঝি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবি’র হিসাব বলছে, গত এক বছরে আটা-ময়দার দাম বেড়েছিল ৫০ থেকে ৫৬ ভাগ। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত ময়দা ৬২ থেকে ৭০ টাকা এবং আটা ৪৮ থেকে ৫০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে।
এর আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতীয় গম ১৬৫০ এবং কানাডার গম ২১৫০ টাকায় ঠেকেছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের আগে (ফেব্রুয়ারি) প্রতি মণ ভারতীয় গম মাত্র ৯০০ টাকা এবং কানাডার গম ১১০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হতো।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর বন্ধ হয়ে যাওয়া কৃষ্ণসাগরের বন্দর দিয়ে শস্য রফতানি আগস্টের মাঝামাঝিতে আবার চালু হতে পারে। চুক্তি বাস্তবায়ন হলে ইউক্রেন থেকে সরাসরি বাংলাদেশে গম আসবে। এতে আমাদের গমভিত্তিক যাবতীয় খাদ্যের দামও কমতে শুরু করবে।
সূত্র জানিয়েছে, ভুট্টা ও ভোজ্যতেলের দামও কমবে। ইউক্রেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় সূর্যমুখী তেল রফতানিকারক দেশ। এ তেল বাজারে বেশি এলে সয়াবিন এবং পাম অয়েলের দাম কমবে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, ইউক্রেনীয় বন্দর-শহর ওডেসা থেকে একটি করিডোর খোলার ব্যাপারে মস্কো ও কিয়েভের সঙ্গে কাজ করছে আঙ্কারা। এর আগে মার্চে তুরস্কের ভূমধ্যসাগরীয় শহর আনতোলিয়াতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে বৈঠকের আয়োজন করে তুরস্ক।
এরই ধারাবাহিকতায় তুরস্কের ইস্তাম্বুল বন্দর খুলে দেওয়ার চুক্তি সই হয়।
এদিকে এ চুক্তি সইয়ের পর দেশের বাজারে আটা-ময়দার দাম আর বাড়েনি।
দেশের পাইকারি গম ব্যবসায়ীরা বলছেন, ছয় মাস আগেও দেশে প্রতি মণ গমের দাম ছিল মানভেদে ৯০০-১০০০ টাকা। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুরু হলে গমের দাম বাড়তে বাড়তে দ্বিগুণ অর্থাৎ মণপ্রতি ২ হাজার ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এতে দেশে আটা ও গমের দামও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। খাদ্যশস্য হিসেবে চালের পর দেশে গমের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকায় পণ্যটির মূল্যবৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
ব্যবসায়ীরা আরও বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন চুক্তিটি বাংলাদেশের অর্থনীতির পালে নতুন হাওয়া দেবে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপও কমবে। গমের দামের সঙ্গে চালের দামও জড়িত। তাই চাপ কমবে চালের ওপরও।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারের পাশাপাশি দেশীয় বাজারেও গমের দাম কমতে থাকায় শিগগিরই আটা ও ময়দার দাম কমে আসতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
জানা গেছে, এই মুহূর্তে ইউক্রেনে দুই কোটি টন গম মজুত আছে। রাশিয়ার মজুত আরও বেশি। তবে কেউই তা রফতানি করতে পারছে না। চুক্তির বাস্তবায়ন হলে ওই মজুত আসতে শুরু করবে বাজারে।
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা গণমাধ্যমকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই আমরা গম আমদানির বিকল্প দেশের সন্ধান করি। বেশি জাহাজভাড়া পরিশোধ করেও গম-ভুট্টা আমদানি করে বাজার স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছি। এখন রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে আমদানির সুযোগ ফেরার ফলে আমাদের মধ্যেও স্বস্তি কাজ করছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৪০ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে। অথচ এর আগের অর্থবছরে (২০২০-২১ সাল) দেশে গম আমদানির পরিমাণ ছিল ৫৪ দশমিক ৪৩ লাখ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে গম আমদানি হয়েছিল ৬৪ লাখ ৩৪ হাজার টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৫৬ লাখ ২৯ হাজার টন এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৫৮ লাখ ৮১ হাজার টন গম।