নিজস্ব প্রতিবেদক: বিশ্বব্যাপী বাজার পরিস্থিতি অস্থির। সে আঁচ লেগেছে বাংলাদেশেও। এর মধ্যে প্রকৃতিও আবার নেই অনুকূলে। বোরো মৌসুমের শুরুতে হাওর ডুবেছে আগাম বন্যায়। সে ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় অশনি। ঝড়-বৃষ্টি ব্যাপক ক্ষতি করে পাকা ধানের। আউশ মৌসুমেও হানা দিয়েছে বন্যা। এতে সারাদেশে ধানের স্বাভাবিক ফলন নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। আশঙ্কা তৈরি হয়েছে আমনের বীজতলা নিয়েও। রাশিয়া, ইউক্রেন ও ভারত থেকে বিশ্ববাজারে গমের সরবরাহ বন্ধের প্রভাব আগে থেকেই রয়েছে চালের ওপর।
সবমিলিয়ে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে দেশের খাদ্যনিরাপত্তায়। যে কারণে শুল্ক কমিয়ে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যদিও সরকার খাদ্যনিরাপত্তার কোনো ঝুঁকি অথবা শঙ্কার কথা বলছে না এখনো। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, বাজারে চালের দামে স্থিতিশীলতা ফেরাতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত বছরও এ সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ব্যবসায়ীদের। চলতি অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত যে পরিমাণ সিদ্ধ ও আতপ চাল বেসরকারি খাতে আমদানি হয়েছে, তার বেশিরভাগই শুল্ক সুবিধায় আনা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে দেশে খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। সে বিষয় বিবেচনায় রেখেই চালের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য শুল্ক কমিয়েছে সরকার। যেটা সোজা চোখে কার্যকর মনে হলেও বাস্তবে নয়
এ বিষয়ে খাদ্যসচিব ইসমাইল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, খাদ্যসংকট বা নিরাপত্তার শঙ্কা ভেবে এ শুল্ক সুবিধা নয়। সিলেটে বন্যা ও অন্যান্য কারণে উৎপাদন কিছুটা কমার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যার প্রভাবে বাজারে চালের দাম বাড়লে সেসময় তাৎক্ষণিক চাল আনা সম্ভব হবে না। এজন্য সরবরাহ সিস্টেম সচল রাখার জন্য এ সিদ্ধান্ত।
তিনি বলেন, বেসরকারি পর্যায়ে প্রাথমিকভাবে ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়ার চিন্তা রয়েছে আমাদের। ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বিবেচনা করে পরিমাণ চূড়ান্ত করা হবে।
গত বৃহস্পতিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আগামী চার মাসের জন্য চালের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ পুরোটা প্রত্যাহার করেছে। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রকমূলক শুল্ক ২৫ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। ফলে চাল আমদানিতে মোট করভার ৬২ শতাংশ থেকে কমে ২৫ শতাংশে এসেছে।
খাদ্যসংকট বা নিরাপত্তার শঙ্কা ভেবে এ শুল্ক সুবিধা নয়। সিলেটে বন্যা ও অন্যান্য কারণে উৎপাদন কিছুটা কমার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যার প্রভাবে বাজারে চালের দাম বাড়লে সেসময় তাৎক্ষণিক চাল আনা সম্ভব হবে না
এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে দেশে খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। সে বিষয় বিবেচনায় রেখেই চালের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য শুল্ক কমিয়েছে সরকার। যেটা সোজা চোখে কার্যকর মনে হলেও বাস্তবে নয়।
তিনি বলেন, শুল্ক কমালে ব্যবসায়ীরা চাল আনবেন কি না সেটি তার মজুত পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। চাল থাকলে আমদানির কারণে বাজারে দাম কমে যাক সেটা তারা চাইবেন না। সরকার মনে করছে টোটাল সাপ্লাই বাড়লে সেটা মানুষের কাছে যাবে। কিন্তু ধান-চালের হিসাব এত সোজা নয়।
আসাদুজ্জামান বলেন, এক নম্বর বিষয় হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের ভরসা করে তাদের মাধ্যমে দাম কমবে- এ ভাবনায় বসে থাকা ঠিক হবে না। তাদের সাপ্লাই বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই। তারা মুনাফা ছাড়া কিছুই করেন না। আরেকটি বিষয় হলো, আমদানির কারণে দাম কমে গেলে আবার কৃষক আগ্রহ হারাবেন। এটি একটি উভয় সংকট। সরকার কীভাবে মোকাবিলা করবে সেটা দেখার বিষয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিগত সময়ে দেশে যতবার খাদ্যসংকট বা দুর্ভিক্ষ হয়েছে, তার প্রধান কারণ ছিল ধানের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। আগে আমন থেকে সবচেয়ে বেশি খাবার আসতো, এ কারণে আমনের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে বাংলাদেশকে। এখন সবচেয়ে বেশি খাদ্য আসে বোরো থেকে। ২০১৭ সালে হাওরে বোরো বিপর্যয়ের পর চালের দাম বেড়েছিল অস্বাভাবিকভাবে। তখনো আমদানি করে ঘাটতি পূরণ করা হয়েছিল। এরপর ২০১৯ এবং ২০২১ সালে চাল আমদানি সুবিধা দেওয়া হয়।
দেশে বেশ কয়েক বছর থেকেই চালের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। শেষ বোরো মৌসুমে চালের দাম কম হবে এমন আশা ছিল অন্যান্য মৌসুমের মতো। তবে বোরো মৌসুমের চাল বাজারে আসা শুরুর পর দাম না কমে বরং বাড়তে থাকে। শুরুতেই ঢাকা, কুষ্টিয়া ও নওগাঁর পাইকারি বাজারে চালের দাম ধরন ভেদে কেজিতে দুই থেকে পাঁচ টাকা বেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে খুচরা বাজারেও। গত বছরের চেয়ে এবছর একই চাল কেজিতে ছয় থেকে আট টাকা বেশি দামে খেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
ভরা মৌসুমেও এমন পরিস্থিতি ঠেকাতে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রায় এক মাস ধরে দফায় দফায় অভিযান পরিচালনা করছে চালের বাজারে। এরপরও দাম কমেনি, উল্টো বেড়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এখন সরকারের কাছে ১৩ লাখ ৩৩ হাজার টন চাল মজুত রয়েছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছর সরকার ৬ লাখ ৮৪ হাজার টন চাল আমদানি করেছে।
আর বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা এই অর্থবছরে চাল আমদানি করেছেন তিন লাখ ছয় হাজার টন, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল সাত লাখ ৮৬ হাজার টন।
পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরও বেসরকারিভাবে চাল আমদানির জন্য দেওয়া শুল্ক সুবিধায় পর্যাপ্ত পরিমাণে চাল আমদানি হয়নি। ওই সময় বেসরকারি পর্যায়ে ১৭ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত আসে তিন লাখ টনের কিছু বেশি।
এদিকে কমানো শুল্ক হারে চাল আমদানির জন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী ১৭ জুলাই পর্যন্ত খাদ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে পারবে। বেসরকারিভাবে চাল আমদানির জন্য আবেদন ফরম তৈরি করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এ ফরমে সোমবার (২৭ জুন) থেকেই আমদানিকারকদের আবেদনের সুযোগ রাখা হয়েছে।