ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: মাত্র কয়েক দিনের ব্যাবধানে আবারও বেড়েছে লেয়ার মুরগীর ডিমের দাম। ডজনে বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। বর্তমানে রাজধানীতে লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা। অথচ ৫ দিন আগেও দাম ছিল ১২০ টাকা ডজন।
এর আগে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে ডিমের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যায়। প্রতি ডজন ডিম ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকায় উঠে। পাড়া-মহল্লার কোনো কোনো দোকানে তা ১৮০ টাকাতেও বিক্রি হয়। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানের পর ডিমের দাম কমে ১২০ টাকায় নামে। কিন্তু সপ্তাহ না যেতেই আবারো বেড়েছে এ ডিমের দাম।
শনি ও রবিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, সেগুনবাগিচা, ফকিরাপুল, শান্তিনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় এ চিত্র দেখা গেছে। বাজারে ডজনে ডিমের দাম বেড়েছে ১০/১৫ টাকা। বেশিরভাগ দোকানী ডিমের ডজন বিক্রি করছেন ১৩০ টাকা। তবে অভিজাত এলাকার দোকানগুলোতে ১৩৫ টাকা নেওয়া হচ্ছে। অথচ পাঁচদিন আগেও ডিমের ডজন ছিল ১২০ টাকা।
এদিকে ডিমের দাম বাড়ার জন্য পোল্ট্রি ফিডের দাম বাড়ার কারণকে দায়ী করছেন খামারিরা। তাদের মতে, নতুন করে খাদ্যের দাম বস্তায় বেড়েছে ১২৫ টাকা। যার কারণে সরকার নির্ধারিত দামে এখন আর বিক্রি করা সম্ভব নয়। কারণ ভোক্তা অধিদপ্তর প্রতি পিস ৮.৫০ টাকা নির্ধারন করে দিলেও বর্তমানে তার থেকে বেশি উৎপাদন খরচ পড়ছে।
এছাড়াও অঞ্চল ভেদে চাহিদা এবং উৎপাদনের উপর নির্ভর করেও দামের পার্থক্য রয়েছে, যা নির্ধারন করে দেয় ওই অঞ্চলের বড় কোম্পানিগুলো বা ব্যাবসায়ী সমিতি। আর সেই দামেই ডিম বিক্রি করতে হয় খামারিদের।
এবিষয়ে রাজশাহীর পাইকারি ডিম বিক্রেতা রাব্বি শেখ ভোক্তাকন্ঠকে বলেন, রাজশাহীতে বর্তমানে লাল ডিম ৮.৯০ টাকা এবং সাদা ডিম ৮.৫০ টাকায় ক্রয় করা হচ্ছে। তবে যারা দাদন (অগ্রিম টাকা) নেয় নাই তাদের কাছ থেকে লাল ডিম ৯ টাকা এবং সাদা ডিম ৮.৭০ টাকায় ক্রয় করছি।
এসময়ে রাব্বি শেখ বলেন, আমরা ক্রয় মূল্যের সাথে ১০-১৫ পয়সা করে যোগ করে ডিম বিক্রি করি। তবে ৪/৫ দিন আগে ৯.১০ টাকায় কিনেছি তবে এখন কমতির দিকে। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর ১১ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। ডিমের দাম বাড়ার জন্য পরিবহন খরচ বিষয় না, বিষয় হচ্ছে মুরগির খাদ্যের দাম।
রাজশাহীতে খুচরা ব্যাবসায়ীরা ভোক্তা পর্যায়ে লাল ডিম ৪০ এবং সাদা ডিম ৩৬ টাকা হালি বিক্রি করছে। তবে দাম বাড়ানো বা কমানোর পিছনে বড় বড় কোম্পানি গুলোর হাত রয়েছে বলে জানান রাব্বি।
টাঙ্গাইলের পাইকারি ডিম বিক্রেতা তৃপ্তি অর্গানিক ট্রেডার্সের জাকারিয়া পারভেজ বলেন, বর্তমানে লাল ডিম ৯.২০ টাকা বিক্রি করছি। তবে ৪/৫ দিন আগে ৮.২০ পয়সাও বিক্রি করেছি। তবে ফিডের দাম বাড়ার পর ডিমের দামও বেড়ে গেছে। কিন্তু খাদ্যের দাম বাড়লো কেন- সেই বিষয়ে সরকারের প্রদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
তিনি আরো বলেন, আমাদের কাছ থেকে ঢাকার পাইকাররা নিয়ে খুচরা দোকানে বিক্রি করে। তবে বড় ব্যাবসায়ীরা ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তেজগাঁওয়ের সমিতি (তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি) যে দাম নির্ধারন করে আমরা সেই দামে বিক্রি করি।
যশোরের পাইকারি ডিম বিক্রেতা ইকবাল খান বলেন, যশোরে লাল ডিম আকিজ গ্রুপের নিয়ন্ত্রাধীন আকিল পোল্ট্রি ফার্মের সাথে কম্প্রোমাইজ করে বিক্রি করতে হয়। তারা যখন যে দাম নির্ধারণ করে সেই দামে ছোট খামারিরাও বিক্রি করে। বর্তমানে এখানে লাল ডিম পাইকারি (দোকানীদের কাছে) ১০.৪০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। তবে সাদা ডিমের খামার যশোরে নেই।
অন্য অঞ্চলের চেয়ে যশোরে ডিমের দাম বেশি কেন? এমন প্রশ্নে ইকবাল বলেন, এটা অঞ্চল ভেদে কিছুটা দামের পার্থক্য থাকে। অর্থাৎ যে অঞ্চলে চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি সেই অঞ্চলে দাম কিছুটা কম থাকে। আবার যে অঞ্চলে চাহিদার চেয়ে উৎপাদন কম, সেই অঞ্চলে দাম বেশি থাকে। আর এই দামটা স্থানীয় ব্যাবসায়ী সমিতি নির্ধারন করে দেন। তবে বড় খামারিদের উপর নির্ভর করে দাম নির্ধারন করা হয়।
এসময়ে ইকবাল খান বলেন, আমাদের এখানে রাজশাহী, কুষ্টিয়া, পাবনা, ফরিদপুর অঞ্চল থেকে বেশি ডিম আসে। রাজশাহীতে যার কাছ থেকে ডিম ক্রয় করি আজকে তারা ৯.৪০ টাকা দাম চাচ্ছে। এর সাথে পরিবহন ভাড়া আরও ৪০/৫০ পয়সা যোগ করতে হয় এবং তার সাথে আরও ৩০/৪০ পয়সা যোগ করে খুচরা ব্যাবসায়ীদের কাছে বিক্রি করি। যশোর অঞ্চলে ভোক্তা পর্যায়ে ১১/১২ টাকা পিছ বা ৪৪ টাকা হালি লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রান্তিক পোল্ট্রি খামারী ঐক্য পরিষদের মহাসচিব কাজী মোস্তফা কামাল ভোক্তাকন্ঠকে বলেন, গত বুধবার থেকে মুরগীর খাবার কেজিতে ২.৫০ টাকা বেড়ে বর্তমানে ৫০ কেজির বস্তা কিনতে হচ্ছে ৩৪৫০ টাকা। অথচ ২০২১ সালের মার্চ মাসে একই বস্তার দাম ছিলো ২৪৫০ টাকা। দেশের সকল কোম্পানির ফিড একই দামে বিক্রি করা হয়। এখন এক বছরের ব্যাবধানে বস্তা প্রতি যদি হাজার টাকা বেড়ে যায়, তাহলে খামারিদেরও বাঁচতে হবে দাম বাড়িয়ে।
এসময়ে তিনি বলেন, ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে লেয়ার মুরগির ডিমের দাম ৮.৫০ টাকা নির্ধারন করে দিয়েছিলো। আমরাও সেই দামেই বিক্রি করছিলাম। কিন্তু ফিডের দাম বাড়ায় আর সম্ভব হচ্ছে না। কারণ দীর্ঘ দিন ধরে ডিম উৎপাদনের সাথে যুক্ত অভিজ্ঞদের হিসাবে প্রতিটি ডিম উৎপাদনে বর্তমানে ৯ টাকার মতো খরচ পড়ে যাচ্ছে। যার কারণেই ডিমের দাম কিছুটা বেড়ে গেছে।
অঞ্চল ভেদে ডিমের দামের পার্থক্য থাকে। বর্তমানে অঞ্চল ভেদে পাইকারদের কাছে লাল ডিম ৯.১০ টাকা থেকে ৯.৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। ঢাকায় পাইকারি বাজারে লাল ডিম ৯.৫০ টাকা, কুমিল্লায় ৯.৪০ টাকা এবং বরিশালে ৯.১০ টাকা, আবার কোথাও ৯ ৮০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। এটা চাহিদার উপর নির্ভর করে দামের পার্থক্য হয়। এছাড়াও আকিজ গ্রুপ, কাজী ফার্মসের মতো বড় কোম্পানিগুলোর উপরও দামের নিয়ন্ত্রণ থাকে, যোগ করেন মোস্তফা কামাল।
এর আগে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর থেকেই হু হু করে বেড়ে যায় ডিম সহ দৈনন্দিন পণ্যের দাম। তবে সব থেকে বেশি আলোচনায় ছিলো ডিম। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিবাদস্বরুপ কিছুদিন ডিম না খাওয়ারও ঘোষণা দেয় অনেকেই। অন্যদিকে ডিমের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে প্রয়োজনে ডিম আমদানি করা হবে বলে ঘোষণা দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনসী। এরপর সংবাদ সম্মেলন করে ডিম আমদানি না করার আহবান জানায় তেজগাঁও ডিম ব্যাবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি। এর পর পরই ডিমের দাম পড়তে থাকে এবং ১২০ টাকায় স্থির হয় ডিমের ডজন।