ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: মৌসুম শুরু না হতেই অসময়ে ‘অপরিপক্ক’ পাকা আম বিক্রি হচ্ছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন বাজারে। ‘গোবিন্দভোগ’ পরিচয়ে নগরের ফলমণ্ডি থেকে শুরু করে নানা মোড়, অলি-গলিতে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে এসব আম।
‘ক্যালেন্ডারের’ হিসাব অনুযায়ী, ওই আম বাজারে আসার কথা আরও সপ্তাহখানেক পরে। অতিরিক্ত লাভের কারণে ‘কার্বাইড’ দিয়ে পাকিয়ে এগুলো আগেভাগে বাজারে ছাড়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পুষ্টিবিদরা বলছেন, এসব আম (অপরিপক্ক) ‘কার্বাইড’ (রাসায়নিক পদার্থ) দিয়ে পাকানো হচ্ছে। যা বিষাক্ত পদার্থে রুপান্তরিত হয়। আর এতে জনসাধারণের স্বাস্থ্য বিশেষ করে লিভার ও কিডনি অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ভোক্তার অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, নির্ধারিত সময় না মেনে গাছ থেকে এসব আম পাড়া হয়েছে। প্রতিটি জাতের আম একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ‘পরিপক্ব’ হয়। ‘অতিরিক্ত লাভের’ আশায় ‘অপরিপক্ক’ আমগুলো বাজারে ছাড়া হয়েছে। জনসাধারণের স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় এটাও একটা ‘বড় অপরাধ’।
শনিবার চট্টগ্রাম নগরের ‘ফলমণ্ডি’ খ্যাত স্টেশনরোডে ফলের পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, অন্যান্য ফলের পাশাপাশি বেশির ভাগ দোকানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে আম। থরে থরে সাজানো এসব আম না কি সাতক্ষীরার ‘গোবিন্দভোগ’। তবে কিছু দোকানে ‘গোবিন্দভোগ’ ছাড়াও নওগাঁর বার্মিজসহ আরও তিন জাতের আম দেখা গেছে। যদিও তা অল্পসংখ্যক।
ফলমণ্ডির ফল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ জাকের বলেন, ‘আমের কথা বলতে গেলে সবাই জানে এখনো মৌসুম শুরু হয়নি। এর আগেই চাষিরা বাগান থেকে আম পাড়া শুরু করে দিয়েছেন। আমরা এখন পর্যন্ত চারটি চালানে আম পেয়েছি। এর মধ্যে ‘সাতক্ষীরার গোবিন্দভোগই’ বেশি ছিল।
তিনি বলেন, ‘মৌসুম হিসাবে এসব আম (গোবিন্দভোগ) আরও সপ্তাহখানেক পর বাজারে আসার কথা ছিল। এর আগেই ওই এলাকার চাষিরা আম তুলে বাজারে ছেড়ে দিয়েছেন।’
মৌসুমের আগে কেন চাষিরা আম বাজারে ছাড়েন সে বিষয়ে ব্যবসায়ী জাকের বলেন, ‘অনেকের চিন্তা-ভাবনা অনেক রকম। তবে অনেক চাষি বাড়তি লাভের আশায় ক্যালেন্ডার না মেনে আম পাড়া শুরু করেন।’
অপরিপক্ক এসব আমের স্বাদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘স্বাদ খারাপ না। তবে পুরোপুরি স্বাদের কথা বলা মুশকিল। আমের অরজিনাল (আসল) ঘ্রাণও অনেক আমে নেই বললেই চলে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, ‘সপ্তাহখানেক ধরে ফলমন্ডি বাজারে আমের চালান ঢুকছে। তবে এসব আম চাষি ক্যালেন্ডার না মেনেই পারা শুরু করেছেন।’
যে জাতের আমই হোক না কেন পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরা পর্যায়ে আমের দাম দ্বিগুণ। পাইকারিতে আমের দাম কেজিপ্রতি জাতভেদে ৮০ থেকে ১১০ টাকা। সেসব আম খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ২২০ টাকায়।
নগরের কর্ণফুলী নতুন ব্রিজ এলাকায় প্রতিকেজি ‘গোবিন্দভোগ’ আম বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায়। ফরিদুল নামে এক বিক্রেতা জানান, গত সপ্তাহখানেক ধরেই ‘গোবিন্দভোগ’ আম বিক্রি হচ্ছে। ‘মৌসুমের প্রথম আম; তাই দাম একটু বেশি’- বলেই দাবি তার।
পাইকারির সঙ্গে খুচরায় দামের দ্বিগুণ পার্থক্যের কথা জানালে আর কোনো কথা বলেননি এ বিক্রেতা। তবে এসব আম নির্ধারিত সময়ের আগে বাজারে আসার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমের সঠিক মৌসুম শুরু হতে আরও সময় আছে। মূলত মে মাসের মধ্যবর্তী সময়েই আমের মৌসুম শুরু হয়। ওই সময় থেকেই মূলত আম পাড়া শুরু করেন চাষিরা।’
তবে অপরিপক্ক আম হওয়ায় কম বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সোহেল চৌধুরী নামে এক বিক্রেতা। তিনি বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার ফলমণ্ডি বাজার থেকে এক ক্যারেট (২১ কেজি) গোবিন্দভোগ আম এনেছি। আজ তিন দিনে মাত্র চার কেজি আম বিক্রি হয়েছে।’
কারণ হিসেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেক ক্রেতা আমের দাম জিজ্ঞেস করে। পরে আবার কোন জাতের আম আর আমের নির্ধারিত সময় হয়নি বলে চলে যায়। আবার অনেকে দরাদরি করে নিয়ে যায়। তবে এখন আমের চাহিদা কম। হয়তো সামনে বাড়বে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আমের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, গোবিন্দভোগ আম বাজারে বিক্রির সময় ১৫ মে থেকে। চলবে ৩০ মে পর্যন্ত। এছাড়া, গোপালভোগ ২৫ মে থেকে ১০ জুন, রানিপছন্দ ১ থেকে ১৫ জুনের মধ্যে, ক্ষীরসাপাতি ৭ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত, ল্যাংড়া ১৫ জুন থেকে ১৫ জুলাই, হাঁড়িভাঙা ২০ জুন থেকে ৫ আগস্ট, আম্রপালি ২৮ জুন থেকে ২৫ জুলাই, সুরমা ফজলি ৩০ জুন থেকে ৩০ জুলাই, ফজলি ৫ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট এবং মোহনভোগ ৮ জুলাই থেকে ৩০ জুলাইয়ে।
চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আবদুচ ছোবহান বলেন, ‘ইতিমধ্যে স্থানীয় (চট্টগ্রাম অঞ্চল) জাতের আম পাকতে শুরু করেছে। অন্যান্য বিভাগের জেলার আমগুলো অর্থাৎ রাজশাহী, সাতক্ষীরাসহ, নওগাঁর আমগুলো এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। তবে গোবিন্দভোগ নামে যে আম এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে তা ‘অপরিপক্ক’। কেননা, আমের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী- এ মাসের (মে) মধ্যবর্তী বা ২০ তারিখের দিকে এসব পরিপক্ক হয়।’
পুষ্টিবিদ হাসিনা আক্তার লিপি বলেন, ‘মৌসুম যখন পরিপূর্ণ হয়ে যায়, তখন প্রাকৃতিক ভাবে আম পেকে আসে। তাই আর কোনো কিছু থাকে না। কিন্তু এখন তো অপরিপক্ক আমগুলো কার্বাইড মেডিসিন (রাসায়নিক পদার্থ) দিয়ে পাকানো হচ্ছে। আর মেডিসিন দিয়ে যেসব আম পাকানো হচ্ছে; তা পরিপূর্ণভাবে রসালো না। সেখানে বিষক্রিয়া প্রবেশ করেছে। এটা যখন খাওয়া হবে তখন এসব শরীরের জন্য ক্ষতি হবে। বিশেষ করে লিভার, কিডনি এসব অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
তিনি বলেন, ‘এখন আমরা যে আম বাজারে পাচ্ছি; তার জুস খেয়ে থাকি। সেসব জুস যে পানির ঘাটতি পূরণে খাওয়ার কথা তার সুফল তো পাওয়া যাচ্ছে না। কেননা, ওই আম পরিপক্ক না হওয়ার কারণে সেখানের ভেতরে যে রস থাকে তা আসল (প্রাকৃতিক) নয়। তাই এসব অপরিপক্ক আম অবশ্যই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।’
ক্যাবের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘বাজারে এখন যেসব আম বিক্রি হচ্ছে তা ‘অপরিপক্ক’। এ আমগুলো নির্ধারিত সময়ের আগেই বাজারে চলে আসছে। আর নির্ধারিত সময়ের আগে বাজারে আসার উদ্দেশ্য হলো- অতিরিক্ত মুনাফা বা লাভের জন্য। কিন্তু তারা (চাষি-ব্যবসায়ী) অতিরিক্ত লাভের চিন্তা করলেও, আসলে এটা জনসাধারণের জন্য কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত তা খেয়াল রাখা জরুরি, আর স্বাস্থ্যসম্মত না হলে এটাও একটা অপরাধ। আর স্বাস্থ্যের বিষয়টা আমাদের ক্রেতাদেরও মাথা রাখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আর সরকারের বিধিবিধানগুলো দেখে কখন থেকে আম বাজারে আসতে পারবে; সেগুলো দেখে প্রশাসনের বাজার তদারকি করা দরকার।’
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের বিভাগীয় উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ বলেন, ‘অপরিপক্ক আমের বিষয়টি শুনেছি। কীভাবে এসব আম (অপরিপক্ক) বাজারে এসেছে তা আমরা খতিয়ে দেখব। বাজারে অভিযান চালানো হবে।’