শেখ রিয়াল: বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। যা এখন নিন্মবিত্ত বা মধ্যবিত্তদের ধরা ছোয়ার বাইরে। ইলিশ মাছের দাম এখন আকাশ ছোঁয়া। যা কিনতে সাহস করাটাই এখন দুঃস্বপ্নের মতো। এক কেজি থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ মাছ ঢাকার খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০০০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকা দরে। জাটকা ইলিশও ৮০০ টাকার নিচে বিক্রি হচ্ছে না।
তবে জেলেরা আক্ষেপ করে বলেন, ক্রেতা চড়া মূল্য দিলেও ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। কয়েক দফা হাত বদলে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটেই চলে যাচ্ছে মাছের দামের সিংহ ভাগ মুনাফা।
এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দাদনের সুদ, জেলেদের নিজস্ব জলযান না থাকা, আড়তে পাইকারদের বিপুল পরিমাণ অর্থ লগ্নি দাম বৃদ্ধির মূল কারণ।
এদিকে, মধ্যস্বত্বভোগীদের এই সিন্ডিকেট না ভাঙতে পারলে ইলিশ মাছের খুচরা বাজারে স্বস্তি ফিরবে না বলে মনে করছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
ইলিশের মাছসহ অন্যান্য মাছের দাম বৃদ্ধিতে নিন্মবিত্ত বা মধ্যবিত্তদের পুষ্টিহীনতা নিয়েও চিন্তিত পুষ্টিবিদরা।
তবে ‘ইলিশ মাছের দাম এতো বেশি হবে কেন?’ এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। জেলেরা নিজেরাই কি বেশি দামে বিক্রি করছেন? না কি মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেটের কারণে দাম বাড়ছে?
অনেকেই বলছেন, ইলিশ প্রাকৃতিক ভাবেই বেড়ে ওঠে। যা উৎপাদনে কোনো খরচ হয় না। এমনকি ইলিশ অন্য কোনো দেশ থেকে আমদানিও করা হয় না। তবে দাম এতো হবে কেন?
এমন সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ইলিশের ল্যান্ডিং স্টেশন বা আড়ত হিসেবে পরিচিত বরিশাল, চাঁদপুর, বরগুনার পাথরঘাটা ও চট্টগ্রামের জেলে এবং ইলিশ মাছ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
যেভাবে ইলিশের দাম নির্ধারিত হয়
বরিশালে বিভিন্ন জেলে এবং আড়তদার বা দাদনদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘাটে ইলিশের ট্রলার কয়টা ভিড়লো এর উপর নির্ভর করে দাম কেমন হবে। যদি ইলিশের ট্রলার তুলনামূলক ভাবে কম ভেড়ে অর্থাৎ মাছের পরিমাণ কম থাকে তাহলে দাম বেড়ে যায়। আবার ইলিশের ট্রলারের সংখ্যা বেশি হলে অর্থাৎ মাছের পরিমাণ বেশি হলে দাম বেড়ে যায়। এছাড়া যেসব জেলে আগেই দাদন নিয়েছেন তারা নির্দিষ্ট আড়তে মাছ দিতে বাধ্য থাকেন। এতে করে ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয় জেলেরা।
জেলেরা জানান, আড়তদাররা যে দাম নির্ধারণ করেন সেই দামে তাদের মাছ বিক্রি করতে হয়।
বরিশালের আড়তদার জহির সিকদার ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘গত শনিবার (০২ সেপ্টেম্বর) পাইকারি বাজারে এক কেজি থেকে বেশি ওজনের ইলিশ মাছ প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে ৬৪ হাজার টাকায়। এতে প্রতি কেজিতে পড়েছে ১৬০০ টাকা, ৫০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশকে স্থানীয় ভাষায় এলসি বলা হয়। যা প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে ৫২ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজি পড়েছে ১৩০০ টাকা, এছাড়া ভেলকা (৫০০ গ্রামের নিচে) ইলিশ বিক্রি হয়েছে প্রতি মণ ৪৪ হাজার ও ছোট সাইজের (জাটকা) ইলিশের মণ বিক্রি হয়েছে ৩৪ হাজার টাকায়।’
তিনি বলেন, ‘ইলিশের ভরা মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকেই নগরীর পোর্ট রোডের মোকামে তেমন একটা ইলিশের দেখা মিলছে না। প্রতিদিন গড়ে ১০০ মণ ইলিশ আসছে। মাঝে মধ্যে ১৫০ মণ আসছে। তবে এর মধ্যে বেশির ভাগ ইলিশ সাগরের। নদীর মাছ তেমন একটা নেই বললেই চলে। এতে ব্যবসায়িক ভাবে মারাত্মক সমস্যায় পড়েছেন পোর্ট রোডের আড়তদাররা। অথচ গত বছর এ মৌসুমে মোকামে গড়ে ইলিশ এসেছে ৮০০ থেকে এক হাজার মণ করে।’
বরগুনার পাথরঘাটা ৫ স্টার মাছের আড়তের স্বত্তাধিকারী মো. মারুফ হোসেন ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘এক কেজির উপরের ইলিশ বিক্রি হয়েছে প্রতি মণ ৬৫ হাজার টাকা। এলসি ইলিশ প্রতি মণ ৪৫ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে।’
চাঁদপুরের চিত্র
চাঁদপুরের ইলিশ ঘাটের ব্যবসায়ীরা জানান, এ ঘাটে বর্তমানে ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি মণ ২২ হাজার টাকা, ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি ৮০০ টাকা, ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রামের ইলিশের কেজি ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা, ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজনের ইলিশ প্রতি মণ ৪৫ হাজার টাকা, ৯০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা, ১১০০ থেকে ১৩০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি মণ ৬৫ থেকে ৬৬ হাজার টাকা, দেড় কেজি ওজনের প্রতি মণ ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা, যার প্রতি কেজি ২২০০ থেকে ২৫০০ টাকা দরে পাইকারিতে বিক্রি করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামের চিত্র
চট্টগ্রামের ফিশারি ঘাট, রাসমণি ঘাট, আনন্দবাজার ঘাট, উত্তর কাট্টলি, দক্ষিণ কাট্টলি ও আকমল আলী ঘাটসহ সাগর উপকূলবর্তী এলাকায় ইলিশ বিক্রির ধুম পড়েছে। জেলার মীরসরাই, সীতাকুণ্ড, আনোয়ারা, বাঁশখালী এবং সন্দ্বীপ উপকূল এলাকায়ও প্রতিদিনই প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। রোববারও চট্টগ্রামের ঘাটগুলোতে প্রচুর পরিমাণ ইলিশ আসতে দেখা গেছে। তবে বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। এখন ঘাটেই বড় আকারের ইলিশ মণপ্রতি ৫০ থেকে ৫৬ হাজার টাকা, মাঝারি ৩২ থেকে ৩৬ হাজার, আর ছোট আকারের ইলিশ ২৬ থেকে ২৮ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ এক হাজার ৬০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা, আধা কেজির বড় ইলিশ ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা এবং আধা কেজির ছোট ইলিশ প্রতি কেজি ৫০০-৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
যা বলছেন জেলেরা
তবে এসব দাম থেকে জেলেরা কত টাকা পায় তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। জেলেরা এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জেলে বলেন, যেহেতু আগে থেকেই দাদন নেওয়া থাকে এবং নিজস্ব জলযান না থাকায় দাম দর করে মাছ বিক্রির সুযোগ নেই। আড়তদারা নামে মাত্র দাম দিয়ে কিনেন ইলিশ। তার পরেও যা পাচ্ছি তাতেই খুশি।
জানা গেছে, মাছ বিক্রির পর জেলেদের প্রাপ্য টাকা থেকে দাদনের সুদ হিসেবে ১০ শতাংশ রেখে দেয় ফরিয়ারা।
ইলিশ বিক্রিতে মধ্যস্বত্বভোগী কতজন?
ইলিশ মাছ বিক্রিতে জেলে থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌছাতে পাঁচ হাত বদল হয়। এর মধ্যে প্রথমে জেলে থেকে উপকূলীয় পাইকার বা আড়তদার বা দাদন দাতাদের কাছে বিক্রি হয়। তারাই মূলত প্রাথমিক ভাবে ইলিশের দাম নির্ধারণ করে। জেলেরা সাগর বা নদী থেকে মাছ ধরলে দাম নির্ধারণে তাদের তেমন ভূমিকা থাকে না। এরপর ঢাকাসহ সারাদেশ থেকে আসা পাইকাররা সেখান থেকে মাছ কিনে আনেন। সেখান থেকে ঢাকার বা সারাদেশের আড়তে আরেক হাত বদল হয়ে খুচরা ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছায় ইলিশ মাছ।
যেভাবে ইলিশের দাম বাড়ে
এক কেজি বা ১২০০ গ্রাম ওজনের একটি ইলিশের দাম বর্তমানে জেলেরা পায় ১১০০ থেকে ১২০০ টাকা। উপকূলীয় পাইকাররা প্রতিটি ইলিশ মাছে ২০০ টাকা লাভ রেখে ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা দরে বিক্রি করে। এর পর ঢাকার বা সারাদেশের পাইকাররা প্রতিটি মাছে আরও ১৫০ থেকে ২০০ টাকা লাভ করে বিক্রি করে ১৫৫০ থেকে ১৬০০ টাকা। ঢাকার আড়তে সেই মাছ খুচরা দোকানীদের কাছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি লাভে বিক্রি হয়। অর্থাৎ প্রতিটি মাছের দাম ১৮৫০ থেকে ১৯০০ টাকা। সেই মাছ খুচরা দোকানীদের কাছ থেকে ২১০০ থেকে ২২০০ টাকা দরে কিনছে ভোক্তারা। অর্থাৎ জেলে থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে ঢুকছে এক হাজার থেকে ১১০০ টাকা।
ঢাকার বাজারে ইলিশের দাম কত?
রাজধানী ঢাকার কাওরান বাজার, মালিবাগ কাঁচা বাজার, খিলগাঁও কাঁচা বাজার, ফকিরাপুল কাঁচা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ১১০০ গ্রাম থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২১০০ থেকে ২২০০ টাকা। এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম নেওয়া হচ্ছে ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকা, ৫০০ গ্রাম থেকে ৯০০ গ্রাম পর্যন্ত ইলিশের দাম নেওয়া হচ্ছে ১৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা।
কি বলছেন সংশ্লিষ্টরা?
ইলিশের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘আগে একটি ট্রলার মাছ শিকারে গেলে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ হতো। এখন সেখানে চার লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। ডিজেলের দাম বেড়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে শ্রমিকের মূল্যও। তবে যে পরিমাণ দাম হাঁকা হচ্ছে তা ঠিক নয়। এ জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অভিযান পরিচালনার অনুরোধ জানান। এতে করে দামটা সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের নাগালে থাকবে ইলিশ।’
যা বলছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘ইলিশ মাছ প্রাকৃতিক সোর্স থেকে আমরা আহরণ করছি। প্রাকৃতিক ইলিশ আহরণ ছাড়া এখানে কোনো দৃশ্যমান খরচ নেই। এরপরও চাষের সবচেয়ে ভালো মাছ রুই, কাতলের চেয়ে ভরা মৌসুমে ইলিশের মূল্য পাঁচ গুন বেশি। যা আমার কাছে অযৌক্তিক মনে হয়েছে। ইলিশের ল্যান্ডিং স্টেশন/আড়ত মূলত বরিশাল, চাঁদপুর, পাথরঘাটা। এসব এলাকার ইলিশের দাদন ব্যবসায়ীরাই এটির মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে মর্মে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। বাংলার ইলিশ ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা কেজি দরে কিনে খেতে হবে তা কারো কাছে কাম্য নয়। দ্রুতই ইলিশ মাছের বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
যা বলছেন পুষ্টিবিদ
পুষ্টিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যপক ড. লতিফুল বারী ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘এর স্বাভাবিক দাম বাড়লে সাধারণ মানুষ এটা কিনতে পারবে না। কারণ তা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। শুধু ইলিশ মাছ নয়, প্রতিটি খাদ্যদ্রব্যই তাই। এসব যদি কন্ট্রোল করতে না পারে তাহলে মানুষের পুষ্টির উপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। শুধু ইলিশ মাছই নয় নিন্মবিত্ত বা মধ্যবিত্ত্বরা এখন পাঙ্গাস মাছও কিনতে পারছেন না। তাহলে মানুষগুলো যাবে কোথায়? তাদের পুষ্টির অবস্থাটা কি হবে একবার ভাবুন। দাম যেভাবে বাড়ছে সেভাবে মানুষের আয় বাড়ছে না। সেভাবে তারা কিনতে পারছে না। এতে তাদের পুষ্টির উপরে প্রভাব পড়ছে। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুও পাচ্ছে না।