ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: বাজারে হঠাৎ বেড়েছে চালের দাম। রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে মানভেদে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে দুই থেকে চার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। চালের দাম বৃদ্ধির কারণ নিয়ে পাইকারি ব্যবসায়ী, চালকল মালিক, বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকরা বিপরীতমুখী ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে চালের কোনো ঘাটতি নেই। এই মৌসুমে প্রতি বছরই দাম বাড়ে। তাই এবারো বেড়েছে।
মিলাররা বলছেন, বাজারে চালের ঘাটতি রয়েছে। দাম আরও বাড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মত, দেশে চালের সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে। অন্যান্য পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
চাল ব্যবসায়ীরা সেই উৎসবে শামিল হয়েছে। আর সরকারি নীতি নির্ধারকরা বলছেন, দেশে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত চাল মজুত রয়েছে। দাম বাড়ার কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।
রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল ৫২ থেকে ৫৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও মোটা চালের কেজি ছিল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। অন্যদিকে প্রতি কেজি মাঝারি জাতীয় চাল বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫৬ টাকায়, আগে এই চালের দাম ছিল ৫২ থেকে ৫৫ টাকা। আর সরু চাল বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৭৫ টাকায়, কয়েকদিন আগেও এই চালের দাম ছিল সর্বোচ্চ ৭২ টাকা। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশও (টিসিবি) চালের দাম বাড়ার তথ্য দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নওগাঁ ও দিনাজপুরে মিল পর্যায়ে প্রতি বস্তা মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ২৪০০ টাকায়। সাত দিন আগেও যা ২২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি প্রতি বস্তা মাঝারি আকারের বিআর-২৮ জাতের চাল বিক্রি হয় ২৪০০ টাকায়। যা সাত দিন আগে ২৩০০ টাকা ছিল। আর প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হয় ৩২০০ টাকায়। আগে এই চাল ৩১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
চালের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিক কারণ বলতে পারছে না ব্যবসায়ীরা। তাদের কেউ বলছেন, চালের ঘাটতি আছে, কেউ বলছেন পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে।
রাজধানীর কাওরান বাজারের এম আর ট্রেডার্সের চাল বিক্রেতা আনিস খান বলেন, দাম বৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণ আমাদের জানা নেই। শুনেছি ধানের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চালের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে।
তিনি বলেন, প্রতি বছরই এই সময়ে চালের দাম বাড়ে। এ জন্য হয়তো এবারো বেড়েছে। ঈদের পর নতুন চাল উঠলে দাম কমতে পারে। এক সপ্তাহ আগেও ২৮ চালের পাইকারি মূল্য ছিল ৪৮ টাকা, সেই চাল এখন পাইকারিতে কিনতে হচ্ছে ৫২ টাকা দিয়ে। আর ২৮ চাল খুচরায় ৫৪ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে মিনিকেট চালের পাইকারি মূল্য আগে ছিল সর্বোচ্চ ৬৫ টাকা। এখন সেই চাল ৬৭ টাকায় কিনতে হচ্ছে। খুচরায় এই চাল বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৭২ টাকায়।
মেসার্স মতলব ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মতলব হোসেন বলেন, আমাদেরকে সরবরাহ সংকটের কথা বলা হচ্ছে। বস্তা প্রতি চালের দাম ১০০-২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। যে কারণে বেশি দাম দিয়ে ক্রয় করে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বড় কয়েকটি কোম্পানি। সরবরাহ সংকট দেখিয়ে কোম্পানিগুলো ইচ্ছেমতো জিনিসের দাম বৃদ্ধি করে। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
জনপ্রিয় রাইস এজেন্সির আমির হোসেন বলেন, বাজারে চালের কোনো ঘাটতি নেই। অর্ডার দিলেই চাল পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি বছরই এই সময় চালের দাম বাড়ে। তাই এবারো বেড়েছে। তাছাড়া চালের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণ দেখছি না।
নওগাঁ ধান-চাল আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোধ বরণ সাহা চন্দন বলেন, ধানের গড় উৎপাদন ঠিক ছিল। কিন্তু দেশের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ মানুষ যেসব চাল ব্যবহার করে সেগুলোর উৎপাদন পর্যাপ্ত ছিল না। এই চালের ঘাটতি রয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের কৃষি, খাদ্য, বিবিএসসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো ভ্যারাইটিজের কোনো হিসেব রাখে না। তারা গড় উৎপাদন হিসেব করে বলে থাকে যে দেশে চালের কোনো ঘাটতি নেই। বিআর-৯০ ও বিআর-৩৪ একই ধরনের ধানের জাত। বিআর-৩৪ সাধারণত চিনিগুঁড়া ধান হিসেবে পরিচিত। গত বছর এই ধান চাষ করে কৃষকরা অনেক পয়সা পেয়েছেন। এজন্য কৃষকরা এবার অধিকাংশ জমিতেই বিআর-৯০ ধান উৎপাদন করেছে। এ জন্য এই ধানের কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু দেশে স্বর্ণা-৫ ও গুটি স্বর্ণা ধানের উৎপাদন কম ছিল। দেশের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ মানুষ এই চাল ব্যবহার করে থাকে। ফলে উৎপাদন কম হওয়ায় চালের ঘাটতি রয়েছে বলে জানান তিনি।
তবে দেশে চালের ঘাটতি নেই বলে জানিয়েছেন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম। তিনি বলেন, দেশে চালের কোনো ঘাটতি নেই। সরকারি গুদামগুলোতে পর্যাপ্ত চালের মজুত রয়েছে। যে কারণে সরকার এবার বিদেশ থেকে চাল আমদানি বন্ধ রেখেছে। আমাদের গুদামগুলোতে ১৬ লক্ষ মেট্রিক টন চাল মজুত রয়েছে। চালের মূল্যবৃদ্ধি কিংবা অস্থিরতার কোনো তথ্য এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই। নির্বাচনের পরে কিছুদিন চালের বাজারে অস্থিরতা ছিল। এখন স্থিতিশীল রয়েছে। এছাড়া চালের দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, দেশে সবকিছুর দাম বাড়ানোর উৎসব চলছে। সেই উৎসবে শামিল হচ্ছেন চাল ব্যবসায়ীরাও। তাছাড়া চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। দেশে চালের কোনো ঘাটতি নেই।