ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: মাছ-মাংসের ঊর্ধ্বমুখী বাজারে কর্পোরেট সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এক পিস ডিমের দাম বাড়ানো হয়েছে পাঁচ টাকা। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ভোক্তাদের কাছ থেকে ১০ টাকার ডিম ১৫ টাকা বিক্রি করে কেবল আগস্ট মাসের ৭ দিনে ১২৫ থেকে ১৪০ কোটি টাকা অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে কর্পোরেট ব্যবসায়ীরাই মুনাফা করেছেন ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা।
কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোল্ট্রি, নারিশ ফিড, আফতাব বহুমুখী ফার্মস, বাংলাদেশ হ্যাচারি লিমিটেড, ফেরদৌসী পোলট্রি কমপ্লেক্স, মোল্লা পোলট্রি ফার্মস, আপন অ্যাগ্রো কমপ্লেক্স, নবীণ অ্যাগ্রো ফার্মস, খন্দকার পোলট্রি কমপ্লেক্স, ইউনাইটেড এগ্রো কমপ্লেক্স কোম্পানি ইত্যাদি।
প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিআইএ) ও বাংলাদেশ পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদ (বিপিকেআরজেপি)। ডিমের দাম বাড়ানো হয় এ দুই সংগঠনের ফেসবুক পেজ ও একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে।
সংগঠন দুটির ফেসবুক পেজে মো. শিমুল হক রানা নামের এক কর্মকর্তা প্রতিদিন কর্পোরেট মালিকদের সংগঠন- বিপিআইএ’র দাম আপলোড করেন। তার সেই দামের তালিকা মুহূর্তের মধ্যে দেশের সব পোলট্রি মালিকদের নজরে আসে। পরে তারা বিভিন্ন গ্রুপে ডিমের বর্ধিত দাম ছড়িয়ে দেন। সেই তালিকা অনুযায়ী তারা কেনা-বেচা করেন। ফেসবুক পেজের পাশাপাশি ডিমের নির্ধারিত দাম ‘অ্যাগ্রিকেয়ার টোয়েন্টিফোর.কম’ নামক ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়।
ভোক্তা ও বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দুই মাসে মুরগির খাদ্যের দাম কিংবা পরিবহন খরচ বাড়েনি। তারপরও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ডিমের দাম বাড়িয়েছে কর্পোরেট চক্রটি। ঠিক এক বছর আগেও একইভাবে কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়ানো হয়। ডিমের দাম বাড়ানোর কারণে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন কাজী ফার্মসসহ বেশি কয়েকটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে।
এবার দাম বাড়ার পর জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কারওয়ান বাজার, কাপ্তান বাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেছে। সেখানে দাম বাড়ার প্রমাণসহ ডিম কেনা-বেচার রসিদ না পাওয়ায় খুচরা ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের জরিমানা করেছে।
প্রতিদিনের মূল্য সমন্বয়ে প্রধান ভূমিকা রাখেন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিআইএ) মহাসচিব ও ইউনাইটেড অ্যাগ্রো কমপ্লেক্সের স্বত্বাধিকারী খন্দকার মুহাম্মদ মহসিন। তিনি ডিমের মূল্য বাড়ার কথা স্বীকার করেন।
খন্দকার মহসিন বলেন, ডিম কৃষিজাত পণ্য। কৃষিপণ্যের মূল্য ঠিক করে বাজার। আমরা চাহিদা অনুসারে প্রতিদিনের বাজার মূল্য প্রকাশ করি। এটিকে মূল্য নির্ধারণ বলা যাবে না। আমরা তো কাউকে এ দামে কেনা-বেচার জন্য বলি না। তেল, চিনির মতো খামারিদের কথা চিন্তা করে সরকার ডিমের মূল্য নির্ধারণ করে দিলে কোনো সমস্যা হতো না। খামারিরা ডিমের ন্যায্য মূল্য পেত। বাজার স্থিতিশীল থাকত।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও পোলট্রি কোম্পানির তথ্যমতে, দেশে প্রতিদিন সাড়ে তিন থেকে চার কোটি পিস ডিম খান মানুষ। জুলাই মাসে খুচরা বাজারে ডিম বিক্রি হয়েছে ১০ টাকা পিস। সেখান থেকে পাঁচ টাকা বেড়ে আগস্ট মাসে এক পিস ডিমের দাম দাঁড়িয়েছে ১৫ টাকা। দিনে চার কোটি ডিম বিক্রি হলে পাঁচ টাকা করে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা মুনাফা করেছেন ব্যবসায়ীরা।
এর মধ্যে কর্পোরেট ও কিছু খামারির মুনাফা হয়েছে আড়াই টাকা করে দিনে ৯ থেকে ১০ কোটি টাকা। সাত দিনে তাদের মুনাফা হয়েছে ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা। বাকি ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা মুনাফা করছে ডিলার বা আড়ৎদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুসারে ডিম ব্যবসায়ীরা কোনো কারণ ছাড়াই কারসাজির মাধ্যমে এক সপ্তাহে ১৪০ কোটি টাকা সাধারণ মানুষের পকেট থেকে অতিরিক্ত মুনাফা নিয়ে গেল।
তিনি বলেন, এই ব্যবসায়ীরা যে এবার প্রথম কারসাজির মাধ্যমে মুনাফা করেছে তা নয়, গত বছরে একই সময়ে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নিয়েছে একই কায়দায়, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ইচ্ছে করলেই ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে পারে, কমাতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এটি।
এখানেই তো থেমে নেই, বাজারে এখনো কারসাজি চলছে। ডিমের দাম তো কমছেই না। একটা কোনো ভাবেই যৌক্তিক না। বাজারে এই অবস্থার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরসহ বাজার মনিটরিং টিম দায়ী বলে মনে করেন তিনি।
যেভাবে বাড়ানো হয় ডিমের দাম
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কর্পোরেট চক্রটি কোরবানি ঈদের এক সপ্তাহ পর থেকে ডিমের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী খুচরা বাজারে গত ৭ জুলাই থেকে দাম বাড়াতে শুরু করে। খন্দকার মুহাম্মদ মহসিনের সংগঠন বিপিআইএ’র ফেসবুক পেজে গত ৬ জুলাই ডিমের দাম প্রকাশ করা হয় ৯ টাকা ৯০ পয়সা।
সেখানে বলা হয়, পোলট্রি পণ্য (ডিম ও মুরগি), আজকের খামারিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত মূল্য (টাকা) নিম্নরূপ- তারিখ : ০৬/০৭/২০২৩ ইং। এখানে বর্ণিত পোলট্রি পণ্যের মূল্য মূলত পোলট্রি খামারিদের প্রাপ্ত মূল্য। স্পেশাল কোয়ালিটির ডিম- ইউনাইটেড এগ (সেল পয়েন্ট) লাল ডিম ১০.৮০ টাকা (খুচরা), সাদা ডিম ৯.৮০ টাকা (খুচরা)। ডাম্পিং মার্কেট- (সাধারণ কোয়ালিটি) লাল (বাদামি) ডিম ৯.৯০ টাকা, সাদা ডিম ৮.৯০ টাকা।
পরের দিন অর্থাৎ ৭ জুলাই লাল ডিমের দাম ১০ পয়সা করে বাড়িয়ে ১০ টাকা করা হয়। সাদা ডিম বিক্রির জন্য ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৯ টাকা ১০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। পরের দিন ৮ জুলাই ডিমপ্রতি ২০ পয়সা বাড়ানো হয়। লাল ডিম বিক্রির জন্য নির্ধারণ করা হয় ১০ টাকা ২০ পয়সা। সাদা ডিম ৯ টাকা ৩০ পয়সা।
০৯ জুলাই ৩০ পয়সা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ১০ টাকা ৫০ পয়সা। সাদা ডিম নির্ধারণ করা হয় ৯ টাকা ৬০ পয়সা। একইভাবে ৩১ জুলাই খুচরা বাজারে লাল ডিমের দাম বাড়িয়ে করা হয় ১১ টাকা। সাদা ডিমের দাম নির্ধারণ করা হয় ১০ টাকা ৭০ পয়সা। অর্থাৎ ২০ দিনে প্রতিটি লাল ডিম ১ টাকা ১০ পয়সা করে বাড়ানো হয়।
দ্বিতীয় দফা অর্থাৎ ৩ আগস্টের পর থেকে ডিমের দাম বাড়াতে শুরু করে কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিপিআইএ। সংগঠনের কর্মকর্তা শিমুল হক রানা ১৩ আগস্ট গ্রুপটিতে লাল ডিমের দাম ৫০ টাকা হালি অর্থাৎ প্রতিটি ডিম ১২ টাকা ৫০ পয়সা করে নির্ধারণ করেন।
শিমুলের ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, পোলট্রি পণ্য (ডিম ও মুরগি), আজ খামারিদের প্রাপ্ত মূল্য (টাকা) নিম্নরূপ- তারিখ : ১৩/০৮/২০২৩ ইং। এখানে বর্ণিত পোলট্রি পণ্যের মূল্য মূলত পোলট্রি খামারিদের প্রাপ্ত মূল্য। ইউনাইটেড এগ (সেল পয়েন্ট) লাল ডিম ৫০ টাকা হালি, সাদা ডিম ৫০ টাকা হালি।
প্রতিদিন এ গ্রুপে মূল্যের তালিকা প্রকাশের পর ডিম বিক্রেতাদের শহর ও নগরের যত গ্রুপ রয়েছে সেগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই মূল্য অনুসারে ডিম কেনা-বেচা হয়। কর্পোরেট ব্যক্তিদের কাছ থেকে ডিলার, পাইকার ও খুচরা বাজারে ধাপে ধাপে ডিমের দাম বাড়তে থাকে। সর্বশেষ এ ডিম ভোক্তা পর্যায়ে ১৫ টাকা পিস হিসেবে কিনতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে কর্পোরেট গ্রুপের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী জাহিদুল হাসান ও প্যারাগন গ্রুপের কর্ণধার মশিউর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তারা রিসিভ করেননি।
কাজী ফার্ম, প্যারাগন, নারিশ গ্রুপই ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে- এমন অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার। তিনি বলেন, ‘কৃত্রিম ভাবে সংকট তৈরি করে গায়েবি এসএমএস-এর মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কর্পোরেট গ্রুপ। তারাই ডিমের দাম বাড়িয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রান্তিক খামারিদের ইচ্ছাকৃতভাবে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যেমন- আমাদের যখন ডিম ছিল, তখন কোম্পানিগুলো ইচ্ছা করে দাম কমিয়ে দেয়। এখন আমাদের হাতে ডিম নেই, দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।’
‘কর্পোরেট গ্রুপ কখনও বাজারে সংকট কমাবে না, তারা বাজারে সিন্ডিকেট করতে পারবে কিন্তু পণ্য দিতে পারবে না। কারণ, তাদের হাতে বাজারের পণ্য রয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ। ৮০ শতাংশ পণ্য রয়েছে প্রান্তিক খামারিদের হাতে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে হলে উৎপাদন খরচের ওপর ভিত্তি করে সরকারকে ডিমের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। তবেই প্রান্তিক খামারিরা বেঁচে থাকবেন।’
গরম ও ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণে খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে- উল্লেখ করেন সুমন হাওলাদার বলেন, ‘দেশে ২০ হাজার খামার রয়েছে। এর মধ্যে ১২ হাজার খামার চালু। গত এক বছরে আট হাজার খামার বন্ধ হয়েছে। ফলে ডিমের সংকট তৈরি হয়েছে। চাহিদার ওপর ভিত্তি না করে উৎপাদন খরচের বিষয়টি মাথায় রেখে দাম নির্ধারণ করলে ডিমের দাম বাড়বে না।’
মাগুরার প্রান্তিক খামারি ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘মাস দুয়েক আগেও ডিমের উৎপাদন খরচ ছিল ১১ টাকা। ডিম বিক্রি করেছি ১০ টাকা অর্থাৎ ১ টাকা লস। এখন একটু লাভ হয়েছে। আমার পরিচিত অনেক খামারি লস করতে করতে মুরগি বিক্রি করে দিয়েছেন।
ছয় বছর ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত- উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রান্তিক খামারিদের ন্যায্যমূল্য দিতে না পারলে বাজার কখনও স্থির হবে না। পণ্যের দাম কমবে, বাড়বে- এমন চিত্র চলতেই থাকবে।’
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী আমানত উল্লাহ বলেন, ‘মাছ-মাংসের দাম বাড়ায় এমনিতেই ডিমের ওপর চাপ বেশি। তারপর এখন বর্ষাকাল, সবজির দামও বেশি। সবমিলিয়ে ডিমের চাহিদা বেড়েছে। তাই দামও বেড়েছে। তবে, আমাদের পর্যাপ্ত উৎপাদন আছে, ঘাটতি নেই।’
দাম বাড়ানোর কারণ জানতে চাইলে পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মুহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘বেশকিছু দিন প্রচণ্ড গরম ছিল। খামারে অনেক মুরগি মারা গেছে। পাশাপাশি বৈরী আবহাওয়ার কারণে খাল-বিল, সাগর-নদী থেকে মাছ আহরণ কমেছে। বাজারজাতও কম হয়েছে। এছাড়া ভোক্তা-পর্যায়ে কিছু রুচির পরিবর্তন হয়েছে। বৃষ্টির কারণে এখন ডিম-খিচুড়ি খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। গ্রামীণ জনপদ থেকে ডিম আসা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সবকিছু মিলে ডিমের ঘাটতি ছিল। বাজারে ডিমের চাহিদা চার কোটি ৭০ লাখ। এমনিতে আমাদের উৎপাদন ৩০ থেকে ৩৫ লাখ কম ছিল। ফলে বাজার অস্থিতিশীল হয়েছে।
‘আবহাওয়া ঠিক হলে এমনিতেই বাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবে, ডিমের দামও কমতে থাকবে।’
ডিমের চাহিদা কত
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে দৈনিক ডিমের চাহিদা সাড়ে তিন থেকে চার কোটি পিস। পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সংগঠনগুলোর মতে, বর্তমানে দিনে চাহিদা রয়েছে চার কোটি ৭০ থেকে ৮০ লাখ পিসের। উৎপাদন হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ। বাকি ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ডিমের ঘাটতি রয়েছে।
এ ঘাটতির সুযোগে ব্যবসায়ীরা ডিমের দাম বাড়িয়েছেন। সরকারের তথ্য মতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ২৩৩৫ কোটি ৩৫ লাখ পিস ডিম উৎপাদন হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০৫৭ কোটি ৬৮ লাখ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৪৩৬ কোটি পিস ,২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ১৭১১ কোটি পিস। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৫৫২ কোটি পিস ডিম উৎপাদন হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বছর ডিমের উৎপাদন বাড়ছে।
ডিমের উৎপাদন খরচ
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলার সংকটসহ বিদ্যমান সমস্যার কারণে মুরগির খাবারের দাম বেড়েছে। ফলে খামারিদের দাবি এক পিস ডিমের উৎপাদন খরচ বর্তমানে ১১ টাকা। তবে, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মতে এ খরচ ১০ টাকা ২০ পয়সা। ব্যবসায়ীদের দাবি, গত দুই কিংবা তিন মাসের মধ্যে ডিমের দাম বাড়েনি।
মূল্য কম হওয়া উচিত
দেশের বাজারে বর্তমানে প্রতি পিস ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা। খামারিদের দাবি, উৎপাদন খরচ ১১টাকা। তারা খামার-পর্যায়ে প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১১ টাকা ৫০ পয়সায়। তাই খুচরা বাজারে ডিমের দাম সর্বোচ্চ ১৩ টাকা হওয়া উচিত। তবে, খামারিদের এ দাবি সত্য নয়- বলছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, খামার থেকে প্রতিটি ডিম কিনতে হচ্ছে ১২ টাকা ২০ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৫০ পয়সায়। তারা বেশি দামে ডিম বিক্রি করছে কিন্তু রসিদ দিচ্ছে না।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘জুলাই মাসে খামারিদের ডিমের উৎপাদন খরচ যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। আমরা দেখেছি, এ সময়ে মুরগির খাবারসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বাড়েনি। ফলে ধরে নিচ্ছি, আগস্টেও ডিমের উৎপাদন খরচ একই থাকবে। সুতরাং ডিমের দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।’
ডিম নিয়ে মন্ত্রীদের বক্তব্য
ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে না এলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেন, বাজারে ডিমের দাম কত হবে, তা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করে দিলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হবে। ডিমের বাজার হঠাৎ অস্থিতিশীল হওয়ায় ভোক্তা অধিকার রাজধানীর বিভিন্ন আড়তে অভিযান চালাচ্ছে এবং জরিমানা করছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, খামারি-পর্যায়ে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ সাড়ে ১০ টাকা। সবমিলিয়ে খুচরা-পর্যায়ে একটি ডিমের দাম ১২ টাকার বেশি রাখা ঠিক নয়। আমাদের সার্ভে অনুযায়ী, সাড়ে ১০ টাকা উৎপাদন খরচ। সেটি ১২ টাকায় বিক্রি হলে তারা প্রচুর লাভ করতে পারবে। এর বাইরে কেউ অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি করলে ভোক্তা অধিকার আইনের আওতায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
‘আমরা আশা করি, দাম ১২ টাকার মধ্যে রেখে তারা ডিম বিপণনের ব্যবস্থা করবেন।’
‘ডিম আমদানির বিষয়টি অন্য ভাবে আমরা বিবেচনা করব। এটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিবেচনা করবে কি করবে না, এটি তাদের… (বিষয়)। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, দেশে যে পরিমাণ উৎপাদন, বাজার ব্যবস্থার বিন্যাস করতে পারলে আমদানির প্রয়োজন হবে না’ বলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী।
ভোক্তাদের অবস্থা
গত রোববার মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পর ডিমের দাম পাইকারি পর্যায়ে ৩০ পয়সা কমেছে। কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে কমেনি। এখনও ফার্মের মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা হালি। অর্থাৎ এক পিস ডিমের দাম ১৫ টাকা। দেশি মুরগির ডিমের হালি বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা। হাঁসের ডিম বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা হালি। সোনালি মুরগির ডিমের হালি ৬০ টাকা।
রামপুরা বাজারে গার্মেন্টসকর্মী সাদিয়া আক্তার বলেন, সবজি ও মাছ-মাংসের দাম বাড়ায় বাধ্য হয়ে ডিম খেতে হচ্ছে। কিন্তু আজ এক হালি ডিম কিনলাম ৬০ টাকা দিয়ে। এখন তো ডিমও খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে। কেমনে চলব, সেই চিন্তা করছি।
মহাখালীর বাসিন্দা শামিম হাসান বলেন, ‘মাছ-মাংসের দাম বাড়ায় মাসে ২০ থেকে ২২ দিন ডিম খাওয়া হয়। সোমবার এক পিস ডিম কিনতে হয়েছে ১৫ টাকা করে। এক সপ্তাহ আগে ১১ টাকায় কিনেছিলেন। সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ৪ টাকা।’
মালিবাগ বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুস সামাদ বলেন, ‘আড়তদার ও বড় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ডিমের দাম বাড়িয়েছেন। গত বছরের ঠিক এ সময়ে ডিমের দাম ছিল ৮ টাকা পিস। আজ বিক্রি করছি ১৫ টাকা, অর্থাৎ দাম দ্বিগুণ বেড়েছে।’
সৌজন্যে, ঢাকা পোস্ট।