ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: গত সপ্তাহেও রংপুর নগরীর কাঁচা বাজারগুলোতে যে আলু সর্বোচ্চ ৪৫-৫০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছিল, তা রোববার নেমেছে সর্বনিম্ন ৩৬-৪০ টাকায়। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, এনএসআই’সহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কঠোর মনিটরিং ও ব্যবসায়ীদের সহনশীল মনোভাবের কারণে রংপুরে আলুর বাজারে কিছুটা স্বস্তির বাতাস বইছে।
বিক্রেতারা বলছেন, আলুর বাজার বড় বড় কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা নিয়ন্ত্রণ করে। এখন ভোক্তা অধিদপ্তরসহ প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থা মাঠে নামাতে সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে, এ কারণে দামও কমতে শুরু করেছে।
তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুরোনো আলুর মজুত আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে ফুরিয়ে যাবে। এ কারণে পুরোনো আলুর সরবরাহ কমানোর চেষ্টা করেছিল একটি চক্র। তবে এখন সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি হচ্ছে।
রোববার সকালে নগরীর সিটি বাজার, শাপলা চত্বর খান বহুমূখী মার্কেট ও কামাল কাছনা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রকারভেদে আলুর দাম কেজিতে ৫-১০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।
সিটি বাজারের পাইকারী বিক্রেতারা জানান, বর্তমানে সরকার নির্ধারিত মূল্যে তারা আলু বিক্রি করছেন। শনিবার সকাল থেকে সিটি কাঁচা বাজারে ৩৬ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি শুরু হয়। এর আগে শহরের বিভিন্ন কোল্ড-স্টোরেজ থেকে আলু সরকারি মূল্যে সরবরাহ করা হয়।
সিটি বাজারে পাইকাররা কার্টিনাল আলু ৩৫-৩৬ টাকা কেজি, শিল আলু ৪৭-৪৮ টাকা, ঝাউ ৫৪-৫৫ কেজি বিক্রি করছেন। এছাড়া পেঁয়াজ (এলসি) ৩৬ টাকা এবং দেশি পেঁয়াজ ৬৫ টাকা, মরিচ ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
লাকী ভান্ডারের শুকুর আলী জানান, সরকার আলুর বাজারে লাগাম টেনে ধরায় বাজারে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। তবে বড় বড় কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা এখনো তাদের জিম্মি করার চেষ্টা করছে।
এদিকে, খুচরা বাজারে কার্ডিনাল আলু ৩৮-৪০ টাকা, সাদা দেশি আলু ৫০-৫২ টাকা এবং ঝাউ ৫৫-৬০ টাকা, শিল আলু ৫০-৫৫ টাকা টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এসব আলুর আকার ও ধরণ ভেদে দাম উঠানামা করছে বলেও জানিয়েছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।
শাপলা চত্বর খান বহুমূখী মার্কেটের সবজি বিক্রেতা আনাম ইসলাম জানান, এখন সরকার নজরদারি বাড়িয়েছে, এ জন্য পাইকাররাও দাম কমিয়েছে। আমরা ৩৬ টাকা কেজিতে আলু কিনে সেটা ৩৮-৪০ টাকা কেজি বিক্রি করছি।
কামাল কাছনা বাজারের সবজি বিক্রেতা আনোয়ার জানান, পাইকারি বাজারে ৩৫-৩৬ টাকা দরে আলু কিনে ৪০ টাকার বেশি বিক্রি না করলে খুচরা ব্যবসায়ীদের লোকসান হবে। এ কারণে আলু কেনা আপাতত বন্ধ করেছি। আগের কিছু আলু আছে সেগুলো সামান্য লাভে বিক্রি করছি।
নগরীর এরশাদ মোড় কাঁচাবাজারে আসা রাজু আহম্মেদ জানান, কার্ডিনাল আলুর দাম সামান্য কমেছে। কিন্তু অন্যান্য আলুর দাম তেমন কমেনি। বড় বড় ব্যবসায়ীদের শক্ত ভাবে ধরতে পারলে বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তেমন জোরালো পদক্ষেপ না থাকায় ব্যবসায়ীরা এখনো সিন্ডিকেট করার সুযোগ পাচ্ছে। তিনি ওই বাজার থেকে পাঁচ কেজি শিল আলু (বড় আকার) ২৮০ টাকায় কিনেছেন।
রংপুর সিটি কাঁচা বাজার সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাবু জানান, কিছুদিন আগে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এসেছিলেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তাঁর সঙ্গে আমাদের মিটিং হয়েছে। এরপর কোল্ড স্টোরেজ এসোসিয়েশনের মালিক এবং ব্যবসায়ী নেতা যারা রয়েছেন সবাই মিলে আমরা সরকারের বেধে দেওয়া দামে আলু বিক্রি শুরু করেছি। একজন ক্রেতাকে সর্বোচ্চ পাঁচ কেজির বেশি আলু দিচ্ছি না। সিটি কাঁচা বাজারে প্রতিদিন ২০০ থেকে আড়াইশ বস্তা আলুর প্রয়োজন হয়।
রংপুর জেলা প্রশাসন জানায়, রংপুর এর বিভিন্ন বাজারের খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ৩০ টাকায় আলু সরবরাহ ও ক্রেতাদের কাছে ৩৬ টাকায় বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনের নির্দেশনায় কোল্ড স্টোরেজগুলো এই কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন কোল্ড-স্টোরেজ এই কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, প্রতি কেজি আলুতে উৎপাদন খরচ সাড়ে ৯ টাকা, হিমাগার ভাড়া ৬ টাকা, বস্তার মূল্য ১.৪০ টাকা, পরিবহন, লোডিং আনলোডিং এক টাকা এছাড়া ওজন, ব্যাংক ঋণের সুদ ও অন্যান্য ব্যয় ১.৬০ টাকা ধরে মোট খরচ ১৯.৫০ টাকা। অথচ মৌসুমের শেষে এসে সেই আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা ছাড়িয়েছে। তবে কয়েকদিন ধরে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কঠোর মনিটরিংয়ের কারণে আলুর দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে।
জাতীয় কৃষক সমিতির সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, মৌসুমের শুরুতে আলু ১০ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হন কৃষকরা। সেই আলু চার মাসে কয়েক হাত ঘুরে সিন্ডিকেটের ফাঁদে পড়ছে। আর সিন্ডিকেট চক্রই বেশি মুনাফার আশায় দাম বাড়িয়ে ক্রেতার পকেট কাটছে। দেরিতে হলেও সরকার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে মনিটরিং করছে। আমরা চাই সকল পণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান অব্যাহত থাকুক।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান জানান, শনিবার থেকে ৩৬ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবগুলো বাজারেই হবে। কেউ সরকার নির্ধারিত মূল্যের বাইরে বিক্রি করতে পারবে না। এটা আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সবগুলোকে বাজারে একযোগে ৩৬ টাকা কেজিতেই আলু বিক্রি হবে।
সরকার আলুর দাম বেঁধে দেয়ার পরই সিন্ডিকেট ভাঙতে মাঠে নেমেছে ভোক্তা অধিদফতর। চলতি মাসে আলুর অবৈধ মজুদসহ বাজার নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালিয়ে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু তারপরও কয়েকজন অসাধু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমছে না।
ভোক্তা অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক আজহারুল ইসলাম জানান, সরকারের বেঁধে দেয়া দাম নিয়ন্ত্রণে মাঠে কাজ করছি আমরা। রংপুরের হিমাগারগুলোতে মজুদদারদের সতর্ক করে আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে। নির্দেশনা না মানলে আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।