ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজে লাগা আগুনের প্রভাবে চট্টগ্রামে খাতুনগঞ্জে প্রতি মণ চিনির দাম বেড়েছে ৬০-৭০ টাকা। যদিও বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছিলেন, এস আলম গ্রুপের চিনি কারখানায় আগুন লাগলেও বাজারে চিনির সরবরাহ ও দামে কোনো সমস্যা হবে না।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, এস আলম গ্রুপের মিলে আগুন একটি দুর্ঘটনা। এ সুযোগকে পুঁজি করে ঢাকার মিল মালিকরা চিনির দাম বাড়াচ্ছেন। বড় মিল মালিকরা সরবরাহ কমিয়ে সংকট তৈরি করলে পাইকারি কিংবা খুচরা উভয় বাজারে প্রভাব পড়বে।
এর আগে রোববার বিকেল পৌণে ৩টার দিকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানাধীন ইছানগর এলাকার এস আলম সুগার রিফাইন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানায় আগুন লাগে। চিনির কাঁচামালের গোডাউন আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুনে প্রায় এক লাখ টন ‘র’ চিনি পুড়ে গেছে বলে দাবি করেছে এস আলম গ্রুপ। বর্তমানে কারখানায় চিনির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকার একটি হোটেলে এক সভা শেষে সংবাদিকদের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, আমাদের একটি সুগার মিলে আগুন লেগেছে। এটি দুঃখজনক ঘটনা। এ আগুন পুঁজি করে কেউ ব্যবসা করতে পারবে না।
তবে মন্ত্রীর কথার পরেও খাতুনগঞ্জের বাজারে চিনির দাম বেড়েছে। খুচরা বাজারের মুদি দোকানেও চিনি হাওয়া হয়ে যায়।
নগরীর কাজীর দেউড়ি এলাকার মুদি দোকানি দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা ব্যাটারি গলির একটি মুদির পাইকারি দোকান থেকে চিনি এনে বিক্রি করি। আজ ওই দোকানে পাইকারি চিনি পাওয়া যায়নি। দামও বেড়েছে।’
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘এস আলম সুগার মিলে আগুন লাগার পর খাতুনগঞ্জের চিনির দাম বেড়ে গেছে। সোমবার রাতেই রেডি চিনিতে প্রতি মণে ২০ টাকা বেড়েছে। সোমবার দুপুরে এস আলমের রেডি চিনি বিক্রি হয়েছে মণপ্রতি পাঁচ হাজার ৫০ টাকা। সোমবার এ চিনি ছিল প্রতি মণ চার হাজার ৯৭০ টাকা। একইভাবে ঢাকার মেঘনা ও ফ্রেশ চিনির দামও একই হারে বেড়েছে।’
জানা যায়, খাতুনগঞ্জে এস আলমের পাশাপাশি সিটি ও মেঘনা গ্রুপের চিনি এবং ভোজ্যতেল কেনাবেচা হয়। এমনিতেই গত এক বছরের ব্যবধানে প্রতি মণ চিনিতে এক হাজার টাকা দাম বেড়েছে। ২০২৩ সালের মার্চ মাসের শুরুতে চিনির ডিও মূল্য ছিল তিন হাজার ৯৫০ থেকে তিন হাজার ৯৬০ টাকা। রেডি চিনি কিনতে প্রতি মণে আরও ২০-৩০ টাকা বেশি গুনতে হয় পাইকারি খরিদদারদের।
সোমবার খাতুনগঞ্জে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ চিনির ডিও বিক্রি হয় মণপ্রতি ৪৯০০ টাকা। সিটি গ্রুপের চিনি বিক্রি হয়েছিল চার হাজার ৯২০ টাকা। মঙ্গলবার ফ্রেশ বিক্রি হয়েছে চার হাজার ৯৩৫ টাকা এবং সিটি চার হাজার ৯৫৫ টাকায়। এসব চিনি সরবরাহ নিতে কারখানায় তিন দিন আগে সিরিয়াল নিতে হয় বলে জানান খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। দামে কম হলেও সিরিয়ালসহ পরিবহন ব্যয়ের কারণে এস আলম চিনির চেয়ে বেশি খরচ পড়ে মেঘনা ও সিটি গ্রুপের চিনিতে।
সূত্রে জানা যায়, দেশে বছরে কমবেশি ১৮ থেকে ২০ লাখ টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলো থেকে আসে ২৫ থেকে ৫০ হাজার টনের মতো। অবশিষ্ট চিনি আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। দেশের চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর প্রায় ৯৮ শতাংশের বেশি চিনি আমদানি করতে হয়। দেশে ব্যক্তিখাতের পাঁচ শিল্পগ্রুপ সিটি, মেঘনা, এস আলম, আবদুল মোনেম লিমিটেড ও দেশবন্ধু সুগার মিল অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে। পরে নিজেদের মিলে পরিশোধন করে এসব চিনি বাজারজাত করা হয়।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের ০১ জুলাই থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ মাসে পাঁচ আমদানিকারক ১১ লাখ ৭৪ হাজার ৭৭৬ টন ‘র’ চিনি আমদানি করেছে। এর মধ্যে আবদুল মোনেম সুগার এক লাখ ১৮ হাজার ৭৭৫ টন, সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ তিন লাখ ৪৩ হাজার ১৩৮ টন, দেশবন্ধু সুগার মিলস ৯৭ হাজার ৪৫৫ টন, মেঘনা সুগার রিফাইনারি তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৬ টন এবং এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ দুই লাখ ৭৪ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই আমদানিকারকরা ১৮ লাখ ২৭ হাজার ১৯৪ টন চিনি আমদানি করেছিল।
খাতুনগঞ্জের ভোজ্যতেল ও চিনির বড় ব্যবসায়ী আর এম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ বলেন, ‘এস আলম সুগার মিলে আগুন লাগাটা একটি দুর্ঘটনা। তার মানে অন্য মিলগুলোতে চিনির সংকট হওয়ার কথা নয়। সব মিলেই চিনি রয়েছে। এখন এস আলমের মিলে আগুন লাগার সুযোগ নিচ্ছে ঢাকার মিলগুলো। তারাই সরবরাহ কমিয়ে বাজারে সংকট তৈরি করছে।’
তিনি বলেন, ‘খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীদের হাতে চিনির বাজার নেই। এখানকার ব্যবসায়ীরা চিনির দাম বাড়াতে-কমাতে পারেন না। মূলত ঢাকার মিলাররা দাম বাড়িয়ে দিলে খাতুনগঞ্জেও দাম বাড়ে। এখন সরকারের উচিত ঢাকার মিলগুলো থেকে চিনির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা।’
এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘সামনে রমজান আসছে। ঢাকার মিলাররা চিনির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখলে শুধু খাতুনগঞ্জ কেন দেশের কোথাও চিনির সংকট হওয়ার কথা নয়। দামও বাড়বে না।’
গুদামে আগুন লেগে এক লাখ টন অপরিশোধিত চিনি পুড়ে যাওয়ার কথা বললেও রোজা সামনে রেখে চিনির বাজারে কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছে এস আলম গ্রুপ। মঙ্গলবার দুপুরে এস আলম গ্রুপের জিএম (কমার্শিয়াল) মো. আকতার হাসান বলেন, ‘আগুনে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি কত, তা বলতে পারবো না। সেটা এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে নিশ্চিত করতে পারি, বাজারে কোনো প্রভাব পড়বে না। আমাদের এখনো ১০-১৫ দিনের মতো ফিনিশড (পরিশোধিত) চিনি হাতে আছে।’