ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: গত ১৪ বছরে ১৪ বার পানির দাম বাড়িয়েছে ঢাকা ওয়াসা। এবারও দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এজন্য কারিগরি সমীক্ষা শেষ করেছে সংস্থাটি। এবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এমনিতেই মূল্যস্ফীতি চেপে বসে আছে সবার ঘাড়ে, পানির দাম বাড়ানো হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। সবকিছুতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে একরকম নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে তারা। কিছু প্রক্রিয়া শেষ করে নতুন দাম ঘোষণা করা হবে।
জানা গেছে, রাজধানীর গ্রাহকদের পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করে এবার পানির দাম নির্ধারণ করা হবে। নিম্ন, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত- এ পাঁচ শ্রেণিকে আলাদা আলাদা দামে পানি সরবরাহ করবে ওয়াসা। দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড-২০০০ অনুসরণ করা হবে। অর্থাৎ যিনি যত বেশি বর্গফুট আয়তনের বাড়িতে থাকেন, তাকে তত বেশি বিল পরিশোধ করতে হবে।
এরই মধ্যে এলাকাভিত্তিক পানির দাম নির্ধারণ বিষয়ক কারিগরি সমীক্ষা করেছে সংস্থাটি। গ্রাহকদের পাঁচ শ্রেণিতে ভাগ করে দাম নির্ধারণ করতে প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক মৌজার দর, গৃহকর, ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড এবং মাসিক আয়ের বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
ঢাকা ওয়াসার কারিগরি সমীক্ষার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যারা ২৫০০ বর্গফুট আয়তনের বাসায় থাকেন তাদের উচ্চবিত্ত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৫০০ থেকে ২৫০০ বর্গফুটের কম আয়তনের বাসায় যারা বসবাস করছেন তারা উচ্চ মধ্যবিত্ত। ১০০০ থেকে ১৫০০ বর্গফুটের কম আয়তনের বাসায় যারা বসবাস করছেন তারা মধ্যবিত্ত এবং ১০০০ বর্গফুট আয়তনের নিচের বাসায় যারা বসবাস করছেন তারা নিম্নবিত্ত। আর বস্তিবাসীদের নিম্ন আয়ের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
জানা গেছে, পানির বর্তমান দামের তুলনায় ২৪ থেকে ১৪৭ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
ঢাকা ওয়াসার দাবি, গ্রাহক যে দামে বর্তমানে পানি পাচ্ছে তার চেয়ে উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। ভর্তুকি দেওয়ার মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে পানি দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি এক হাজার লিটার পানিতে ঢাকা ওয়াসাকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে প্রায় ১০ টাকা। মূলত ভর্তুকি কমাতেই পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ওয়াসা আইন ১৯৯৬ এর ২২ (২) ধারা অনুযায়ী ওয়াসা বোর্ড প্রতিবছর পানি ও পয়ঃঅভিকর সমন্বয় করতে পারে।
এর আগে বিভিন্ন সময় পানির দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে সমালোচনার মুখে পড়ে ঢাকা ওয়াসা। নানামুখী সমালোচনার পর ওয়াসার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পানির দাম সমন্বয় ওয়াসার একটি রুটিন প্রক্রিয়া। ঢাকা ওয়াসা আইন অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে পানির দাম আংশিক সমন্বয় করে মাত্র। পানির দাম বাড়ানো-কমানোর ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে ওয়াসা আইন ১৯৬৬ মোতাবেক ওয়াসা বোর্ডের। নগরবাসীর সুষ্ঠু টেকসই ও উন্নত গ্রাহক সেবা প্রদানের স্বার্থে ঢাকা ওয়াসা প্রতিবছরই এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে।
বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি ১০০০ লিটার পানির দাম দিতে হয় ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। নতুন যে দাম প্রস্তাব করা হয়েছে সে অনুযায়ী, প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম নিম্নবিত্তদের জন্য পড়বে ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা। মধ্যবিত্তদের জন্য ২৫ টাকা, উচ্চ মধ্যবিত্তদের জন্য ৩১ টাকা ২৫ পয়সা এবং উচ্চবিত্তদের জন্য ৩৭ টাকা ৫০ পয়সা দাম পড়বে। তবে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য অর্থাৎ বস্তিবাসীর জন্য আগের দামই থাকতে পারে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে, ঢাকা ওয়াসার বাণিজ্যিক গ্রাহকদের বর্তমানে প্রতি ১০০০ লিটার পানির মূল্য দিতে হচ্ছে ৪২ টাকা। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী তাদের দিতে হবে ৫০ টাকা।
বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার গ্রাহক প্রায় ৪৩ লাখ ৮৮ হাজার। প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার নতুন গ্রাহক তৈরি হয়। ওয়াসার মোট গ্রাহকের সাড়ে ১১ শতাংশ বাণিজ্যিক গ্রাহক।
নতুন করে পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে জানতে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান এবং ঢাকা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (পরিচালক ও রক্ষণাবেক্ষণ) এ কে এম সহিদ উদ্দিনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা ওয়াসার এক কর্মকর্তা বলেন, নতুন পদ্ধতিতে পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে মাত্র। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। এলাকা ভেদে এবং আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনা করে নতুন পদ্ধতিতে পানির দাম বাড়ানোর পক্ষে ঢাকা ওয়াসা। গ্রাহকদের যেন খুব বেশি সমস্যা না হয় সে দিকগুলো বিবেচনা করা হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা ওয়াসা গ্রাহকদের ওপর অযৌক্তিকভাবে দাম চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। এমনিতেই অন্যান্য ওয়াসার চেয়ে ঢাকা ওয়াসা পানির দাম বেশি নিচ্ছে। এরপর আবার দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনা অযৌক্তিক। ধনী-গরিব কারও ওপরই বাড়তি ব্যয়ভার চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। তাদের এই নতুন পদ্ধতি অযৌক্তিক এবং এতে অস্বচ্ছতা রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় রাজধানীর বনশ্রীর ডি ব্লকের একটি বাড়ির মালিক শাহিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি ঢাকা ওয়াসার এমন পরিকল্পনার সমালোচনা করে বলেন, গরমের সময় ঠিকমতো ওয়াসার পানিই পাই না। টাকা দিয়েও পানি পাওয়া যায় না। তারপরও মাস গেলে ঠিকই বিল দিতে হয়। বর্তমানে আমরা পানির যে দাম পরিশোধ করি এটাই তো অনেক বেশি। ফের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অযৌক্তিক এবং স্বেচ্ছাচারিতা। এমনিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এর মধ্যে পানির দাম বাড়ালে আমরা কীভাবে কী করব?
বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, গতবার ঠিক একই সময়ে ঢাকা ওয়াসা পানির মূল্য বৃদ্ধি করতে চাইলে আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। পরে তারা ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। আমাদের দাবি ছিল শতভাগ সুপেয় পানি নিশ্চিত না করে মূল্য বৃদ্ধি করা যাবে না।
তিনি বলেন, ওয়াসা কর্তৃপক্ষ আমাদের জানিয়েছে নিম্নবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত এলাকায় একই মূল্য থাকতে পারে না। তাই মূল্যের একটি সমন্বয় দরকার। কিন্তু এর মানে এই নয় যে সামগ্রিকভাবে মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া হবে। সবার জন্য যদি মূল্যবৃদ্ধি করা হয় তাহলে মূল্যস্ফীতির এই সময়ে তা সাধারণ নাগরিকদের দুর্ভোগ আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই ওয়াসার জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করে দুর্নীতির লাগাম না টেনে এভাবে মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। ঢাকা পোস্ট।