এক লোকের প্রতিবেশীর সাথে মারাত্মক ঝামেলা। সেই লোকটি একদিন কিভাবে যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়ে গেল। চেরাগ ঘষতেই যথারীতি দৈত্য হাজির।
দৈত্য দুটি শর্ত দিয়ে বসলো। প্রথমত, তিনটি মাত্র বর চাওয়া যাবে আর দ্বিতীয় শর্তটি হচ্ছে, যে বরই চাওয়া হোক না কেন, প্রতিবেশী পাবে তার দ্বিগুণ। কিছুক্ষণ চিন্তা করে লোকটি দৈত্যেকে বললো, তার একটি চোখ অন্ধ করে দেয়া হোক, একটি হাত ভেঙ্গে দেয়া হোক এবং সব শেষ বরটিতে সে চাইলো, তার একটি পা যেন খোড়া করে দেয়া হয়। বলাই বাহুল্য, তার প্রতিবেশি পেল তার দ্বিগুণ। সন্দেহ নেই, প্রতিবেশিকে শায়েস্তা করতে এই মোক্ষম পথ বেছে নিয়েছিলো লোকটি।
এটি নিছক কৌতুক, তবে আমাদের বাস্তবতাও কি কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৌতুককে ছাড়িয়ে যায় না?
দুর্নীতি বা নীতিবোধের সংজ্ঞা সম্ভবত সময় এবং অবস্থার সাথে পাল্টায়, গণমাধ্যমের কাছে এর সংবাদ মূল্যও পাল্টাচ্ছে। এখন সরকারি প্রকল্পে বালিশ তোলা।
পুলিশ কর্তার ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দেয়ার স্বীকারোক্তি কিংবা আলোচিত একটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তার ‘আত্মগোপন’ এ রকম কিছু ঘটনা ছাড়া ছোটখাট দুর্নীতি আমাদের এখন আর সেভাবে আন্দোলিত করে না।
খেলাপী ঋণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়ালে তবেই সেটি পত্রিকার প্রধান শিরোনাম হয়। এদিকে পাঠকের চাহিদা নেই বলে গণমাধ্যমও ‘ছোটখাট’ দুর্নীতি-অপরাধের খবর ছেপে পত্রিকার মূল্যবান পাতা নষ্ট করতে রাজি নয়।
আমাদের সমাজে ঘুস-দুর্নীতি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে৷ কারণ হলো, দুর্নীতির সংজ্ঞা আমরা নিজেদের মতো করে পাল্টে নিয়েছি। সমাজের প্রতিটি স্তরেই যার যেটুকু ক্ষমতা আছে, সেটি ব্যবহার করেই অন্যায় পথে অর্থ বা সুবিধা অর্জনকে আমরা এখন রীতিমতো ‘অধিকার’ বলে মানছি।
সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে সিএনজি অটোরিক্সার মিটারে চলাচলের ঘোষণা দিয়েছিলো। ভাড়া বাড়িয়েও তাদের মিটারে চলাচল নিশ্চিত করা যায়নি। হাইওয়েতে সিএনজি চলাচল বন্ধের পদক্ষেপও নেয়া হয়েছিলো। সেখান থেকেও পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে সরকার। বাস ভাড়ায় নৈরাজ্যতো রয়েছেই, বার বার আস্ফালন-হুঙ্কারেও কাজ হয়নি।
কিছুদিন আগের কথা, রমজান মাসে সরকার কেজি প্রতি সর্বোচ্চ ৫২৫ টাকা গরুর মাংসের দাম বেঁধে দিল, কিন্তু ঢাকার প্রায় সবগুলো মাংসের দোকানেই তা বিক্রি হয়েছে বেশি দামে৷ আর ঈদের আগে সেটি পৌঁছায় ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি দেয়া সম্ভব-মোট কথা যার হাতে যতোটুকু ক্ষমতা আছে, তার জোরেই আইন বা প্রশাসনকে অবজ্ঞা করে চলছে অবৈধ পথে উপার্জন৷
দুর্নীতির আরেকটি প্যানডোরা বাক্স খুলে গেল রমজান মাসে পরিচালিত ভেজাল বিরোধী অভিযানে।
আমরা শিউরে উঠলাম, খাবারের নামে অসাধু ব্যবসায়ীরা আমাদের কী খাওয়াচ্ছে, সেই চিত্র দেখে। এই বিষয়গুলো যদি সত্যিই আমরা আমলে নিতাম, তাহলে আজকে গুলশান-বানানীর অনেক অভিযাত রেস্তোরায় বসে বসে মাছি মারতে হতো। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা ভিন্ন। ভেজালের দায়ে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো দেদারসে পণ্য বিক্রি করছে, দণ্ড বা জরিমানা কবুল করা হোটেল রেস্তোরাগুলো খদ্দের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কিংবা ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেটদের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি, একই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি একধিকবার একই অপরাধে দণ্ডিত হয়েছেন, কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। সেই প্রতিষ্ঠানগুলো পরিস্থিতির উন্নয়ন না করেই নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
শুধু আইন প্রয়োগ করে বা শাস্তি দিয়ে দুর্নীতির এই পাহাড়কে টলানো যাবে না। দুর্নীতি দূর করতে হলে এই সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার, প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আর নিজের সুবিধা অনুযায়ী ন্যায়-অন্যায়ের সংজ্ঞা ঠিক না করে ভেজাল-দুর্নীতি-ঘুসসহ সবধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া।