স্বাধীনতার ৫০ বছরে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয় বাংলাদেশের কৃষিতেও বিপ্লব ঘটেছে । রেকর্ড হয়েছে অল্প জমিতে বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদনের। এই সময়ে কৃষিতে সংযুক্ত হয়েছে পরিবেশসহিষ্ণু উচ্চফলনশীল শস্যের জাত। নিউজ বাংলা টুয়েন্টিফোর থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালে দেশে যেখানে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১৮ লাখ টন, সেখানে ২০২০ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে প্রায় সোয়া ৪ কোটি টন। সবজি ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। ইলিশ উৎপাদনে প্রথম। খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১১ দেশের একটি বাংলাদেশ।
এক-ফসলি জমিতেও সারা দেশে আবাদ হয়েছে গড়ে দুটি ফসল। এলাকাভেদে এ চাষাবাদ গড়িয়েছে তিন থেকে চার ফসলেও। এতে বিশ্বের গড় উৎপাদন হারকে পেছনে ফেলে জনসংখ্যার হিসেবে নবম স্থানে থাকা বাংলাদেশ খাদ্যে হয়ে ওঠেছে স্বনির্ভর।
কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে জাতিসংঘ। প্রধান খাদ্যশস্য ধান উৎপাদনে বিশ্বে এখন তৃতীয় থেকে চতুর্থ অবস্থানে ওঠানামা করছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার আগে বেশি পরিমাণ জমি চাষাবাদে ফসল মিলত কম। এতে তখনকার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠেরই তিন বেলা দুই মুঠো খাবার জোটানো কষ্টকর হতো। এখন সময় বদলেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বলছে, বিশ্বজুড়ে প্রতি হেক্টরে শস্যের গড় উৎপাদনহার যেখানে প্রায় তিন টন, সেখানে বাংলাদেশে তা সোয়া চার টনে উন্নীত হয়েছে। ৫০ বছরে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। গমের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। সবজি উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ।
১৯৭১ সালে দেশে যেখানে মোট দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১৮ লাখ টন, সেখানে ২০২০ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে প্রায় সোয়া ৪ কোটি টন। ২০১৯ সালে উৎপাদন হয়েছে সাড়ে চার লাখ টন খাদ্যশস্য। তবে দেশে সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড হয় ২০১৭ সালে। তখন দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন হয় ৫ কোটি ৪২ লাখ ৬২ হাজার টন।
শুধু দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনেই নয়, কৃষির আরেক উপখাত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদেও সমৃদ্ধির স্বাক্ষর রেখেছে বাংলাদেশ। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার জরিপ বলছে, সবজি ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনের ৮৬ শতাংশই হয় এ দেশে।
পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। তবে পাট রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশই প্রথম। ছাগল উৎপাদনেও অবস্থান চতুর্থ। আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে পঞ্চম। আলু ও আম উৎপাদনে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। চা উৎপাদনে অবস্থান নবমে। সার্বিক ফল উৎপাদনে রয়েছে দশম অবস্থানে। গবাদিপশু পালনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বাদশ অবস্থানে রয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য বলছে, যে বছর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে, সে বছর দেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ হেক্টর। এসব জমিতে গড়ে ফসল ফলত একটি। ফলে খাদ্য চাহিদা মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পাশাপাশি বিদেশি অনুদান ও খাদ্য সহায়তার ওপর দেশকে নির্ভর করতে হতো।
৫০ বছর পর আবাদযোগ্য ৬০ শতাংশ জমি কমে যাওয়া সত্তেও আগের চেয়ে সোয়া দুই গুণ জনসংখ্যার চাপ নিয়েও নিজস্ব উৎপাদন দিয়ে পুরো খাদ্য চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে বাংলাদেশ।
কৃষির এই বিপ্লবের স্বীকৃতি এসেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে। সংস্থাটির বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতি সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে শীর্ষ খাদ্য উৎপাদনকারী ১১ দেশের কাতারে বাংলাদেশকে গণ্য করা হয়েছে।
অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, মূলত কৃষিতে পাওয়া ঈর্ষণীয় সাফল্যকে পুঁজি করেই বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বনির্ভরতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। একসময়ের দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশ এখন দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে নিরাপদ স্তরে আপৎকালীন মজুদ রেখেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে উদ্বৃত্ত খাদ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত পণ্য।
আর কৃষি অর্থনীতিবিদরা দাবি করছেন, বর্তমান সরকারের কৃষিতে যুগোপযোগী পরিকল্পনা, উন্নত প্রযুক্তি, বীজ ও সারের ব্যবহার, কৃষিবিজ্ঞানীদের উচ্চফলনশীল নতুন জাত উদ্ভাবন বাংলাদেশের এই অর্জনের নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, গত ১৬ মার্চ পর্যন্ত সময়ে দেশে ৫ লাখ ৯৩ হাজার টন খাদ্যশস্য (চাল ও গম) আপৎকালীন হিসেবে মজুদ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, ‘দেশে প্রধান খাদ্যশস্যের মধ্যে রয়েছে চাল, গম ও ভুট্টা। করোনা পরিস্থিতির আগে দেশে চাহিদা মেটানোর পরও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও সংগ্রহের মাধ্যমে শুধু সরকারি গুদামেই চালের মজুদ স্তর ছিল ১১ লাখ টনের কাছাকাছি।
‘ধান উৎপাদনে আমরা বিশ্বে চতুর্থ। উৎপাদিত ধান থেকে পাওয়া চাল আমরা রপ্তানি করারও নজির তৈরি করেছি। মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কারণে আমরা গম ও ভুট্টা আমদানি করলেও প্রতি বছর এসব খাদ্যশস্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, সংগ্রহ ও মজুদ বাড়ছে এবং আমদানি কমছে। এটা বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রতীক।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খলীকুজ্জামান আহমদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে কৃষি খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। বীজে নতুন নতুন উদ্ভাবনী জাত সংযুক্ত হয়েছে। চাষাবাদে প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে।
‘পারিবারিক পর্যায়ের উৎপাদন বৃত্ত থেকে বেরিয়ে কৃষি এখন বাণিজ্যিকীকরণ খামারে পরিণত হয়েছে। সেখানে প্রতি মৌসুমেই উৎপাদন উৎকর্ষতার শীর্ষে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব কিছুর সুফলই হলো দেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন।’
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘দেশে আজ দারিদ্র্য দূর করায় যে সফলতা এসেছে, তার নেপথ্যেও ভূমিকা রেখেছে কৃষি খাত। এ কারণে গ্রামীণ কর্মসংস্থান বেড়েছে। এটি মানুষের উপার্জনে প্রভাব ফেলেছে এবং পারিবারিক খাদ্য সংকট দূর করতে সক্ষম হয়েছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের হেক্টরপ্রতি শস্যের গড় উৎপাদন সোয়া চার টনের মতো হলেও আমাদের উপরে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের গড় উৎপাদন ১০ টনের উপরে। উৎপাদন সক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে আমাদের যেতে হবে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে শুধু খামারভিত্তিক নয়, প্রান্তিক পর্যায়ের চাষাবাদকেও আধুনিকায়নের আওতায় আনতে হবে।
‘গবেষণার ক্ষেত্র আরও বাড়াতে হবে। কৃষকের সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কৃষিপণ্যের ন্যায্য দামও নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে আরও কম জমিতে আমরা বর্তমানের চেয়েও বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে সক্ষম হব।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘আগামীর লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে কৃষিজ উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণে উন্নীত করা। এর জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে প্রতিকূলতাসহিষ্ণু নতুন নতুন জাত চাষাবাদের আওতায় আনতে হবে।
‘চরাঞ্চল ও পাহাড়ে চাষাবাদকে টেকসই করা জরুরি। এ ছাড়া দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও হাওরাঞ্চলে ভাসমান সবজি চাষ বাড়াতে হবে।’
সূত্রঃ নিউজ বাংলা টুয়েন্টি ফোর