ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: ১/১১ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ‘ভাতের ওপর চাপ কমান, বেশি করে আলু খান’ এ রকম একটা স্লোগান বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। একটা সময় চালের দাম ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির থাকার কারণে ও পুষ্টিমান বিবেচনায় মানুষ আটা ও ময়দার দিয়ে ঝুঁকে পড়েছিল।
আবার গরিব মানুষের খাবারের মূল উপাদান ছিল গমের আটার রুটি, আর সচ্ছল মানুষ ভাত খেত। কিন্তু পরে পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে। পুষ্টি বেশি বিবেচনায় রুটির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
বৈশ্বিক আর্থিক সংকট
একদিকে বৈশ্বিক আর্থিক সংকট অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গমের আমদানি সংকটে পড়ার পর থেকেই দাম বাড়তে থাকে। এছাড়াও, গমের আমদানির উৎস দেশ ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে গম কম আসছিল।
ভারতও গমের দাম বাড়ানো হয়েছে এবং আমদানি বন্ধ আছে বলে দাম বেড়েই চলেছিল। সেই সাথে গমের সাথে যুক্ত রুটি থেকে শুরু করে মিষ্টি-বেকারি আইটেমের খাদ্য পণ্যের দাম ক্রমাগতই বেড়েই চলছিল। সরকারের খোলা বাজারে খাদ্য বিক্রি কার্যক্রম যা ওএমএস নামে পরিচিত সেখানেও আটা বিক্রি বাড়ানোর দাবি নিম্ন আয়ের মানুষের।
এর মধ্যে শুরু হলো ডলারের সংকট ও খাদ্য পণ্য আমদানিতে এলসি খোলা নিয়ে সংকট। ব্যবসায়ীরা এলসি খোলার সংকট দেখিয়ে ও ডলার সংকটের কথা বলে গম আমদানিতে সংকটের অজুহাতে দাম আরও বাড়ছেই। এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষ আবার বাধ্য হয়ে রুটি ছেড়ে ভাতের দিকে ঝুঁকছে।
আটা বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় দ্বিতীয় প্রধান উপাদান। ব্যবসায়ীদের মতে, রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ থেকে গম আমদানি বন্ধ থাকায় দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় দ্বিতীয় প্রধান উপাদান আটার দাম ক্রমাগত বেড়ে রেকর্ড ভেঙেছে।
গম আমদানি
গম আমদানি সংকট থাকায় গমের দাম বাড়ছে। ভারতের গমের মান ইউক্রেন ও রাশিয়ার মানের নয়। তারপরও ভারত থেকে বেসরকারি মিলমালিকরা গম আনছে। কিন্তু, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা যথাসময়ে সেই গমও সরবরাহ দিচ্ছে না। তাই গমের বাজারে সংকট দেখা দিয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বড় ধাক্কা এবার বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসের ওপর গিয়ে পড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে গম আসা কমে যাওয়ায় বিশ্ববাজারে দাম স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে গেছে। আবার বেশি দামে আটা কিনতে না পারায় দেশের মানুষের বড় অংশ রুটি, বিস্কুট ও আটা-ময়দা থেকে তৈরি খাদ্য কেনা কমিয়ে দিচ্ছে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বিগত এক বছরে গম থেকে তৈরি খাবারের পরিমাণ ১৫ লাখ টন কমিয়ে দিয়েছে। গমের ওপর নির্ভরশীল হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বেকারির খাবারের দাম দফায় দফায় ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ঢাকার ফকিরাপুল বাজারে বেসরকারি চাকুরীজীবী রহিমউদ্দীনের সাথে কথা হলে তিনি জানান, অফিসে টিফিনে এক সময় আটার রুটি আনতেন। কিন্তু আটার দাম বাড়ায় এখন ভাতই দেন গৃহিণী। অনেকটা খরচ কমাতে বাধ্য হয়ে ভাতের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তার মতো অনেকেই একসময় রুটি আনতে বাসা থেকে অথবা হোটেলে গিয়ে দুপুরে রুটি খেতেন এখন বাধ্য হয়ে বাসা থেকেই রুটি নিয়ে আসেন।
কেবল রাজধানীতে প্রতিদিন ৬০ লাখ মানুষ হোটেলের খাবার কিনে খান। করোনার সময় দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ হোটেল বন্ধ ছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর অনেকে আবার ব্যবসা শুরু করেন।
পরিসংখ্যানে বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষ মোট ৮৩ লাখ টন আটা-ময়দা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে গমের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছিল, গমের চাহিদার পরিমাণ কমে ৭৪ লাখ টন হবে। খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ধারণার চেয়েও বেশি কমে গিয়ে ৬৮ লাখ টনে দাঁড়াতে পারে। অর্থাৎ এক বছরে গমের চাহিদা কমছে ১৫ লাখ টন।
কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী এপ্রিলে বাংলাদেশে উৎপাদিত গম বাজারে এলে এবং ভারত গম রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে দাম কমতে পারে। আর চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে ১১ লাখ টন গম উৎপাদিত হয়েছে। আর ৫৫ লাখ টন বিদেশ থেকে আমদানি হয়েছে।
বেকারির খাবার
দেশের মানুষ পাউরুটি, বিস্কুট, বান, কেকসহ নানা ধরনের খাদ্য কিনে খান। আর বাংলাদেশ রুটি-বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারী সমিতির সদস্যদের মতে, এসব পণ্য বিক্রি এক বছরে প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে। এসব পণ্যের প্রধান কাঁচামাল আটা, তেল, চিনি, দুধ ও ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রায় প্রতি মাসে বেশিরভাগ পণ্যের দাম বাড়ছে।
বেশিরভাগ বেকারিতে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। দাম অল্প বাড়াতেই বিক্রি যেভাবে কমছে, তাতে এই খাতকে টিকিয়ে রাখা কঠিন। এর সঙ্গে আবার জ্বালানি গ্যাসের দাম বাড়ানোয় এই খাত বেশি সংকটে আছে।
দেশের ছোট-মাঝারি ও বড় হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোয় মূলত রুটি, পরোটা, পুরি, শিঙাড়া, সমুচাসহ নানা ধরনের খাদ্য তৈরি করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে সারা দেশে প্রতিদিন প্রায় চার থেকে পাঁচ কোটি মানুষ এসব হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে কোনো না কোনো খাদ্য কিনে থাকেন।
কেবল রাজধানীতে প্রতিদিন ৬০ লাখ মানুষ হোটেলের খাবার কিনে খান। করোনার সময় দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ হোটেল বন্ধ ছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর অনেকে আবার ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব হোটেলের আটা ও ময়দার তৈরি খাদ্যের বিক্রি আবারও প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে। ভাতের ওপরে চাপ বাড়ায় দেশে চালের চাহিদা বেড়ে গেছে। অনেকে সকালে রুটির পরিবর্তে ভাত খাওয়া শুরু করেছেন।
ভাতের চেয়ে আটার রুটিতে পুষ্টিকর উপাদান বেশি। ফলে সরকারের উচিত, ওএমএসসহ নানা সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে আটাসহ অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া। প্রান্তিক ও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিত্য খাদ্যপণ্যের দাম সহনীয় মাত্রায় রাখা নতুবা সাধারণ মানুষের আয় বাড়ানোর জন্য জোরদার কার্যক্রম গ্রহণ করা।
এস এম নাজের হোসাইন, ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
সৌজন্যে, ঢাকাপোস্ট।