আমরা অনেক বেশি ভাত খাই। ভাত খাওয়া কমাতে পারলে চালের ব্যবহার অনেক কমে যাবে বলে মনে করেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক। গত রোববার (২৪ অক্টোবর) ‘বাংলাদেশের ৫০ বছর: কৃষির রূপান্তর ও অর্জন’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল ৫০ বছরে কৃষির রূপান্তর ও অর্জন। এমন একটি অনুষ্ঠানে ভাত খাওয়া কমানোর পরামর্শ কৃষি ক্ষেত্রে বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদনে আমাদের অর্জনের বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ভাত বা চালের ব্যবহারবিধি বা অতি ভোজনের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে যদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী এরকম একটি পরামর্শ দিতেন তবে সেটি হয়তো আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হতো।
যাই হোক, কৃষিমন্ত্রীর এ মন্তব্যটি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার আগামী দিনের ঝুঁকির বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে। জলবায়ু সঙ্কট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি, সরবরাহ ব্যবস্থায় অনিয়ম-এসব কারণে ভবিষ্যতে হয়তো খাদ্য ঘাটতি মেটাতে মানুষকে আধা পেট খেয়েই বেঁচে থাকতে হতে পারে। বিষয়টি শুধু যে বাংলাদেশের জন্যই ভাবনার তা নয়, বৈশ্বিকভাবেই একটি শঙ্কার কারণ। বর্তমানে দেশে যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্য বিরাজ করছে তা সামগ্রিকভাবে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্য অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে যেকোনো নেতিবাচক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। মোকাম থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা বাজারে খাদ্যপণ্যের বাজারমূল্য নিয়ে যে তেলেসমাতি চলছে, তা বন্ধ করতে হবে। বাজার মনিটরিং বাড়াতে হবে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশের সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, তেল, ডিম, মুরগী, মাছসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব ভোগ্যপণ্যের দামই এখন চড়া। এতে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ সমস্যায় পড়েছে। দীর্ঘমেয়াদী মহামারির অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে মানুষ এখনও মুক্ত হতে পারেনি। কাজ হারিয়ে এখনও অনেকে বেকার দিন গুনছেন। খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি তাদের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।’
দেশে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে এ নিয়ে কয়েক দফা দাম বাড়লো। কেন এই বাড়িত দাম? খুচরা বিক্রেতারা বলছেন তাদেরকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, তাই বেশি দামেই বেচতে হচ্ছে। আর আমদানীকারক ও পাইকাররা বলছেন তাদেরকেও বেশি দামে কিনতে ও আমদানি করতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে মজুদ খরচ বাড়ছে, বাড়ছে পরিবহন খরচও। আমদানিকারকরা আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার অজুহাত দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে আমাদের স্থানীয় বাজারে অনেক পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায়ও বেশি। আর আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাতে এখানে দাম বাড়ালেও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে গেলে এখানে দাম কমার নজির কম। শেষমেষ মাশুল গুনতে হয় ওই প্রান্তিক ভোক্তাকেই।
আমাদের বাজার দর কে বা কারা নিয়ন্ত্রণ করেন তা কেউ জানে না। সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সন্দেহ থাকলেও এর পেছনে যে কেউ না কেউ আছেন সে বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই। দাম বাড়লে সরকারের মন্ত্রী বা সংশ্লিষ্টরা গণমাধ্যমে কিছু মন্তব্য করেন। সরকার সজাগ দৃষ্টি রাখছে, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না, আইনের আওতায় আনা হবে গোছের কিছু মন্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায় সরকারি কার্যক্রম।
বাংলাদেশ বেশিরভাগ নিত্যপণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করে। ফলে ওই সব দেশের ওই সব পণ্যের দাম ওঠানামা করলে বা যেকোনো কারণের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিলে বাংলাদেশের বাজারের ওপর এর প্রভাব পড়ে। যেকোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্যই এটি নেতিবাচক বিষয়। এদিকে যে হারে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমছে তাতে বাজারের ওপর এর প্রভাব পড়াই স্বাভাবিক। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পরে আমদানি পণ্যের ওপর।
আমদানি নির্ভর দেশ হওয়ায় অবশ্যই আমাদের আমদানি ও মজুদ বাড়াতে হবে যাতে অন্তত সাময়িক সংকট কাটানো যায়। আমদানি ও সরবরাহ ঠিক থাকলে সাময়িক ঝুঁকি মোকাবেলা সহজ হয়। মজুদ ঠিক থাকলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ঠিক রাখতে সরকার খোলা বাজারে পণ্য বিক্রি করতে পারে। এসবই নির্ভর করে মজুদ ও সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপর। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারের এই শৃঙ্খল ভেঙ্গে দিতে সবসময়ই তৎপর থাকে। এরা নানাভাবেই বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চায়। এরাই বিদেশে দাম বাড়ার অজুহাতে সঙ্গে সঙ্গেই দেশে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু তার আগে চাহিদার সঙ্গে মজুদ ও সরবরাহের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ভারসাম্যহীন বাজারের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তারা চায় ভারসাম্যহীনতা আরও বাড়ুক। বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে খাদ্যপণের দাম বাড়িয়ে দিয়ে এরা বাজার থেকে রাতারাতি বেশি মুনাফা লুফে নেয়। এদের বিরুদ্ধে যদি এখনই ব্যবস্থা নেয়া না হয়, তবে তাদের দৌরাত্ম্য আরও বাড়বে।
করোনাকালে গত দেড় বছরে এ নিয়ে বেশ কয়েকবার নিত্যপণের দাম বেড়েছে। কেন দাম বেড়েছে, কারা বাড়িয়েছে তা আজও পরিষ্কার নয়। পাইকারি বাজারি থেকে শুরু করে আমদানিকারক সবাই আগেরজনকেই দুষছেন। কিন্তু সবকিছুই চলছে প্রতিকারহীনভাবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের অজুহাতের বাজারে যখন দাম বাড়ে তখন সেখানে কোনো পণ্যের দামই নিয়ন্ত্রণে থাকে না।
দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে, খাদ্যের চাহিদা বাড়াও স্বাভাবিক। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ হলেও চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কৃষি উৎপাদন বাড়ছে না। উৎপাদন হয়তো বাড়ছে গাণিতিক হারে, কিন্তু জনসংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। এদিকে আবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণও কমছে। ফলে কৃষির ওপর চাপ বাড়ছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে কৃষিতে লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার, আবাদযোগ্য জমির টেকসই ব্যবহার, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য উৎপাদন থেকে প্রান্তিক ভোক্তা পর্যন্ত সব কিছুর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষির ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া না হলে উৎপাদন আরও কমবে। কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। কৃষক বছরের পর বছর লোকসানের ঘানি টেনে, হালের বলদ বিক্রি করে ধান চাষ করবেন না। ফলে, এর প্রভাব গিয়ে পড়বে খাদ্য উৎপাদনে, মজুদে, সরবরাহে ও মূল্যে। ফলে, কৃষিমন্ত্রী বলুন আর না-ই বলুন, ভবিষ্যতে সবাইকেই যাতে আধা পেট খেয়ে দিন কাটাতে না হয় সে ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে।
খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে যেকোনো নেতিবাচক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। মোকাম থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা বাজারে খাদ্যপণ্যের বাজারমূল্য নিয়ে যে তেলেসমাতি চলছে, তা বন্ধ করতে হবে। বাজার মনিটরিং বাড়াতে হবে। অসাধু সিন্ডিকেট থাকলে তা ভেঙ্গে দিতে হবে। সিন্ডিকেট কি সরকারের চেয়েও শক্তিশালী? নিশ্চয় নয়।
রাষ্ট্রের মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে, টিসিবি, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার ও প্রশাসন, ক্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হবে। টিসিবি কিছু পণ্য বিক্রি ছাড়া মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে তাদের কোনও পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। এক্ষেত্রে টিসিবির দৃশ্যমান ভূমিকা কাম্য।
বাজারের ওপর সরকারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরকার সব পণ্যের দাম নির্ধারণ করবে বিষয়টি সেরকম নয়। অর্থনীতিতে বাজারই পণ্যের দাম নির্ধারণ করবে। কিন্তু অস্বাভাবিক কোনো বাজার দরের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে।
প্রান্তিক ভোক্তাদের জিম্মি করে যারা বাজার দর নিয়ন্ত্রণ করছে তাদেরকে প্রতিহত করতে হবে। এটা শুধু অনৈতিকই নয় ফৌজদারি অপরাধও। এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক : এরশাদুল আলম প্রিন্স
আইনজীবী, কলাম লেখক।