অধ্যাপক বদরুল ইমাম: শুভ সকাল এবং আপনাদের সালাম। সংস্কার প্রস্তাবনা আপনারা সবাই পেয়েছেন। আমি আমার বক্তব্যে সরাসরি বিভিন্ন সমস্যা, সমাধান ও কি করণীয় সে বিষয়ে আলোকপাত করছি।
প্রথমেই আমি আপনাদের একটা খবর দিতে চাই। সেটা হলো, গ্যাস, জ্বালানি বাপেক্স এসব বিষয়ে আমরা যখন কথা বলছি, এখন যেমন সকাল পৌণে ১১টা বাজে ঠিক এই মুহুর্তে বাপেক্সের কর্মীরা নতুন একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে এবং সে গ্যাস এখন টেষ্টিং চলছে। আগামী দুই/এক দিনের মধ্যে আপনারা ঘোষণা পাবেন সরকারি ভাবে যে, বাপেক্সের নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। বাপেক্স কয়েক বছর আগে সিলেটে আরেকটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। তারও কয়েকবছর আগে বাপেক্স আরো একটি গ্যাস খ্যাত আবিষ্কার করে।
যদি আপনি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের তথ্যগুলো জোগাড় করেন তাহলে দেখবেন শেষ তিনটি গ্যাসক্ষেত্রের আবিষ্কার বাপেক্সের হাত ধরেই হয়েছে। এটা বলার উদ্দেশ্য হলো, আমাদের এখানে এখনো দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স কতটুকু কাজ করবে, করতে পারবে, তার সক্ষমতা কতটুকু, এ ধরনের প্রশ্ন অনেকেই করে। এটা খুবই অর্থহীন কথা। যে প্রতিষ্ঠানটি একটার পর একটা গ্যাস আবিষ্কার করতে পারে, প্রমাণ করতে পারে যে আমরাও সক্ষম, তার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা খুবই অযৌক্তিক।
আমি আমার বক্তব্যের পরবর্তী পর্যায়ে যাওয়ার আগে প্রফেসর এম এম আকাশ যে কথা বলছে, সেটাকে নিয়ে বলতে চাই। এক টাকা বনাম ৮৩ টাকা। আপনি দেশের গ্যাস ব্যবহার করলে ৮৩ টাকা না দিয়ে এক টাকা দিতে পারবেন। আমরা এখন যেটা করছি, দেশে গ্যাস নাই, এলএনজি আমদানি করছি। এলএনজি হলো তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস, এটা আমরা প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করে আনি। এবং এটাতেই কখনো কখনো খরচ হয় ৮৩ টাকা প্রতি ইউনিট। এই যে এক টাকা বনাম ৮৩ টাকা- এটাই কিন্তু বাংলাদেশের জ্বালানি, বিদ্যুৎ খাতের বিরাট বড় একটা ইস্যু। যখন ৮৩ টাকা ব্যয় হয়, তখন সেটা কিন্তু ভোক্তাদের ঘাড়েই চাপানো হয়। যে কারণে আমরা দেখতে পাই, প্রতিনিয়ত আমাদের বিদ্যুতের দাম বাড়ছে, গ্যাসের দাম বাড়ছে। এটা ক্রমাগত ভাবে আরো বাড়তে থাকবে যতদিন আমার ৮৩ টাকার গ্যাস ব্যবহার করতে থাকবো।
আমাদের যে জনসংখ্যা এবং চাহিদা, তাতে কিন্তু এলএনজির ব্যবহার ক্রমাগত হারে বাড়বে। সেই সঙ্গে প্রতি বছর এর দামের পরিমাণও বাড়তে থাকবে। একটা সময় আসবে যখন বাংলাদেশ গ্যাসের জন্য মূলত এলএনজির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। তখন এই ১ টাকা সমান ৮৩ টাকার হিসাবটা আরও নেতিবাচক হয়ে যাবে।
এখন যে মৌলিক প্রশ্নটা করা যায়, আমরা করে থাকি, তা হলো এই অবস্থা কি ইনএভিটেবল তথা অবশ্যম্ভাবী ছিল কি না। আমি বলব, অবশ্যই না। বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদের ওপর যাদের লেখাপড়া আছে, যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান এটা নিয়ে কাজ করে, তারা একটা কথা স্পষ্টভাবেই বলে, বাংলাদেশের মতো একটা দেশে গ্যাসের জন্য হাহাকার হওয়াটা অস্বাভাবিক। কারণ হচ্ছে, পৃথিবীতে যত গ্যাসসমৃদ্ধ দেশ আছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে যে গ্যাস সম্পদ প্রচুর আছে, দেশি বিদেশি অনেক বিজ্ঞানীই সেটা বলেছেন এবং এখনো বলছেন।
পেট্রোবাংলা আর আমেরিকা একটা জরিপ করেছিলো, এখনো বাংলাদেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাসের পরিমাণ হলো ৩২ টিসিএফ। সে হিসেবে এখনো আমাদের প্রায় ৩০ বছরের জ্বালানি মজুদ রয়েছে। অপর দুটি সংস্থা, এর মধ্যে একটি হলো নরওয়ের সরকারি সংস্থা, তারা যৌথ ভাবে হিসাব দিয়েছে, বাংলাদেশে থাকা গ্যাসের পরিমাণ ৪২ টিসিএফ। এটা একটা প্রাক্কলন, যা কিনা বৈজ্ঞানিক ক্যালকুলেশনের মাধ্যমে করা হয়। এটা যে একেবারে প্রমাণিত, তা না। তবে আবার ভিত্তিহীনও নয়। এ সমস্ত জিনিস থেকে যে বিষয়টা আমরা বুঝতে পারি, আমরা গ্যাস সংকটের মধ্যে এখনই নেই।
কিন্তু এর পরেও আমরা যদি এমন ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করি, যার জন্য ধীরে ধীরে আমরা বিদেশি গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লাম, এটা তো মোটেই গ্রহণযোগ্য না। এটা জাতীয় স্বার্থবিরোধী। আমরা এখনো দেখছি যে, দেশীয় গ্যাসের যে প্রাপ্যতা, তা প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে। যখন থেকে আমরা গ্যাসের ব্যবহার শুরু করলাম। তারপর থেকে ক্রমাগত ভাবে কিন্তু গ্যাসের উৎপাদন বেড়েই চলছে এবং এ বৃদ্ধি ২০১৫ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। এরপর থেকেই প্রতিবছর গ্যাস উৎপাদনের হার কমতে থাকে এবং এখন এটা প্রতিনিয়ত কমেই যাচ্ছে। ২০১৫ সালে ম্যাক্সিমাম প্রডাকশন হবার পরে এটা কমতে থাকে এবং এখনো এই কমার হার অব্যাহত।
ঘটনা হচ্ছে, গ্যাস উঠছিলো, তার সঙ্গে সঙ্গে চাহিদাও বাড়ছিলো। ফলে গ্যাস উত্তোলন ও চাহিদার মধ্যে একটা সমতা বজায় ছিলো। এরপরে যখন গ্যাসের প্রডাকশন কমে যাচ্ছে কিন্তু ডিমান্ড কমছে না বরং বাড়ছে। ফলে চাহিদা ও গ্যাসের প্রাপ্যতার মধ্যে ফাঁকটা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এটা একটা অশনি সংকেত। সমস্যা হলো যারা আমাদের নীতিনির্ধারক, তারা যখন বলে আমাদের আর দেশীয় গ্যাস নাই, একসময় আমরা অনেক খনন করেছি, এখন আর খনন করার মতো বাকি কিছু নাই। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যখন এ ধরনের কথা বলে এটা খুবই আশ্চর্য লাগে, কারণ এটা অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত ও প্রক্কলনের সঙ্গে মেলে না।
এ রকম কথা যদি বলা হয়, তাহলে আমরা যেখানে বাস করছি, এই ভূখণ্ডকে অবমাননা করা হয়, বাংলাদেশের মাটিকে অবমাননা করা হয়। এটা কেন করা হয়? এই কারণে যে, আমরা গ্যাস তুলতে পারব না? না কি বরং এ কারণে যে, দেশীয় গ্যাস উত্তোলন করলে যে লাভ তার চেয়েও বেশি লাভ বিদেশ থেকে গ্যাস আনলে, কারণ এখানে আমলাতন্ত্র ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটা কমিশন বাণিজ্যের সম্পর্ক আছে। কারণ দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করলে তাদের পকেটে অত কমিশন আসবে না। সঙ্গত ভাবেই এসব প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কেন আমরা আমদানির পথে গেলাম আর দেশীয় গ্যাস উত্তোলনের পথকে পরিত্যাগ করলাম।
কিছুদিন আগেও আমরা সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্য দিয়ে হেডলাইন করতে দেখেছি গণমাধ্যমে, তারা বলছেন, আমরা তো অনেক খনন করেছি, বাংলাদেশে আর গ্যাস নাই। আবার এও বলছে, সাগরে আমরা অনেক কোম্পানিকে আনার চেষ্টা করছি এখানে কেউ আসতে চায় না। এইরকম মিথ্যা কথা, এ রকম বিভ্রান্তিমূলক কথা বলা বাংলাদেশের মাটিকে অবমাননা করা। দেশের ভূখণ্ড, দেশের যে গঠন, এই সর্ম্পকে যারা জ্ঞাত আছে তাদের প্রতি অবজ্ঞা করা, মানে বাংলাদেশের মাটিকে অবজ্ঞা করা। এখান থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।
আমরা এ সমস্যার মধ্যে পড়লাম কেন? বিষয়টা এমন না যে হঠাৎ করে দুই/চার বছর ধরে এটা হচ্ছে। ঐতিহাসিক ভাবে বাংলাদেশ হলো ন্যূনতম গ্যাস এক্সপ্লোরেশনের জায়গা। গ্যাস যেসব এলাকায় আছে, সেসব এলাকার তুলনায় এখানেই গ্যাস অনুসন্ধান সবচেয়ে কম হয়েছে এবং এখানে পেট্রোলিয়াম-গ্যাস অনুসন্ধাানের গতি এতই কম, সারা পৃথিবী যে ধারায় চলে তার ধারে কাছেও আমরা নেই। ঠিক এ কারণেই বাংলাদেশের যে রিয়েল পটেনশিয়াল, ভেতরে যে পটেনশিয়ালিটি আছে, প্রকৃত যে সম্ভাবনাটা আছে, সেটা কখনোই উন্মোচিত হয়নি। এই কথাটা শুধু এখনকার বা বিগত দশ বছরের জন্য বলছি না। ঐতিহাসিকভাবে আমরা এভাবেই চলে আসছি।
বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ এতটাই গ্যাসপ্রবণ যে, অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম গ্যাস অনুসন্ধান করেই আমরা ইতিপূর্বে বেশি কিছু গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করতে পেরেছি। তিতাস থেকে বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে আমরা গ্যাস উত্তোলন করছি। এখনো যা শেষ হয়নি। বা আরো অনেক বড় বড় গ্যাসক্ষেত্র আছে। এই যে উদাহরণ, এখান থেকে আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিলো। কিন্তু তা না করে এই সমস্যাটাকে আরো প্রকট করে তোলা হয়েছে। অনুসন্ধান আরো কমিয়ে দেয়া হয়েছে। দেশপ্রেমিক যেকোনো গোষ্ঠীর দায়িত্ব ছিলো এ ধারাটাকে পরিবর্তন করে দেওয়া। যখন একটা সরকার পরিবর্তন হয়, সব সময় আমরা আশা করি, যে জিনিসগুলো আগে হয়নি হয়তো এ সরকার এসে এটাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে। কিন্তু সে জিনিসটি আমরা দেখতে পাইনি। আমরা দেখতে পাইনি এই অনুসন্ধান না করার ধারাটা বদলে অনুসন্ধানকে উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাওয়া।
এখন যখন গ্যাস সমস্যা চরমে পৌঁছালো, এটা যখন অর্থনীতিকে সরাসরি আঘাত করা শুরু করলো। ইন্ডাস্ট্রি বলেন আর বাসাবাড়ি বলেন, পুরো দেশ যখন গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তখন গ্যাসের ঘাটতি হয়ে উঠলো একটা চরম সমস্যা। তখনও কিন্তু এ পরিবর্তনটা এলো না।
সকলেরই আশা ছিলো, নতুন করে সরকারে যারা ক্ষমতায় আসছেন তারা এটাকে পরিবর্তন করবে। সেটা কখনোই হয়নি বরং সেই ধারাকে বজায় রেখে গ্যাস অনুসন্ধানকে আরো নিচে নামিয়ে এনেছে। অন্য যে ধারা যুক্ত করলো, সেটা হলো গ্যাস আমদানি এবং এই নীতির কারণে অচিরেই আমরা সম্পূর্ণ ভাবে আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে যাচ্ছি। কিন্তু সঠিক নীতি গ্রহণ করলে গ্যাসের জন্য এখনই আমাদের বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার প্রয়োজন পড়তো না। হয়তো এটা একটা সময় হবে, একেবারেই হবে না তা নয়, তবে এখনই তা হওয়ার কথা ছিলো না। আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমাদের গ্যাস এখনো বেশ ভালো পরিমাণেই রয়েছে। এটা থাকতে কেন আমরা এতটা বিদেশ থেকে আমদানি করবো। কিন্তু আমরা দেখছি, শুধু গ্যাস না, আমাদের পুরো জ্বালানি খাতই শতভাগ আমদানির দিকে চলে যাচ্ছে। এটার বিকল্প ছিলো নিজেরা গ্যাস উত্তোলন করা। গ্যাস অনুসন্ধানের দুর্বলতাই হলো জ্বালানি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
তবে এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বর্তমানে আমরা যে ধারাগুলো দেখতে পাচ্ছি, তার মধ্যে খানিক ইতিবাচক ধারাও রয়েছে। যেমন ধরেন, অনুসন্ধান হয়নি, হচ্ছে না, এটা আমাদের বহুদিনের চিৎকার। এখন ৪৬টা কূপ খননের একটা প্রোগ্রাম পেট্রোবাংলা হাতে নিয়েছে। এটা তিন বছরের মধ্যে হবে বলা হয়েছিল, বর্তমানে বলা হচ্ছে দুই বছরের মধ্যেই ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। খুব ভালো, এটা একটা ইতিবাচক দিক হিসেবে আমরা দেখতে পারি। যদি এটা সাফল্যের সঙ্গে করা যায় তাহলে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। কিন্তু এখন এই যে ৪৬টি কূপ খননের কাজ শুরুর ঘোষণা দিয়েছে, অতীতেও কিন্তু এ রকম ঘোষণা আমরা শুনেছি। কয়েক বছর আগে পেট্রোবাংলা ঘোষণা দিয়েছিলো ১৪৮টি কূপ খনন হবে। সে সময়ও আমরা খুব আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলাম। কিন্তু কিছুদিন পর দেখলাম এটা বাতিল হয়ে গেল। কারা এর পেছনে কলকাঠি নাড়লো, কেন কূপগুলো খনন করা গেলো না, তা আমরা জানতে পারলাম না। এখন আমাদের কথা হচ্ছে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়। দুই বছরের মধ্যে এই ৪৬টি কূপ খনন করে অনুসন্ধান করে দেখা যাক কতটা গ্যাস উত্তোলন করা যায়। এ প্রোগ্রামটা যেন ব্যর্থতার দিকে না নিয়ে যাওয়া হয়। যে সুখবরটা আমি প্রথমেই দিলাম, বাপেক্স আজ যে গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করেছে, সেটা কিন্তু এই ৪৬টির মধ্যে একটি।
এটা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আমরা যদি সত্যিই বাংলাদেশের মাটি থেকে গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থা নেই, সেটা আমাদের ফল দেবে। সমুদ্রের গ্যাস নিয়ে দুই/একটা কথা বলে আমি শেষ করবো। এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে, বঙ্গোপসাগর এলাকা থেকে আমরা গ্যাস তুলতে পারছি না। এটা একটা জ্ঞাত গ্যাস সমৃদ্ধ এলাকা। কেন? আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা, যেটা আমরা বিভিন্ন দেশ ভাগাভাগি করতে গিয়ে দিয়েছি, সমুদ্র তো এটার ওপর দাঁড়িয়ে বিভক্ত না। সমুদ্রটা পুরো একটাই এলাকা, আমরা বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারত দাগ টেনে এটা ভাগ করে নিয়েছি। মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের একটা দাগ আছে, ভারতের সঙ্গে দাগ আছে। এই দাগগুলো কিন্তু ভূতাত্ত্বিক দাগ না। এগুলো শুধু ম্যাপের ওপর আমাদের কলমের দাগ। ভূগঠনের দিক দিয়ে এই এলাকাটা একই রকম। এখন আপনি যদি মিয়ানমারের দিকে দেখেন, আমাদের দাগের ওপারে গেলেন, সেখানে কিন্তু অনেকগুলো গ্যাসক্ষেত্র আছে।
২০১২ সালে যখন আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা চূড়ান্ত করা হলো, এরপরে কিন্তু মিয়ানমার গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে চলে গেল। বিগত ১০ বছরে মিয়ানমার অনেকগুলো গ্যাসক্ষেত্র তৈরি করেছে। তারা গ্যাস পেয়েছে এবং তা কাজে লাগাচ্ছে। একই সাগরে যখন আপনি আমাদের দাগের আরেকপাশে যাবেন, সেখানে দেখবেন ভারতীয় সীমানায় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু যদি বাংলাদেশের সীমানায় দাগের ভেতর আসবেন, এখানে একটা ফোটা গ্যাসও খুঁজে পাবেন না। একই সাগর, এদিকে গ্যাস, ওদিকে গ্যাস, অথচ মধ্যখানে গ্যাস থাকবে না, এটা তো একটা অবৈজ্ঞানিক বিষয়। সাধারণ ভাবেই তো আমরা বুঝতে পারি যে এমনটা ঘটার কোনো কারণ নেই। তাহলে কী দাঁড়ালো, আমরা আমাদের অংশে সঠিক ভাবে অনুসন্ধান করছি না।
প্রশ্ন হলো, সমুদ্রসীমা চূড়ান্ত হওয়ার পর কেন বিগত ১০ বছরে আমরা গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জোর দিলাম না? এসব প্রশ্ন উঠলে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকতাদের মুখ থেকে শুনি তারা বলেন, আমরা তো অনেক কোম্পানিকে বাংলাদেশে আসতে বলি। তারা আসে না! এগুলো সব মিথ্যা কথা। অতি সম্প্রতি যে কোম্পানিটা এখানে আসতে রাজি হয়েছে, এক্সন মবিল, এরা কিন্তু নাম্বার ওয়ান। সেভেন সিস্টার বলা হয় যে নাম্বার ওয়ান সাতটি কোম্পানিকে, যারা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যকে বদলে দিয়েছিলো, খুব দরিদ্র দেশ থেকে সৌদি আরব, কাতারকে যারা ধনী দেশে পরিণত করেছে, এক্সন মবিল তার মধ্যে শীর্ষে থাকা প্রতিষ্ঠান। এরা আন্তর্জাতিক ভাবে খুবই প্রভাবশালী। অবশ্যই তারা অর্থনৈতিক ভাবে খুব শক্তিশালী এবং তাদের ভৌগোলিক আধিপত্য আছে। তাদের যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়েও পার পাওয়ার সক্ষমতা আছে। এখন তারা কিন্তু বাংলাদেশ সরকারকে একটা প্রস্তাব দিয়েছে, আমরা তোমাদের সাগর থেকে গ্যাস উত্তোলন করতে চাই। এর অর্থটা কি? কারণ তারা জানে এখানে গ্যাস আছে। সুতরাং এই যে আমরা বিদেশি কোম্পানিকে আনতে চাই, কেউ আসে না। এগুলো কোনো যুক্তি না।
আমাদের এখন গ্যাস দরকার, আমরা এখন যে সংকটে আছি। এ সংকটটা আমাদের অর্থনীতিকে ব্যাপক ভাবে পীড়া দিচ্ছে। এলএনজি আনতে আমাদের ডলারের ঝুড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এই মুহুর্তে আপনাদের গ্যাস দরকার। কিন্তু ইটস ঠু লেইট, অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে নামলেও গ্যাস পেতে পেতে যে সময় লাগবে, তাতে অর্থনীতির অবস্থা বেহাল হয়ে যেতে পারে।
আপনারা বিগত ১০ বছরে কেন এ কাজটা কেন করলেন না। ৪৬টি কূপ খননের প্রোগ্রামটি যদি পাঁচ বছর আগে করা হতো। তাহলে আজ এ রকম সংকট সৃষ্টি হতো না। গ্যাস আমাদের হাতে থাকতো। যদি সাগরের এ প্রোগ্রামটা ১০ বছর আগে করা হতো। তাহলে গ্যাসের সমস্যাই আমাদের থাকতো না, সবকিছু আরো সহজ হতো। এইখানেই হচ্ছে সমস্যা। তাও ভালো কথা, এখন যদি হয়ে থাকে। খনন না হওয়ার চেয়ে দেরি করে হওয়াও শ্রেয়। কিন্তু এটা বুঝতে হবে যে, এসব কাজ আমাদের অতিবিলম্বিত হয়েছে। আরো বিলম্বিত হলে বর্তমানে যে সংকট সেই সংকট আরো গভীর হবে। যাই হোক, যা হওয়ার হয়েছে, অন্তত এখন থেকেই শুরু করতে হবে। বিশেষ করে কূপ খননের প্রোগ্রাম আরও জোরালো ভাবে করতে হবে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে অনুসন্ধান না করার ধারা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
অধ্যাপক বদরুল ইমাম: ভূতত্ত্ববিদ, সদস্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অভিযোগ অনুসন্ধান ও গবেষণা কমিশন, ক্যাব।
[২৯ এপ্রিল ২০২৩ (শনিবার), রাজধানীর তোপখানা সড়কে অবস্থিত সিরডাপ মিলনায়তনের এটিএম শামসুল হক অডিটোরিয়ামে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর উদ্যোগে ‘‘ক্যাব-এর সংস্কার প্রস্তাব প্রেক্ষিত: ‘জ্বালানি সংকট ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন’ শীর্ষক নাগরিক সভায় গ্যাস খাত ও গ্যাস খাত সংস্কার প্রস্তাবসমূহ বিষয়ে অধ্যাপক বদরুল ইমাম যে আলোচনা করেন তার শ্রুতিলিখনের ওপর ভিত্তি করে লেখাটি প্রস্তুত করা হয়েছে।]