জনসন্তুষ্টির বিদ্যুৎ হচ্ছে গণ-অস্বস্তির কারণ!

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: বিদ্যুৎ খাতে সরকারের যে সাফল্য সারাদেশের মানুষকে দারুণ ভাবে খুশি করেছিল, এ বছর সেই বিদ্যুৎই হয়ে উঠতে পারে গণমানুষের সবচেয়ে বড় অস্বস্তির কারণ। এর সব লক্ষণ এখন স্পষ্ট। চলতি ফেব্রুয়ারির শেষ কিংবা আগামী মার্চ মাস থেকে তা প্রকট হয়ে ওঠার আশঙ্কা হয়েছে।

গত এক যুগে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অভূতপূর্ব সাফল্য প্রশ্নাতীত। এই সময়ে শুধু যে দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জিত হয়েছে, তা-ই নয়, চাহিদার তুলনায় বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সামর্থ্যও অর্জন করেছে দেশ।


একদিকে এলএনজি আমদানি সীমিত রাখা, অন্যদিকে কয়লা আমদানিও অনিশ্চিত হলে সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতে হবে ফার্নেস তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর ওপর। কিন্তু ওই কেন্দ্রগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় ৬০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চালানো হলেও বোরো মৌসুম, গ্রীষ্মকাল ও রমজান মাসের বাড়তি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না।


এক যুগে দেশের প্রতিটি ঘরে (হাউসহোল্ড) বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। দেশে এখন আর বিদ্যুৎ-সংযোগ ছাড়া কোনো বাড়িঘর নেই। নতুন কোনো পরিবার বিদ্যুৎ-সংযোগের জন্য আবেদন করলেও অবিলম্বে তা পেয়ে যাচ্ছে। যেখানে জাতীয় গ্রিড-সংযোগ নেই, অর্থাৎ অফগ্রিড এলাকায় বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ (সোলার হোম সিস্টেম), সোলার মিনি গ্রিড, মাইক্রো গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া হয়েছে।

সরকারের এই সাফল্যে দেশের শ্রেণি-পেশা, সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে জনসাধারণ সন্তুষ্ট হয়েছে। সরকারের ওপর তাদের আস্থা বেড়েছে। তারা এই সাফল্য উদযাপনও করেছে। যদিও উৎপাদন সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুতের সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থা উন্নত ও সম্প্রসারিত হয়নি। তারপরও দেশের সর্বস্তরের মানুষ বিদ্যুতের সুফল ভোগ করেছে। বিদ্যুৎ খাতে সরকারের সাফল্য দেশে ব্যাপক জনসন্তুষ্টির জোয়ার সৃষ্টি করেছিল।

কিন্তু কোভিড-১৯-পরবর্তী সময়ে সারা পৃথিবীতে যখন পূর্ণোদ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হতে থাকে, তখন চাহিদা বাড়তে থাকে জ্বালানির।

ফলে বিশ্ব বাজারে জ্বালানির চাহিদা ও মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা তৈরি হয়। এর পরপরই গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু হলে জ্বালানির বিশ্ববাজারে সৃষ্টি হয় টালমাটাল পরিস্থিতি।

একদিকে সব ধরনের জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। পাশাপাশি বাড়তে থাকে মার্কিন ডলারের দাম। তার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে কমতে থাকে দেশীয় মুদ্রা টাকার মান। ফলে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের মতো বাংলাদেশও সেই পরিস্থিতির শিকার হয়। জ্বালানির দাম রেকর্ড পরিমাণে বাড়িয়েও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কারণ, অতি উচ্চমূল্যের ডলার দিয়ে চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি আমদানি করা সম্ভব হয় না। আর জ্বালানি না হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় না। কাজেই চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনও কম করতে হয়।

এই পটভূমিতে আসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের ঋণ প্রস্তাব নিয়ে। সঙ্গে নিয়ে আসে আর্থিক খাত সংস্কার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহারের মতো কিছু শর্ত। সরকার এর আগে থেকেই জ্বালানির দাম বাড়াতে শুরু করে। এর মধ্যে সরকার পড়ে যায় অর্থসংকটে। ফলে বাজেট বাস্তবায়নেও সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থসহায়তা দরকার হয়। এ অবস্থায় আইএমএফের ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য সরকার জ্বালানি তেল ও গ্যাসের পাশাপাশি বিদ্যুতেরও দাম বাড়াতে শুরু করে। এখন প্রতি মাসের শেষে পরবর্তী মাসের জন্য বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু করেছে সরকার।

এভাবে প্রকট জ্বালানি-সংকটের সঙ্গে কিছু বিদ্যুৎ-সংকট নিয়ে ২০২২ সাল অতিক্রান্ত হলেও এ বছরে, অর্থাৎ ২০২৩ সালের চ্যালেঞ্জ আরও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সরকারের পরিকল্পনা ছিল, এ বছর বিশ্ববাজার থেকে শুধু দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতার বাইরে স্পট মার্কেট থেকে চড়া দামে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি স্বল্পতম পরিমাণে সীমিত রাখবে। কেবল মার্চ-এপ্রিল-মে মাসের জন্য স্পট মার্কেট থেকে প্রতি মাসে এক জাহাজ করে এলএনজি আমদানি করা হবে। বোরো মৌসুম, গ্রীষ্ম এবং পবিত্র রমজান মাসেরই বাড়তি চাহিদা সামাল দেওয়ার জন্য এলএনজির স্থলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি করা হবে কয়লা থেকে।

কিন্তু এই হিসাবেও গোল বেধেছে। আগামী মার্চ মাস থেকে অন্তত ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা ছিল ভারতের ঝাড়খন্ডে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। কিন্তু তাতে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কারণ প্রথমত, আদানির বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন কৃষক কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা করেছেন। মামলার বিষয়বস্তু হচ্ছে—আদানি তাঁদের কৃষিজমির ওপর সঞ্চালন লাইনের টাওয়ার স্থাপন করেছে। কিন্তু তাঁদের কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি। ৭ ফেব্রুয়ারি ওই মামলার শুনানি হবে। দ্বিতীয়ত, আদানির সঙ্গে আমাদের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) যে বিদ্যুৎ কেনা-বেচার চুক্তি হয়েছে, বিপিডিবি তা সংশোধনের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। কারণ, ত্রুটিপূর্ণ ওই চুক্তিতে কয়লার দাম অনেক বেশি ধরা হয়েছে। ফলে বিদ্যুতের দামও অনেক বেশি পড়বে। উদাহরণ হিসেবে বিপিডিবি বলেছে, আদানি গত জানুয়ারি মাসে কয়লা আমদানির জন্য টনপ্রতি ৪০০ মার্কিন ডলার দামে ঋণপত্র (এলসি) খোলার কথা বিপিডিবিকে জানিয়েছে। কিন্তু ওই সময় বিশ্ববাজারে প্রতি টন কয়লা পাওয়া যাচ্ছিল ২৫০ ডলারে।

আদানির পরে দেশের তিনটি- পায়রা ১৩২০, রামপাল ১৩২০ এবং এস আলম ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা সরকারের পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কিন্তু এই কেন্দ্রগুলো থেকে পূর্ণ ক্ষমতায় বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য কয়লার নিরবচ্ছিন্ন আমদানি ও সুষ্ঠু সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে।

একদিকে এলএনজি আমদানি সীমিত রাখা, অন্যদিকে কয়লা আমদানিও অনিশ্চিত হলে সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতে হবে ফার্নেস তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর ওপর। কিন্তু ওই কেন্দ্রগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় ৬০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চালানো হলেও বোরো মৌসুম, গ্রীষ্মকাল ও রমজান মাসের বাড়তি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না। ফলে লোডশেডিং ২০২২ সালের চেয়েও বেশি হতে পারে। এই পরিস্থিতি থেকে শিগগিরই পরিত্রাণের কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে যে বিদ্যুৎ খাতের সাফল্য নিয়ে সরকার উচ্চকণ্ঠ এবং দেশবাসী উচ্ছ্বসিত ছিল, সেই বিদ্যুৎই এ বছর জনসাধারণের মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি করবে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও ব্যাহত হবে।

সরকার এলএনজি আমদানির পাশাপাশি আমাদের দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে কিছু বেশি গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা তৈরিতে পরিকল্পিতভাবে নজর দিলে আজকের এই জটিলতা হতো না। কিন্তু সরকার তা না করে অগ্রাধিকার দিয়েছে জ্বালানি আমদানির ওপর।ভুলটা হয়েছে সেখানে এবং এই ভুলের মাশুল অনেক দিন ধরে দিতে হবে।

জ্বালানির আরেকটি বড় খাত হচ্ছে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলপিজি)। আবাসিক, বাণিজ্যিক ও পরিবহন খাতে এলপিজির ব্যবহার ক্রমাগত ভাবে বাড়ছে। এলপিজিও আমদানি নির্ভর একটি জ্বালানি পণ্য। এর বিশ্ব বাজারও অস্থির। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) প্রতি মাসে গ্রাহক পর্যায়ে এলপিজির দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার একটি আইনি প্রক্রিয়া চালু করেছে। তবে বেশির ভাগ সময়ই তাদের নির্ধারিত দামে বাজারে এলপি গ্যাস পাওয়া যায় না।

এই সামগ্রিক অবস্থায় চলতি বছর মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পরিস্থিতি নিয়ে দুশ্চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে। একমাত্র রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দ্রুত অবসান হলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে সেই যুদ্ধ অবসানের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

লেখক: অরুণ কর্মকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।

সৌজন্যে, আজকের পত্রিকা।