ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: অরুণাচল প্রদেশ এবং এর সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলগুলোয় পরিকল্পিত ১৫৪টি জলবিদ্যুৎ বাঁধ বহুবিধ পরিবেশ ও জলবায়ু ঝুঁকি এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি করবে। ভারত ও চীন উভয়েই জলবিদ্যুতের নামে ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশের স্বাদুপানির প্রধানতম উৎসটিকে একেবারেই সংকীর্ণ করে তুলবে।
বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য অরুণাচল প্রদেশ থেকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপন করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সর্বশেষ বাংলাদেশ সফরকালে প্রস্তাবটি জোরেশোরে আলোচনার টেবিলে আসে। অরুণাচল প্রদেশ এবং এর সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলগুলো বিপুল পরিমাণ জলবিদ্যুৎ শক্তির উৎস হিসেবে চিহ্নিত। জলবিদ্যুতের যাবতীয় সম্ভাবনা অনুসন্ধানে ভারত এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অর্থায়নের মডেলসহ কারিগরি পরিকল্পনার কাজ এগিয়ে নিয়েছে।
ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের করিডর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্ব থেকে পশ্চিম অঞ্চলে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়ার গ্রিডলাইনের রুটের নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে দুই দেশের যৌথ পরিচালনা কমিটি (জেএসসি)। জ্বালানি খাতে ২০১৪ সালে ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতাবিষয়ক যৌথ পরিচালনা কমিটির (জেএসসি) সপ্তম বৈঠকে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া বা জামালপুরসহ তিনটি রুট ব্যবহার করে ভারতের আসাম থেকে দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ প্রেরণ করতে পারে।
বাংলাদেশের নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ২২ হাজার মেগাওয়াটের বিপরীতে সর্বোচ্চ উৎপাদন সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। তথাপি বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর থেকে ভেড়ামারা হয়ে প্রায় ১ হাজার ১০০ মেগাওয়াট এবং উত্তর-পূর্ব ত্রিপুরা রাজ্য থেকে আখাউড়া হয়ে ১৪০ মেগাওয়াট ক্রসবর্ডার বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সরকার-সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশ তার ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ভারতীয় ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে সঞ্চালিত মোট বিদ্যুতের ২০-২৫ শতাংশ কেনার পাশাপাশি হুইলিং চার্জ থেকে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ভারতকে স্থল ও নৌ ট্রানজিট, চট্টগ্রাম বন্দরের অগ্রাধিকারভিত্তিক ব্যবহার এবং ট্রান্সশিপমেন্টসহ বহুমুখী করিডর ও সংযোগসুবিধা দিয়েছে। তবে সমালোচকেরা বলছেন, প্রাক্কলিত অনুপাতে প্রত্যাশিত ট্রানজিট ফি বাংলাদেশ পায়নি।
ভারত বাংলাদেশকে টনপ্রতি ট্রানজিট ফি দিতে অস্বীকার করে জাহাজ কিংবা ট্রাকপ্রতি নামমাত্র ফি দিতে চায়, এতে নৌরুটের ড্রেজিং, সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা পণ্য নিরাপত্তার কোনো খরচই উঠে আসবে না। অর্থাৎ বিপুল আলোচিত ট্রানজিট বাংলাদেশের পক্ষে প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক উপযোগ কতটা তৈরি করতে পারবে, সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
বাংলাদেশের নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ২২ হাজার মেগাওয়াটের বিপরীতে সর্বোচ্চ উৎপাদন সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। তথাপি বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর থেকে ভেড়ামারা হয়ে প্রায় ১ হাজার ১০০ মেগাওয়াট এবং উত্তর-পূর্ব ত্রিপুরা রাজ্য থেকে আখাউড়া হয়ে ১৪০ মেগাওয়াট ক্রসবর্ডার বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ।
দুই.
বাংলাদেশে নন-নিউক্লিয়ার নবায়নযোগ্য বা সবুজ বিদ্যুতের প্রসঙ্গ উঠলে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে পরিকল্পিত ১৫৪টি জলবিদ্যুৎ বাঁধ থেকে ‘সস্তা ও দূষণহীন’ জলবিদ্যুৎ আমদানির পরামর্শ আসে। বস্তুত অরুণাচল প্রদেশ এবং এর সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলগুলোয় পরিকল্পিত ১৫৪টি জলবিদ্যুৎ বাঁধ বহুবিধ পরিবেশ ও জলবায়ুঝুঁকি এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি করবে। এগুলো চীনকে ব্রহ্মপুত্রের ওপর অতি বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করার বৈধতা দেবে। দিন শেষে ভারত ও চীন উভয়েই জলবিদ্যুতের নামে ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশের স্বাদুপানির প্রধানতম উৎসটিকে একেবারেই সংকীর্ণ করে তুলবে।
তিব্বতের বিদ্যুৎ–ঘাটতি কমাতে ব্রহ্মপুত্রের পানিসম্পদ ব্যবহার করে চারটি বৃহৎ বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা আগে থেকেই চীনের আছে। শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা ও তিস্তা থেকে প্রত্যাশিত পানি না পাওয়ায় বাংলাদেশের স্বাদুপানির প্রধানতম উৎস ব্রহ্মপুত্র (বাংলাদেশে যমুনা নামে পরিচিত) নদ। এই পানির বড় অংশ আসে হিমালয়বিধৌত অঞ্চলগুলোর বিপুল মৌসুমি বৃষ্টি থেকে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ভারতের সীমানা খুবই সামান্য (জনসংখ্যার ৩ শতাংশ, ভূমির ৬ শতাংশ)। অপেক্ষাকৃত কম জনবহুল এই অঞ্চল চীনের ভূমির মাত্র ৩ শতাংশ।
অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা বাংলাদেশের ভূমির ২৭ শতাংশ। এখানে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের বসবাস। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর নেভাল অ্যানালাইসিসের (সিএনএ) গবেষণামতে, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বর্তমানে বাংলাদেশের সেচ চাহিদার অন্তত ২৫ শতাংশ পানিঘাটতি রয়েছে। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার প্রস্থের যমুনা চলমান শুষ্ক মৌসুমে মাত্র ৭০০ মিটারে নেমে এসেছে। সব মিলিয়ে চীন ও ভারতের উপর্যুপরি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় পানির চরম সংকট দেখা দিতে পারে। তাই যেকোনো নতুন পরিকল্পনায় পানিপ্রাপ্তির গ্যারান্টিক্লজ যুক্ত থাকা সমীচীন।
গবেষণা সংস্থা ‘এনার্জি মিনিট’-এর মতে, বর্তমান বিশ্বের ২৩ শতাংশ এনথ্রোপোজেনিক মিথেন উৎপাদনের জন্য দায়ী বিশ্বের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো। জলবিদ্যুৎ বাঁধে জলাবদ্ধতা থেকে মিথেন এবং কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ অপরাপর গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন হয়। কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়েও মিথেন প্রায় ৩০ গুণ বেশি ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস (সূত্র: এনার্জি-মিনিট)।
ভারতের যেকোনো জলবিদ্যুৎ বাঁধ শুধু জলবিদ্যুৎ প্রকল্পেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং জলাধার ভরাট ও আন্তনদী সংযোগের মতো বিষয়ও এতে যুক্ত হবে। কেননা ভারতের আন্তনদী সংযোগের জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের বৃহৎ লক্ষ্য হচ্ছে পানি-উদ্বৃত্ত অঞ্চল থেকে পানি-ঘাটতি অঞ্চলের দিকে খাবার ও সেচের পানি প্রবাহিত করা।
যেহেতু ভারতে বৈশ্বিক নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের লক্ষ্য অর্জনে সৌর ও বায়ুবিদ্যুতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে, তাই অরুণাচল প্রদেশের অতিখরুচে জলবিদ্যুৎ আদতে ভারতের প্রয়োজন নেই, দরকার আসলে পানি-ঘাটতি অঞ্চলের দিকে পানি প্রত্যাহারের। ব্রহ্মপুত্র (যমুনা) নদ ও এর শাখা নদীর ওপর পরিকল্পিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর হলে, তা আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পকেই এগিয়ে নেবে। আশঙ্কা হয়, এই প্রক্রিয়া ভাটির ব্রহ্মপুত্র (যমুনা) নদকে ধীরে ধীরে হত্যা করবে।
এতে বাংলাদেশ কৃষি এবং পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেবে। তার ওপর এই বাঁধগুলোর অনেকগুলো জলাধার হিসেবে কাজ করবে এবং ভবিষ্যতে চ্যানেল দিয়ে পরস্পর সংযুক্ত করা হবে। উদাহরণস্বরূপ, মানস-শঙ্কোশ-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে এরই মধ্যে যমুনা নদীর শাখানদী মানস ও শঙ্কোশের পানি সরিয়ে নেওয়ার মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে। (সূত্র: ইন্ডিয়া ওয়াটার পোর্টাল/ন্যাশনাল-রিভার-লিংকিং-প্রজেক্ট)। মোটকথা, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ কিংবা জলবিদ্যুৎ আমদানির ফাঁদে পড়ে যাতে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি বিসর্জন না দেওয়া হয়, সেটি সর্বোচ্চ গুরুত্বসহ বিবেচনায় রাখতে হবে বাংলাদেশকে।
গবেষণা সংস্থা ‘এনার্জি মিনিট’-এর মতে, বর্তমান বিশ্বের ২৩ শতাংশ এনথ্রোপোজেনিক মিথেন উৎপাদনের জন্য দায়ী বিশ্বের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো। জলবিদ্যুৎ বাঁধে জলাবদ্ধতা থেকে মিথেন এবং কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ অপরাপর গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন হয়। কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়েও মিথেন প্রায় ৩০ গুণ বেশি ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস (সূত্র: এনার্জি-মিনিট)। ‘নেপালের জলবিদ্যুৎ খাতের চ্যালেঞ্জ ও সুবিধার মূল্যায়ন’ নামক গবেষণা প্রবন্ধে শর্মা তেজস্বী বলেছেন, ‘হিমালয়ান নদীগুলোর বেশির ভাগ জলবিদ্যুৎকেন্দ্র অত্যধিক ভাঙন, পলিপতন ও অবক্ষেপে পড়ে। এতে জলাধারের ক্ষমতা ও জীবনকাল সংকুচিত হয়। জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের হাত ধরে অনিয়মিত বন্যার অভিশাপও অমূলক নয়। একটি জলবিদ্যুৎ বাঁধের জলাধার ভরাটে কয়েক বছর সময় লেগে যেতে পারে। এ সময় জলপ্রবাহ সংকুচিত হয়ে ভাটিতে পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পলিবাহিত নদীতে বাঁধ দেওয়ায় তা ভাটিতে পলি পতনজনিত উর্বরতা হ্রাস করে। এতে ম্যানগ্রোভ বন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, স্বাদুপানিতে লবণাক্ততা বাড়ে এবং ব-দ্বীপায়নপ্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়।’
তিন.
ভারত-বাংলাদেশের ২০তম জেএসসি/জেডব্লিউসি বৈঠক হবে ২৮ ও ২৯ মে। এর আগে ২০২১ সালের ২১ ও ২৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশের কারিগরি টিমের পক্ষ থেকে ১৯তম জয়েন্ট স্টিয়ারিং কমিটির মিটিংয়ে ‘বারনগর-পার্বতীপুর কাটিহার’ সঞ্চালন করিডর বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বিষয়ে পাঁচটি প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে। এর প্রথমটি ছিল সঞ্চালিত জলবিদ্যুৎ উৎসের জলবিদ্যুৎ বাঁধে পানি ব্যবহার নীতিমালা এবং তথ্য ভারত-বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশনকে (জেআরসি) অবহিত করা। পাশাপাশি ছিল বিদ্যুৎ সঞ্চালনসম্পর্কিত তথ্য আদান–প্রদান, হাইড্রোলজিক্যাল ও ওয়াটার মডেলিং স্টাডি করা, পরিবেশগত প্রভাব পর্যালোচনা করা, লোকালয় ও কৃষিভূমির ওপর দিয়ে যাওয়া উচ্চ ভোল্টেজ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের সামাজিক অর্থনৈতিক প্রভাব নিরূপণ করা। আশ্চর্যজনকভাবে ভারত এই প্রস্তাবের প্রথমটিতে ভেটো দিয়ে বসে, বাদবাকি চারটি প্রস্তাবে সম্মতি জানায়।
প্রথম প্রস্তাবে বাংলাদেশের কারিগরি কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে বাংলাদেশ ভাটির অঞ্চলের (লোয়ার রিপারাইন) দেশ হওয়ায় জল-ব্যবহার ও জল-বণ্টনের বিষয়টি ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশনে (জেআরসি) আলোচনা করা দরকার। ভারত তাতে অসম্মতি জানায়। ভারত দুটি বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে আসে। এক. ‘ডিউ ডিলিজেন্স’ যাচাই করা। দুই. দেশের প্রতিনিধির সমন্বয়ে কমিটি করা, যারা হাইভোল্টেজ সঞ্চালন লাইনসংক্রান্ত আইনি এবং পরিচালনাগত বিষয়াদি দেখভাল করবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের পানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত না করার নিশ্চয়তা তৈরির যেকোনো গ্যারান্টি ক্লজকে পাশ কাটিয়ে গেছে ভারতীয় পক্ষ।
ডিউ ডিলিজেন্স মূলত একটি ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া। এটি হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে আইনগত প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য একপক্ষের দ্বারা নেওয়া যুক্তিসংগত পদক্ষেপ। এতে অপর পক্ষের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হয় না আসলে। মোটকথা, ভারত ব্রহ্মপুত্রের পানির ব্যবহার নীতিপদ্ধতি, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জলাধার ভরাটে ব্রহ্মপুত্রের পানি ব্যবহারের পরিমাণ ও সময়, কিংবা অপরাপর পানিসংক্রান্ত তথ্য ও তথ্যশালা যৌথ নদী কমিশনে পাঠাতে রাজি নয়। বিগত প্রায় এক দশক ধরে যৌথ নদী কমিশনকে অকার্যকর করে রাখার যে ধারাবাহিকতা ভারতের তরফে লক্ষণীয়, তার সঙ্গে এই সিদ্ধান্তটি মিলে যায়।
‘ডিউ ডিলিজেন্স’ যাচাইয়ের ভারতীয় প্রস্তাব মেনে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিষয়টি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) চিঠিতে জানিয়েছে। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় পাউবোও আন্তদেশীয় প্রকল্পটির দ্বারা বাংলাদেশের পরিবেশগত ক্ষতিসহ ভাটির দেশ হওয়ায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাবগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে পিডিবি, পাউবো, নদী ও পানি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। উল্লিখিত সঞ্চালন লাইন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইকে অত্যন্ত উচ্চমানসম্পন্ন ও ভবিষ্যৎ–মুখী হওয়া চাই, যাতে বর্তমানের অবহেলায় কোনো ভবিষ্যৎ ঝুঁকি তৈরি না হয়। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের অধ্যয়নের সার্বিক সুবিধার্থে বাংলাদেশের নদী ও পানির আইনগত সুরক্ষা এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আন্তনদীর পানি বণ্টনের ভবিষ্যৎ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, নদী ও পানি গবেষণার বিশদ খুঁটিনাটি, পরিবেশগত এবং সামাজিক প্রভাব পর্যালোচনা করতে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্যমান ও সম্ভাব্য হাইড্রোপাওয়ার স্টেশনগুলোর বিশদ তথ্য এবং ডেটাবেজ, ডিজাইন, পরিচালনা-রক্ষণাবেক্ষণ নীতিপদ্ধতি, পানিপ্রবাহ ও পানি বণ্টন ইত্যাদির নিখুঁত বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
বর্তমানে বাংলাদেশ-নেপালের মধ্যেও ঋতুভেদে বিদ্যুৎ চাহিদার তারতম্যের আলোকে পারস্পরিক বিদ্যুৎ–বাণিজ্যের বিষয় আলোচিত হচ্ছে। নেপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্থায়ন, সম্ভাব্য প্রকল্প চিহ্নিতকরণ, উভয় দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ আমদানি-রপ্তানির পন্থা নির্ধারণ ও আন্তদেশীয় বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য উভয় দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত দুটি পৃথক যৌথ কারিগরি দল (উৎপাদনও সঞ্চালন) কাজ করছে। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নদী অববাহিকাগুলো পরস্পর আন্তসংযুক্ত বলে ভবিষ্যৎ পানি ব্যবহারের তথ্য আদান-প্রদান, পানি বণ্টন, পরিবেশগত সুরক্ষা এবং জলবায়ুঝুঁকির প্রশ্নে চীন-ভারত-নেপাল-ভুটান-বাংলাদেশের মধ্যে সমন্বিত একটি আঞ্চলিক তথ্যপ্রবাহ এবং ‘উইন-উইন’ সমঝোতার ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে বিদ্যুৎ–বাণিজ্যের কাজ এগিয়ে নেওয়াই অধিকতর কল্যাণময় এবং টেকসই হবে বলে মনে করি।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থাকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর, অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা, উন্নয়ন প্রশ্নে বাংলাদেশের কিছু সংকট ও সম্ভাবনা।
সৌজন্যে, প্রথম আলো।