ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: গত ৪ অক্টোবর জাতীয় গ্রিডে বিভ্রাট দেখা দেয়ায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের অর্ধেকেরও বেশি এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে জাতীয় গ্রিড বন্ধ হয়ে বিদ্যুৎ বিপর্যয় একেবারে বিরল নয়। ১৯৯০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত অসংখ্যবার নানা মাত্রায় ঘটনাটি ঘটেছে। ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর সারাদেশে বড় ধরনের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে। ওই সময় যে মাত্রায় বিপর্যয় হয় তা অতীতের সব জানা রেকর্ড ভঙ্গ করে দেয়।
তখন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে একাধিক রিপোর্টে বলা হয়, ভেড়ামারায় জাতীয় গ্রিডে বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের সংযোগস্থলের ত্রুটি থেকেই বিভ্রাটের শুরু। ২০১৭ সালের ৩ মে আকস্মিক গ্রিড বিপর্যয়ে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমের ৩২টি জেলা কয়েক ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ছিল। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় গ্রিডের আরেকটি বিপর্যয়ে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল বিভাগসহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা বিদ্যুৎহীন থাকে। আর আঞ্চলিক বিভ্রাট প্রায়ই ঘটছে। সঞ্চালন ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নের অভাবে এমন বিপর্যয় বলা যায় না।
আমরা যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি তা সাধারণত ফসিল ফুয়েল, সৌরশক্তি এবং পানি ও বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন করা হয়। বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ একটি নেটওয়ার্কে যুক্ত করা হয়, যা গ্রিড নামে পরিচিত। এই গ্রিডের কাজ হলো বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন জ্বালানি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ম্যানেজ করে মানুষের বাড়ি, শিল্প-কারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে পৌঁছে দেয়া এবং চাহিদা অনুযায়ী বণ্টন ও বিতরণ এবং নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা। আর জাতীয় গ্রিড হলো প্রতিটি গ্রিডের পারস্পরিক সংযোজন।
জাতীয় গ্রিডের অন্যতম অংশ এনএলডিসি (জাতীয় লোড ডেসপাস সেন্টার) এবং এর কাজ হলো সারা দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা। বিভিন্ন ডিভিশনের গ্রিডের সঙ্গে আন্তঃসংযোগ থাকে। ফলে একটি গ্রিড ফেল করার কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হলে অন্য ডিভিশনের গ্রিড থেকে বিদ্যুৎবিহীন অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হয়, যদি বাড়তি উৎপাদনক্ষমতা থাকে। তবে বাংলাদেশে বাড়তি উৎপাদনক্ষমতা থাকলেও জ্বালানি সংকটের কারণে এমনিতেই লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে জ্বালানি সাশ্রয় করা হচ্ছে। ফলে এভাবে বিদ্যুৎ শেয়ার করার সুযোগ বাংলাদেশে নেই। আবার জাতীয় গ্রিড ফেল করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সারা দেশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।
গ্রিড কডের নির্দেশনা মেনে বাংলাদেশে প্লান্টগুলো থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউটিলিটি/লাইসেন্সি/ কোম্পানি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনগুলোয় সরবরাহ করে না এবং সঞ্চালন লাইনগুলো থেকে প্রাপ্ত ওই কোড মেনে বিদ্যুৎ বিতরণ ইউটিলিটি/ লাইসেন্সি/কোম্পানি বিতরণ বা বণ্টনও করে না। অর্থাৎ গ্রিড কোডের শর্তাদি না মেনে বিদ্যুতের জোগান দেয়া হয়। এক কথায় বলা যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ লাইসেন্সিরা কেউই গ্রিড কমপ্লায়েন্স নয়। ফলে গ্রিড কোন ভাবেই ঝুঁকিমুক্ত নয় এবং সার্বক্ষণিক চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত কোম্পানিগুলো চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে। তা যথাযথ ভাবে নিশ্চিত করা হলে বিতরণ লাইনগুলোর কোন পর্যায়েই ওভারলোডেড হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। কিন্তু বাস্তবে বিতরণ লাইনগুলোকে ওভারলোডেড থেকে সুরক্ষা করার মতো কোন ব্যবস্থাই যথাযথভাবে কার্যকর আছে, বলা যায় না। যেসব প্লান্ট গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে, তার প্রায় ৩০ শতাংশ এনএলডিসির আওতায় আনা হয়নি বা তারা আসেনি। এক কথায় বলা যায়, বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্লান্টগুলোর ৩০ শতাংশই গ্রিড কমপ্লায়েন্স নয়। সুতরাং এসব প্লান্টই গ্রিড বিপর্যয় ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। আবার বাদবাকিরা গ্রিড কোডের শর্তাদি মেনে বিদ্যুতের জোগান দেয় কিনা তারও নিশ্চয়তা নেই।
বিদ্যুৎ বিতরণ গ্রিড কমপ্লায়েন্স নয়- এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো, স্টিল উৎপাদন কারখানাগুলো। তারা গ্রিড কোড নির্দেশনা না মেনেই উচ্চতর ভোল্টেজে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে আসছে। তারা গ্রিডের জন্য ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ। এনএলডিসির কোন নির্দেশনাই তারা মানে না।
যেকোনো পর্যায়ে ওভারলোডেড হওয়ার কারণে সরবরাহ করা বিদ্যুতের ভোল্টেজ লেভেল কমে যেতে পারে এবং সেজন্য ফ্রিকোয়েন্সির (তরঙ্গ) ভারসাম্য নষ্ট হয়। গ্রিড বিপর্যয় ঘটে। ধারণ করা হচ্ছে, আলোচ্য গ্রিড বিপর্যয় এ কারণেই ঘটেছে।
দেশের বিদ্যুতের চাহিদা, উৎপাদন, সঞ্চালন পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করে এনএলডিসি। প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র দিন-রাত কত ঘণ্টা সচল থাকবে, কখন কত মেগাওয়াট উৎপাদন করবে তাও নির্ধারণ করে এনএলডিসি। আধুনিক সঞ্চালন ব্যবস্থায় এনএলডিসি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে এসব কাজ করে। তবে বাংলাদেশে তা হয় না। এখানে কোন কোন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু ও বন্ধের নির্দেশনা, কেন্দ্রে কত মেগাওয়াট উৎপাদন হবে- এর জন্য ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোনে নির্দেশনা দেয়া হয়। ফলে কোথাও চাহিদা বাড়লে বা কমলে সঙ্গে সঙ্গে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
দেশে বেসরকারি পর্যায়ে স্থাপিত রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও দীর্ঘমেয়াদের কিছু আইপিপি কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি, বিশেষ করে জেনারেটরগুলো মানহীন। এছাড়া রেন্টাল, কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো বেজ লোডকেন্দ্র হিসেবে স্থাপন করা হয়নি। উদাহরণ হিসেবে তারা বলছেন, ৫০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে ২৫টি জেনারেটর দিয়ে। এটাকে কোন ভাবেই বিদ্যুৎকেন্দ্র বলা যায় না। এসব মানহীন কেন্দ্রের কারণেও গ্রিড ঝুঁকিপূর্ণ।
২০১৪ সালে আমাদের বড় ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে আমাদের বিদ্যুৎ খাত উঠে আসতে পারেনি। সে সময়ে গঠিত তদন্ত কমিটি বেশকিছু সুপারিশও করেছিল। তার বাস্তবায়নের অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ এবং ভোক্তা কেউ গ্রিড কোডের তোয়াক্কা করেনি। সাপ্লাই ও ডিমান্ড সাইডের এমন পরিস্থিতি গ্রিডকে চরম ঝুঁকির মধ্যে রেখেছে। সব সময় গ্রিড এ ধরনের ঝুঁকির মধ্যে থাকে। যেকোনো সময় গ্রিড অকার্যকর হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণকে গ্রিড কমপ্লায়েন্স করা না হলে গ্রিড যেমন এমন অবস্থায় অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং তেমন ভবিষ্যতেও থাকবে।
বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় গ্রিড একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর অঙ্গ। গ্রিড বন্ধ হয়ে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটার অনেক কারণ আছে। সঞ্চালন লাইনে (গ্রিড) যদি তার ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হয়, তাহলেও গ্রিড বিপর্যয় ঘটতে পারে। সঞ্চালন লাইনের কোন সংযোগস্থল ত্রুটিযুক্ত হওয়ার কারণ স্পার্ক হতে পারে এবং তা থেকেও গ্রিড বন্ধ হতে পারে। বিদ্যুৎ সঞ্চালনকালে ফ্রিকোয়েন্সি হেরফের হলেও গ্রিড বন্ধ হয়। এমন আরো অনেক কারণে গ্রিড বন্ধ হতে পারে। এর যেকোনো একটি কারণ যত তীব্র হবে, বিপর্যয়ও হবে তত ব্যাপক। তবে যেকোনো দেশের জাতীয় গ্রিডের একটি প্রধান অংশ (ব্যাকবোন) থাকে। তার সঙ্গে যুক্ত থাকে একাধিক আঞ্চলিক গ্রিড। সে বিভক্তিগুলো আবার এক সুতায় গাঁথা থাকে। এর মধ্যে এমন কারিগরি ব্যবস্থা রয়েছে, যাতে জাতীয় গ্রিডের কোন আঞ্চলিক অংশে উল্লিখিত যেকোনো কারণে ত্রুটি দেখা দিলে বা বন্ধ হয়ে গেলে সম্পূর্ণ গ্রিড বন্ধ হবে না। তবে ব্যাকবোন বন্ধ হওয়ার কোন কারণ ঘটলে তার প্রভাব সর্বব্যাপী হয়।
গ্রিডে সমস্যা হলেও তা নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি রয়েছে। যেমন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে গ্রিডের সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত করা যায়, যাতে গ্রিড বন্ধ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গ্রিড থেকে বিযুক্ত হয়ে যাবে। ফলে গ্রিড বন্ধ হলেও কেন্দ্রটি বন্ধ হবে না। গ্রিড মেরামতের সঙ্গে কেন্দ্রটি আবার গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত করা যাবে। তবে ২০১৪ সালের বিপর্যয়ের পর ডেডবাসে ব্যক্তি খাতের বিদ্যুৎ প্লান্টগুলো সংযুক্ত হতে এগিয়ে আসেনি। ফলে গ্রিড সচল হতে বেশ সময় লাগে।
যখন কোন সমস্যার প্রযুক্তিগত সমাধান নিয়ে আসা হয়, তখন দেখা যায় সমস্যা সমাধানের বিষয়টি আসলে গৌণ, মুখ্য হলো এ উপলক্ষে অসাধু ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করা। কোন সমস্যার সমাধানে বটম আপ অ্যাপ্রোচ নয়, টপ ডাউন অ্যাপ্রোচ নেয়া হয়। ফলে স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা ও ন্যায্যতার দিকে থেকে তা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়।
যে বিদ্যুৎ বিভাগ ও ব্যক্তিদের প্রশাসনিক কর্তৃত্বে এসব বিষয় দেখভাল করা হয়, তারা অধিকাংশই কারিগরিভাবে অজ্ঞ, অদক্ষ ও অনুপযুক্ত। লাইসেন্সিদের বোর্ড চেয়ারম্যান বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব বা অতিরিক্ত সচিব এবং ক্ষেত্রবিশেষে মুখ্য সচিবও। তারা সরকারের প্রশাসনিক আমলা। আলোচ্য গ্রিড বিপর্যয়ের জন্য যদি কাউকে অভিযুক্ত করতে হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট বোর্ডকে অভিযুক্ত করতে হয়। তাই সর্বাগ্রে অভিযুক্ত হবেন এসব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ও অতিরিক্ত সচিবরা এবং সরকারের মুখ্য সচিবও।
জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা। ঝুঁকি থেকে গ্রিডকে সুরক্ষিত না করতে পারলে তার দায় বোর্ডের চেয়ারম্যানদের। গ্রিড বা বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সুরক্ষার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়কেও তারা অকার্যকর করে রেখেছেন। তারা একদিকে রেগুলেটর, অন্যদিকে কোম্পানির প্রশাসক। এটি কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। সরকার এসব আমলাকে জবাবদিহির আওতায় আনতে অক্ষম।
বাংলাদেশ ৫০ বছর অতিবাহিত করেছে। কিন্তু প্রফেশনাল প্রতিষ্ঠানের কোথাও প্রফেশনালদের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে জনগণের কাছে তাদের দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহি নিশ্চিত হতো। একদিকে জবাবদিহি নিশ্চিত হতো, অন্যদিকে তাদের প্রফেশনাল জ্ঞান ও দক্ষতা উভয় কারণে এমন সব দুর্ঘটনা প্রতিরোধ হতো। এমন সৌভাগ্য কি কখনো বাংলাদেশের হবে?