ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: তেল-গ্যাস বেসরকারি ভাবে আমদানির সুযোগ দিয়ে নীতিমালা তৈরি করছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। তবে তেল-গ্যাসের মতো কৌশলগত গুরত্বপূর্ণ পণ্য ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেয়ার বিরোধীতা করেছেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যৈষ্ঠ সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা ভোজ্যতেলের মতো জ্বালানি তেলের বাজার সিন্ডিকেট করলে দেশীয় অর্থনীতিতে বিপর্যয় ঘটবে।
ব্যবসায়ীরা তেল-গ্যাস আমদানির সুযোগ পেলে লাভ-ক্ষতি কি হবে?
আমাদের সংবিধানের স্প্রিরিট হলো রাষ্ট্র যাই করুক না কেন অবশেষে তাতে জনগণের কল্যাণ হবে। সে জন্য সরকার রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। তেল-গ্যাস ছাড়াও নব্বই দশক থেকে সরকার ঢালাও ভাবে যে বেসরকারিকরণ অব্যাহত রেখেছে, তা সংবিধান পরিপন্থী এবং স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সরকারের গৃহীত পলিসি মতে তেল-গ্যাস আমদানি সরকারি সংস্থা বিপিসি’র পরিবর্তে ব্যক্তি খাতে যাবে। তাতে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও মুনাফা অনেক বেশি বাড়বে।
গণশুনানীতে প্রকাশ পায়, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েল গত বছরে আমদানি হয় প্রায় ৫০ লক্ষ মেট্রিক টন। ৪৫ লক্ষ টনই আমদানি হয় ব্যক্তি খাতে। বিপিসি’র তুলনায় প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েল ব্যক্তি খাত থেকে পিডিবি’কে কিনতে হয় ১৮ টাকা বেশি দামে। তাছাড়া ভোজ্যতেলের মত তেল-গ্যাস আমদানীও গুটি কয়েক ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে এবং বাজারে কৃত্তিম সংকট সৃষ্টি করে তারা যখন-তখন খেয়াল খুশি মত মূল্যবৃদ্ধি করবে। সরকার ও ভোক্তা উভয়ই জিম্মি হবে। লাভ-ক্ষতির হিসাব তখন পাল্টে যাবে।
জ্বালানি কেন বাণিজ্যিক পণ্য নয়?
জ্বালানি এমন এক পণ্য, যা খাদ্যের চেয়ে কম জরুরী নয়। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে খাদ্য নিরাপত্তা কোন ভাবেই নিশ্চিত হবে না। তাই বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত দেশসমূহে সহনীয় মূল্যে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়। ফলে জ্বালানি বা বিদ্যুৎ খাতকে বাণিজ্যিক খাত হিসেবে দেখা কিংবা সরকারের রাজস্ব আহরণের উৎস হিসেবে দেখা, কোন ভাবেই জনস্বার্থসম্মত হতে পারেনা। তার ওপর যদি জ্বালানিকে বাণিজ্যিক পণ্য গণ্য করা এবং জ্বালানি ব্যবসা ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেয়া হলে জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা সংরক্ষণ ভয়াবহ চ্যালেন্জের সম্মূখীন হবে।
কীভাবে ভয়াবহ হবে তার অনেকগুলো উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। যেকোনো আমদানি পণ্য- চিনি, ডাল, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ নিয়ে ব্যবসায়ীরা যেসব কাণ্ড করে, তা থেকে জনগণের বুঝতে বাকি নেই যে, বাজার ওলিগোপলির শিকার। নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহ নিষ্ক্রীয়। উচ্চ আদালতের রায়ে তা প্রমাণিত।
পণ্য বা সেবার অযৌক্তিক মুল্যবৃদ্ধি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা নির্বিচারে লুণ্ঠনমূলক মুনাফা করছে। সেখানে জ্বালানির মতো গুরত্বপূর্ণ কৌশলগত পণ্য আমদানী ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেয়া বড় বেশী ঝুঁকিপূর্ণ। জ্বালানি নিরাপত্তার প্রশ্নে কোন ভাবেই এমন ঝুঁকি নেয়া চলে না।
সরকারের এতে লাভ কি?
বিপিসিসহ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি সংক্রান্ত বিভিন্ন কোম্পানির বিরুদ্ধে অযৌক্তিক ব্যয় বৃদ্ধি ও মুনাফা করার অভিযোগ রয়েছে। তাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে লুণ্ঠনমূলক মাত্রাতিরিক্ত ঘাটতি বৃদ্ধি পাওয়ায় ভর্তুকি ও মূল্যবৃদ্ধি এখন রিতিমত অসহনীয়। বিপিসি ও পেট্রোবাংলার পরিবর্তে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে তেল-গ্যাস আমদানি করা হলে সরবরাহ ব্যয় আরও বৃদ্ধিতে সরকারের রাজস্ব বাড়বে। ভর্তুকি প্রত্যাহার করা সরকারে জন্য সহজ হবে। মূল্যবৃদ্ধি ব্যবসায়ীরা করবে, সরকার নয়। এভাবেই সরকারের লাভ দেখা হয়। তাতে জ্বালানি নিরাপত্তা ও ভোক্তার জ্বালানি অধিকার, কিংবা রাজনীতিতে কতটা ঝুঁকি বাড়বে, সে সবের কোন কিছুই আমলে আসেনি।
সরকার কি শুধু ব্যবসায়ীদের স্বার্থই দেখবে?
বিদ্যুতের গণশুনানীর সময় আমরা দেখেছি- তরল জ্বালানি থেকে উৎপাদিত বেশির ভাগ বিদ্যুতই ফার্নেস অয়েলভিত্তিক। যার ৯০ ভাগ ব্যক্তি খাতে আমদানি হয়। বিপিসির মাধ্যমে আমদানি হলে লিটারে ১৮ টাকা কম খরচ হয়। তার মানে বিপিসির পরিবর্তে বেসরকারি খাতে ফার্নেস অয়েল আমদানিতে ব্যবসায়ীরা লাভবান হন। বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অধিকাংশ পণ্য আমদানিতে অর্থ পাচারও হয়।
এলপিজি খাতে দেখা গেছে, জ্বালানি বিভাগ নীতিমালা করে এলপিজি ব্যবসা প্রমোট করে এবং এখাত ওলিগোপলির শিকার। ব্যবসায়ীরা মর্জি মাফিক এলপিজি’র দাম যখন তখন বাড়াতো। এলপিজি মার্কেট তাদের শতভাগ নিয়ন্ত্রণে ছিল। তাতে ভোক্তা স্বার্থ ও অধিকার খর্ব হয়। হাইকোর্টের বাধ্যতামূলক আদেশে সে অবস্থার অবসান হয়।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় আসলেই ব্যবসায়ীবান্ধব, ভোক্তা বা জনবান্ধব নয়। ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেয়া হলে জ্বালানি তেল আমদানি ওলিগোপলির শিকার হবে। লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও মুনাফা মাত্রাতিরিক্ত বাড়বে। ভোজ্যতেলের ন্যায় জ্বালানি তেল আমদানি ব্যবসা কতিপয় ব্যবসায়ীর হাতে জিম্মী হবে। তাতে ফলাফল ভয়াভয় হতে বাধ্য। এ কথা কে না বোঝে। তারপরও জ্বালানি তেল আমদানি ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেয়া হবে। কার স্বার্থে ? এখানেই বিভ্রান্তি ও বিস্ময়।
আইএমএফ, ব্যবসায়ী না কি উভয়ের চাপে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে?
কেবলমাত্র আইএমএফ’র চাপে সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমি তা মনে করি না। তবে তা অজুহাত হতে পারে। নব্বই দশক থেকে দেশে বেসরকারিকরণ যেভাবে শুরু হয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় এই সিদ্ধান্ত। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য যত বেশী বৃদ্ধি পাবে, বেসরকারিকরণ তত বেশী তরান্বিত হবে। তবে তাতে অবশ্যই অদৃশ্য শক্তির হাত রয়েছে।
আইএমএফ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি তুলে দিতে বলেছে। আমরাও ভর্তুকি চাই না। তবে তা হতে হবে অন্যায়, অযৌক্তিক, এবং লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও মুনাফা কমিয়ে, মূল্য বা ভর্তুকি বাড়িয়ে নয়। সরকার ১৮ শতাংশ অবধি লোডশেডিং দ্বারা, এলএনজি আমদানি কমানোর পাশাপাশি মূল্য বাড়িয়ে ভর্তুকি তুলে দিচ্ছে। অথচ লুণ্ঠনমূলক ব্যয় এক পয়সাও কমানো হচ্ছে না। এখানেই রহস্য। আমরা বিভিন্ন সময় দেখিয়েছি, অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় কমানো হলে কম-বেশী বিদ্যুৎ খাতে বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা ও গ্যাস খাতে ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় কমানো সম্ভব।
প্রতিবেশি কোন দেশে বেসরকারি পর্যায়ে তেল-গ্যাস আমদানির উদাহরণ আছে কি? থাকলে সেখানে কি অবস্থা?
অনেক দেশেই জ্বালানি তেলের মূল্য অটো এডজাস্টমেন্ট হয়। মূল্য বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হওয়ায় বাজার ব্যক্তি ও সরকারি উভয় ব্যবসায়ীদের জন্য লেভেল প্লেইং ফিল্ডে পরিণত হয়। ফলে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও মুনাফা বৃদ্ধির সুযোগ রহিত হয়। আমাদের বাজার উন্মুক্ত ও প্রতিযোগীতামূলক নয়। মনোপলি এবং/বা ওলিগোপলির শিকার। এখানে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও মুনাফা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। ভোক্তার জ্বালানি অধিকার সুরক্ষায় সরকার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিষ্ক্রীয় থাকে। এখানে সরকার জনগণের জ্বালানি অধিকার নয়, ব্যবসায়ীর স্বার্থ সুরক্ষা দেয়। তাই কোন দেশে বেসরকারি পর্যায়ে তেল-গ্যাস আমদানি হয়, এমন যুক্তি বাংলাদেশে কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা।
অভিযোগ রয়েছে-এলএনজি ব্যবসায়ীদের স্বার্থে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যকর উদ্যোগ কম। এখন তারা তেল-গ্যাস আমদানির সুযোগ পেলে এ সমস্যা আরও ঘনীভূত হবে কি?
এই অভিযোগ গুরুতর এবং তার বাস্তবতাও রয়েছে। আমাদের নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন কমে গেছে। অনুসন্ধানের অভাবে মজুদও বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ভোলার গ্যাস অব্যবহৃত। দেশের গ্যাস সম্পদ এমন অবস্থার শিকার হতো না, যদি রপ্তানি হতো। তখন বিদেশী বিনিয়োগকারীদের পরামর্শক ও প্রতিনিধিরা গ্যাস রপ্তানির পক্ষে যুক্তিতে বলেছে, ‘দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে’। পরে গ্যাস রপ্তানির সুযোগ না থাকায় অনুসন্ধান ও উৎপাদনে ভাটা পড়ে। গ্যাস সংকট বাড়ে। সে সংকট মোকাবেলার অজুহাতে তেল-গ্যাস আমদানি বাড়ানো হয়। এখন তেল-গ্যাস আমদানি ব্যবসা ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেলে দেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান আরও ব্যয়বহুল ও গতিহীন হবে। শুধু তাই নয়, উচ্চ মূল্য ও মুনাফায় তেল-গ্যাস-কয়লা আমদানি বাড়বে। নতুন নতুন তেল, গ্যাস, ও কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট হবে। বিদ্যুতের মূল্য আরো বৃদ্ধি হবে এবং বিদ্যুৎ আমদানিও বাড়বে। বিদ্যমান বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার ক্রমাগত কমে আসবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বাজার বিদেশী বিনিয়োগকারীদের হাতে চলে যাবে। বিদ্যমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানী উন্নয়ন নীতি ও কৌশল সে লক্ষ্যেই গৃহীত হয়েছে এবং সে দিকেই বাধাহীনভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় জ্বালানী নিরাপত্তা পৃথিবীর দিগন্ত রেখার মতই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
বেসরকারিকরণ উদ্যোগ বিপিসিকে অকার্যকর করবে কি?
তাতে বিপিসির কার্যকর থাকার বা রাখার কোন সুযোগ থাকেনা। তাদের প্রতি আমাদের অসন্তোষ রয়েছে। তারা সেবামূলক নয় ব্যবসাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অসচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে। এরপরও বিপিসি পাবলিক প্রতিষ্ঠান। ফলে বিপিসি কিছুটা হলেও জনস্বার্থ রক্ষা করার ব্যাপারে দায়বদ্ধ। কিন্তু ব্যবসায়ীদের তা নেই। এলপিজি আমদানি পুরোটাই ব্যক্তি খাতে হয়। সরকারি মালিকানাধীন এলপিজি কোম্পানী এলপিজিসিএল যেমন এলপিজির বাজারে অকার্যকর ও গুরুত্বহীন। বিপিসিও তেমনই অকার্যকর হবে এবং গুরুত্ব হারাবে।
আইএমএফের শর্তে শ্রীলংকায় অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার নজির রয়েছে এবং দেশটি বিপর্যয়ে পড়েছে বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশেও কি একই আশংকা আছে?
শ্রীলংকার পরিণতি দেখে আমরা অবশই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে সম্পদ সৃষ্টি দ্বারা ঋণের অর্থ রিকোভারি করার সক্ষমতা থাকা এবং ঋণে চলমান উন্নয়ন অব্যাহত রাখা- এই দুই বিচেনায় ঋণ গ্রহণে দুরদর্শিতা থাকা চায়। সরকার তাতে দক্ষতা দেখাতে পারেনি। সম্পদ সৃষ্টি মাধ্যমে বিনিয়োগ রিকোভারি করে ক্রমাগত সমৃদ্ধশালী হওয়া এখন অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। এমন পরিস্থিতে অন্যায়, অযৌক্তিক, ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় প্রতিরোধে অক্ষমতা এবং রিজার্ভ ভেঙ্গে ও গৃহীত ঋণে অর্থ যোগান অব্যাহত রাখা আরও বেশি বিপদজনক।
সৌজন্যে, বিজনেস পোস্ট।