ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: লোকমান মিয়া ঢাকার কমলাপুরে নিম্নআয়ের এলাকায় বসবাসকারী প্রান্তিক আয়ের মানুষ। জীবিকার তাগিদে বরিশাল ছেড়ে ঢাকায় আসেন পরিবার পরিজন নিয়ে। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান সদস্য সংখ্যা সাতজন। তিনিই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য।
আয়ের উৎস ফেরি করে কিছু আচার ও খাবার বিক্রি। আর তা দিয়ে সংসার চালাতে হয়। আগে সারাদিনে তার লাভ হতো চারশ থেকে পাঁচশ টাকা। এখন একই কাজ করে দিনে সাতশ থেকে আটশ টাকা আয় করেন। আয় বাড়লেও সংসার চালাতে প্রতি মাসেই ধার করতে হয় লোকমানকে।
ঢাকায় তার প্রতি মাসে খরচ হয় ছয় থেকে সাত হাজার টাকা। গ্রামে এনজিওর ঋণের কিস্তি পরিশোধ, বাবার চিকিৎসা, দুই শিশুর খরচসহ প্রতি মাসে পরিবারের জন্য তার বারো থেকে পনেরো হাজার টাকা খরচ হয়। বর্তমানে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে লোকমানের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ পড়েছে মাংস। মাছ খান দুই সপ্তাহে একবার। বেশিরভাগ দিন রাতের খাবার শুধু ডাল-ভাত দিয়েই সারতে বাধ্য হচ্ছেন।
কয়েকদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে শিরোনামে ছিল ‘খাদ্যের দাম বাড়ায় টিকে থাকতে তিন উপায়’। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫৩ শতাংশ মানুষ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে গিয়ে জীবনযাপন ও খাদ্য বাবদ খরচ কমিয়েছে, তারা টিকে থাকতে তিনটি উপায় বেছে নিয়েছে।
এর মধ্যে ২৮ শতাংশ পরিবার বাকিতে খাবার কিনছে। ৫৩ শতাংশ ঋণ করছে, ১৫ শতাংশ তাদের সঞ্চয় বা জমানো টাকা ভেঙে প্রতিদিনের খরচের জোগান দিচ্ছে। বাকি ৪ শতাংশ পরিবার জমি বিক্রি করছে বা অন্যত্র চলে গিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। সার্বিকভাবে মাত্র ১৩ শতাংশ পরিবার সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পাচ্ছে।
জরিপে দেখা গেছে, একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যতটা খাবার দরকার, তার দাম এক বছরে ১২ শতাংশ বেড়েছে….
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ২০২২ এর জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের নিম্নআয়ের মানুষের আয়-ব্যয় নিয়ে জরিপ করেছে। এতে তাদের খাদ্যপণ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবা বাবদ খরচের তথ্য উঠে এসেছে। তাতে দেখা গেছে, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে চাল ও আটার দাম কমেছে। তবে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বাবদ খরচ বেড়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে।
তবে এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপদে আছে দেশের অর্ধেকের (৫৩ শতাংশ) বেশি মানুষ। খাবারের দাম বাড়ায় তারা তাদের জীবনযাত্রার অন্যান্য খরচ কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।
জরিপে দেখা গেছে, একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যতটা খাবার দরকার, তার দাম এক বছরে ১২ শতাংশ বেড়েছে। আর ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে, অর্থাৎ এক মাসে বেড়েছে ৪ শতাংশ।
বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবার কেনা বাবদ মাসে মাথাপিছু খরচ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৩৯ টাকা, যা উপার্জন করা সাধারণের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্য ৬৮ শতাংশ মানুষের জন্য গভীর দুশ্চিন্তার বিষয়। খাদ্যপণ্যের মধ্যে চালের দাম এক বছরে বেড়েছে ১১ শতাংশ। আর কোভিড সংক্রমণের আগের সময় অর্থাৎ ২০২০ এর মার্চের আগের তুলনায় বেড়েছে ৬১ শতাংশ।
লোকমান মিয়ার হিসাবটি দেখা যাক, বিগত বছরের চেয়ে আয় বাড়লেও কোনো লাভ হয়নি। যে টাকা আয় হয়, তা দিয়ে নিজের ও সংসারে খরচ সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। খাদ্যপণ্য, অন্যান্য সেবা সার্ভিসের খরচ প্রতিনিয়তই পাল্লা দিয়েই বাড়ছে।
বড় বাচ্চার স্কুলে দেওয়ার কথা চিন্তা করেও খরচের চিন্তা করে এই বছর দেননি। খরচ মেটাতে কয়েক মাস পরপরই চড়া সুদে টাকা ধার করতে হয়। সেই ধার শোধ করার জন্যও আবার অন্য কোথাও থেকে ধার নিতে হয়।
রোজার মাস আসছে সামনে। জিনিসপত্রের দাম কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এখন ভাত-আলু আর সবজির দুইটা পাতা দিয়ে রান্না করে কোনোমতে চলে। শেষ কবে মাছ-মাংস খেয়েছেন, ভুলে গেছেন। সারা বছর হয়তো একপেটা-আধাপেটা খেয়ে থাকা যায়, কিন্তু রোজার মাসে তো মানুষ একটু-আধটু ভালো খেতে চায়। অথচ গরিবের জন্য রোজার মাসেও কোনো উন্নতি নেই।
আমাদের যত কষ্ট, একবেলা খাবার জোগাড় করতে জীবন শেষ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে দেখি সরকারি ট্রাকে চাল-ডাল বিক্রি হয় কম দামে। তবে এত লম্বা লাইন পড়ে যে, পাঁচ কেজি চাল কিনতে গেলে পুরো দিনই কাজ বন্ধ রাখতে হয়।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে ব্যবসা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়ায় কর্মসংস্থান বাড়েনি। অনেক স্থানে কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে। অনেকের বেতন-ভাতা অনিয়মিত ও কমেছে। করোনার পর থেকে প্রায় ৩ বছরে বেতন বাড়েনি।
অনেকেই আগের বেতনেই কাজ করছেন। ওই সময়ে পণ্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি বাদ দিলে প্রায় সবারই আয় কমেছে। এর মধ্যে খণ্ডকালীন ও মৌসুমি কাজের মানুষের আয় কমেছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় ধরে রাখা যায়নি।
সবাই স্বীকার করছেন এক বছরের ব্যবধানে নিত্যপণ্য ও সেবার দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে পাল্টা যুক্তি ছিল বৈশ্বিক সংকট ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। কিন্তু এর ফলে প্রান্তিক ও সীমিত আয়ের মানুষের আয় না বাড়ার কথা বারবার বলা হলেও বিষয়টি আমলে নেওয়া হচ্ছে না।
খরচের পাল্লা দিন দিন ভারী হওয়ার কারণে মানুষ প্রথম দিকে সঞ্চিত আমানত ভেঙেছে। পরে ধার-দেনা করেছে। শেষমেশ বাধ্য হয়ে খাবার উপকরণ কেনা কমাতে বাধ্য হচ্ছে। একই সঙ্গে কমাতে হচ্ছে বাসাভাড়া, ভ্রমণ, শিক্ষা, বিনোদনসহ অন্যান্য খাতের খরচ।
খাবারের পাশাপাশি অত্যাবশ্যকীয় সেবার দাম বেড়েছে লাগামহীন। এর মধ্যে বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বেড়েছে। গ্যাসের দামও দফায় দফায় বাড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অন্য সব পণ্য ও সেবার দামও বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গণপরিবহনের ভাড়া প্রায় শতভাগ। এসব মিলে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে লাগামহীন।
খরচের পাল্লা দিন দিন ভারী হওয়ার কারণে মানুষ প্রথম দিকে সঞ্চিত আমানত ভেঙেছে। পরে ধারদেনা করেছে। শেষমেশ বাধ্য হয়ে খাবার উপকরণ কেনা কমাতে বাধ্য হচ্ছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আয় ও ব্যয়ের মধ্য সমন্বয় করতে মানুষ প্রথমে দৃশ্যত অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন সব খরচ কমিয়েছে। এতেও পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় খাবারে হাত দিতে বাধ্য হয়েছে। আর এর ফলে খাবারে খরচ কমানোর কারণে বাড়ছে পুষ্টিহীনতা। এর প্রভাবে মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, তেমনি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। যা সামগ্রিক উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের খরচ কমিয়েও এখন সংসারের হাল ধরে রাখা যাচ্ছে না। জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার তাগিদে অনেকে প্রথমদিকে অল্প টাকায় বাসাভাড়া করলেও এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে আশ্রয় নিচ্ছে। অনেকে আবার পরিবার-পরিজন গ্রামে পাঠিয়ে নিজে শহরে থাকছে।
সোজা কথায়, খাদ্য-পণ্য ও সেবার এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বেসামাল দামে মধ্যবিত্তসহ সীমিত আয়ের মানুষ অসহায়। মানুষ আয় দিয়ে পরিবারের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। অনেকেই ব্যয় সামলাতে খাবার কেনার বাজেট কাটছাঁট করছে।
সরকারের চোখ ধাঁধানো বড় বড় প্রকল্পের দিকে নজর না দিয়ে সরকারের উচিত দেশের মধ্যবিত্তসহ সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা নির্বাহের দিকে মনোযোগ দেওয়া। এজন্য তাদের কর্মসংস্থান বাড়ানোর পাশাপাশি নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখার ওপর বেশি পদক্ষেপ নেওয়া।
টিসিবি ও খাদ্য বিভাগের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্য-পণ্য বিক্রিসহ মধ্যবিত্তদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
এস এম নাজের হোসাইন, ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
সৌজন্যে, ঢাকা পোস্ট।