ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে- এটি কেউ অস্বীকার করবে না। আয়ের সঙ্গে ক্রয়ের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। তবে একজন শ্রমিক সারাদিনে যে মজুরি পান, তা দিয়ে তিনি তাঁর প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদার কতটুকু পূরণ করতে সক্ষম হন, তা ভাবার বিষয়। পরিবারের খাদ্য চাহিদা পূরণের পর তাঁর কাছে বাকি কী থাকে?
একসময় বলা হতো, শ্রমিকের মজুরির ৬৬ শতাংশই খাদ্য সংগ্রহে ব্যয় হয়ে যায়। বিশ্বাস করি, এখন নতুন কোন সমীক্ষা পরিচালিত হলে এই শতাংশের হার আরও বাড়বে। তারপরও যদি ধরে নেওয়া হয়, এখনও ৬৬ শতাংশই খাদ্যের পেছনে খরচ হয়। তবে প্রশ্ন করা যায়, বাকি ৩৪ শতাংশ অর্থ দিয়ে মৌলিক চাহিদার কত শতাংশ পূরণ করা সম্ভব? তাই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে বলে আস্ম্ফালন করার পরিবেশ এখনও দেশে সৃষ্টি হয়নি।
দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ কার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তাও যেন সাধারণ মানুষ এখন জানে না! ওদিকে দায়িত্বপ্রাপ্তরা শুধু নিজেদের মতো করে বাণী দিয়ে যান- দেশে পণ্যের কোন সংকট নেই; প্রয়োজনীয় মজুত আছে। বাজারমূল্যের চেয়ে ১০-২০ টাকা বেশি নির্ধারণ করে ব্যবসায়ীদের ধমক দেওয়া হয়- এর চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরদিন সকালেই ওই পণ্য এই ১০-২০ টাকার সঙ্গে আরও ১০-২০ টাকা যোগ করে বিক্রি হতে দেখা যায়। কয়েক দিন পর আবার নতুন করে ধমক শোনা যায় এবং নতুন করে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। তাই সাধারণ মানুষ ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে পণ্যমূল্যের সংগতি খুঁজে পায় না।
আমাদের একজন শিক্ষক গড় আয় বোঝাতে বলতেন- ‘মইনুল ইসলাম দিনে এক লাখ টাকা আয় করেন; আর আমি দিনে ১ টাকা আয় করি। তাহলে আমাদের গড় আয় ৫০ হাজার ৫০ পয়সা প্রতিদিন। এতে মইনুল ইসলামের কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু আমি প্রচণ্ড খুশি যে, আমার একদিনের আয় ৫০ হাজার টাকার বেশি।’ দেশের মানুষের গড় আয়ের হিসাব দেখে এই শিক্ষককে সব সময় স্মরণ করি।
সাধারণ মানুষ হয়তো অর্থনীতির অ-আ-ক-খ জানে না। কিন্তু তারা তো বিসিএসকে প্রথম পছন্দকারী মেধাবী সন্তান। তাই এই বাণীর একটি বিশেষ লক্ষ্য, উদ্দেশ্য থাকা স্বাভাবিক। সেটি হলো, সমবেত উপস্থিতির সবাই যেন নিজ নিজ অর্থনীতি কানাডার মতো করে। ব্যক্তি যদি নিজের উন্নতি করে, তবে একেক করে সবার অর্থাৎ দেশের উন্নতি হয়ে যাবে। উন্নত দেশের কাতারে শামিল হয়ে যাবে। তবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী যাতে উন্নত দেশের কাতারে যাওয়ার দৌড়ের অংশ হতে পারে, সে লক্ষ্যে তাদের জন্য মাসিক ৫০০ টাকার সামাজিক নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করে দেওয়া হয়েছে।
অনেকে বলেন, ইউরোপ-আমেরিকার তুলনায় বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য কম। বাস্তবে বাংলাদেশের এক টাকার তুলনায় ডলার, পাউন্ড, দিনার, রিঙ্গিত ইত্যাদির মূল্য অনেক বেশি। মার্কিন ১ ডলার সমান বর্তমানে ১০০ টাকা হলেও মার্কিনিদের কাছে তাদের দেশের এক ডলার মানে ১ টাকা। অনুরূপ অন্যান্য দেশেও তা-ই। এ ক্ষেত্রে একজন বাংলাদেশি যদি অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করেন এবং বাজারে পণ্য কিনতে গিয়ে যদি ডলারের সঙ্গে বাংলাদেশি মুদ্রার বিনিময় হার হিসাব করেন, তাহলে তাঁর মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। এক কেজি বেগুন ৮ ডলার, এক কেজি মাংস ১০ ডলার, একবার বাসে বা ট্রেনে উঠলে ৪ ডলার দিতে হয়। ওই ব্যক্তি তা যদি বাংলাদেশি টাকায় হিসাব করেন তাহলে তাঁকে খালি হাতে ফিরে পানি খেয়েই জীবন ধারণ করতে হবে। একই অবস্থা হবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, কুয়েত, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে বসবাসরতদের জন্য। মুক্তির একমাত্র পথ বসবাসরত দেশের মুদ্রাকে ইউনিট হিসেবে বিবেচনা করা।
আমাদের ক্ষমতাবান অনেকের পরিবার বিদেশে বসবাস করে। সন্তানরা পড়াশোনা ও স্থায়ীভাবে নাগরিকত্ব গ্রহণ করে সেখানেই অবস্থান করছে। ধারণা করা যায়, দেশের টাকা বিদেশে ব্যয় করার সময় হিসাবের খাতায় মূল্যমানের পার্থক্য দেখেই দেশের বাজারের ঊর্ধমুখী প্রবণতা বুঝতে পারেন না। কারণ আমাদের দেশের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের এক মাসের অর্থে অস্ট্রেলিয়ায় এক কেজি বেগুন কেনা সম্ভব।
কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ব্যক্তি পোস্ট দিয়েছেন- ‘২০ টাকার চাল খাচ্ছি ৭০ টাকায়, ৭০ টাকার সয়াবিন খাচ্ছি ২০০ টাকায়, ২০০ টাকার গরুর মাংস খাচ্ছি ৬০০ টাকায়, ৯০ টাকার ব্রয়লার খাচ্ছি ২০০ টাকায়, ৪ টাকার গাড়ি ভাড়া দিচ্ছি ৩০ টাকা, ৪ টাকা ইউনিটের বিদ্যুৎ চালাচ্ছি ১০ টাকায়, ৩ টাকার ইউরিয়া সার কিনছি ৪০-৫০ টাকায়, ৮০ টাকার পাঙাশ খাচ্ছি ১৫০ টাকায়, ১০০ টাকার মাছ খাচ্ছি ৩০০ টাকায়, ২০০ টাকার মাছ খাচ্ছি ৫০০ টাকায়।’
এই পোস্টের অতীত মূল্যের সঙ্গে অনেকে আজ একমত নাও হতে পারেন। তবে বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে সহমত প্রকাশ অবশ্যই করবেন। এসবের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সাধারণ জনগণ একটা না একটা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সংক্রান্ত নাটক দেখে থাকে। যেমন গত বছর পেঁয়াজের নাটক হলো। জোটবদ্ধভাবে সবাই বাণী প্রচারে নিবেদিত হয়ে পড়ল- ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে আছে। পণ্যের কোন সংকট নেই। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’
বর্তমান সময়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় পড়ে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের যে জীবন সংগ্রাম চলছে, তা বোঝার নূ্যনতম মানসিক অবস্থায় জনপ্রতিনিধিরা আছেন বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। চারদিকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির জয়জয়কার। দুর্বল লাঞ্ছিত হবে, হতে থাকবে; আর আমরা উন্নতি করতেই থাকব। নিতান্ত অল্প কিছু মানুষের উন্নতি বাকি মানুষদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের চরম দুর্দশার প্রেতাত্মারা আজ ভীষণভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। জীবিতদের নির্জীব করে রাখার উপায় হিসেবে চলছে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতা।
লেখক: সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)।
সৌজন্যে: সমকাল।