রাজন ভট্টাচার্য: বাজারে তো নিত্যপণ্যের কোনো ঘাটতি নেই। দোকানে পর্যাপ্ত চাল আছে। সারি সারি সাজানো সয়াবিন তেলের বোতল। ভ্যানভর্তি পেঁয়াজ। বস্তায় বস্তায় চাল, রসুন, ছোলা, ডাল, চিনি, আদা, ময়দা রয়েছে দোকানে, আড়তে। বাজারে সবজির কমতি দেখা যায় না। বরং শীত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন মৌসুমের সবজি বাজার দখল করতে শুরু করেছে। তা হলে নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন কেন?
এ প্রশ্ন দেশের বেশিরভাগ মানুষের। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্যে। তাই দাম বাড়ছে। এ কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে আমদানিনির্ভর পণ্যের ক্ষেত্রে দাম বাড়তে পারে। যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হচ্ছে সেগুলোর দাম বাড়তি কেন? আরেকটি বড় কথা হলো সরকারের অনেক মন্ত্রী বলছেন, যুদ্ধের কারণে বিশ^বাজারে বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। আমাদের দেশে যেসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে হইচই হচ্ছে অন্যান্য দেশের চিত্র কি একই? আসলে তা নয়। দু-একটি ক্ষেত্রে দাম বাড়ার বিষয়টি মিলতে পারে। সব ক্ষেত্রে মিলে যাওয়ার সুযোগ নেই।
গেল বর্ষায় দেশের কোনো অঞ্চলেই ফসলের তেমন একটা ক্ষতি হয়নি। শীতে বাজারে সবজি ছিল ভরপুর। কিন্তু দাম হাতের নাগালে আসেনি। বাড়তি দামের কারণে এবার মৌসুমেও মানুষ চাহিদামতো শাকসবজি কিনে খেতে পারেননি। নতুন সবজি ঢেঁড়স, করলা, পটোল, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা বাজারে এসেছে। সরবরাহ কম। তাই হয়তো দাম বেশি। তবে যতটুকু বেশি তা অনেক বেশি। মাত্রা ছাড়া দাম।
সম্প্রতি আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। গেল ইরি-বোরোও উৎপাদন ছিল বেশ। ২০১৮ সালে হাওরডুবির পর থেকে ধান উৎপাদনে আর কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি। তবে কেন চালের দাম নিয়ে বছরজুড়ে হইচই? চালের বাজার কোনো অবস্থাতেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। সরকার এ ব্যাপারে ব্যর্থ হয়েছে।
আড়তদাররা ইতোমধ্যে বলেছেন, আগামী ইরি-বোরো মৌসুম না ওঠা পর্যন্ত চালের বাজার অস্থির থাকবে। ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার খবরে বেড়েছে সরিষার তেলের দামও। প্রতি কেজিতে বেড়েছে ১০০ টাকা! মাছের উৎপাদন বাড়লেও বাজারে মাছ কেনা একেবারেই দুষ্কর। ডিম, মুরগির মাংসসহ ২৪ ধরনের পণ্যের দাম মধ্যবিত্তের হাতের নাগালের বাইরে যাচ্ছে। এগুলো তো আমদানিনির্ভর নয়।
কম ব্যবহার করা পণ্যের বাজারও অস্থির। সবার অজান্তেই দাম বাড়ছে সাবান, তেল, প্রসাধনী সামগ্রী, পেন্সিল ব্যাটারি, ব্রাশ, নুডলস, পেস্ট, ওষুুধসহ অনেক কিছুরই।
মিনিকেট আর নাজির নামের চালে পুরো বাজার দখল। শহরাঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ এখন এই চালের নামের সঙ্গে পরিচিত। কমবেশি সবাইকেই এই চালের ভাত খেতে হচ্ছে। কিন্তু এই নামে তো দেশে কোনো ধান নেই, এই নামে কোনো চালও আমদানি হয় না! তবে চাল কোথা থেকে এলো? কারা এ চাল আবিষ্কার করল? তারা তো দেশের বাইরের কেউ নয়। তবে কেন তাদের চিহ্নিত করা যাবে না? কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশের ধানের মাঠ আর বাজার সয়লাব থাকে ব্রি ধানে, কিন্তু বাজারে ব্রি চাল নামে কোনো চালের অস্তিত্বই নেই!
আবার দেশে এখন বিপুল পরিমাণ হাইব্রিড ধান উৎপাদিত হলেও বাজারে হাইব্রিড ধানের চাল বা হাইব্রিড চাল বলে কিছু পাওয়া যায় না। ব্রি ২৮ ধানকেই মিলগুলো নিজেদের ইচ্ছেমতো কেটে, মিক্স ও ওভারপলিশ করে নানা নামে বাজারে আনছে। ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করে বিক্রি করা হচ্ছে। অথচ সরকার তাদের কিছুই করতে পারছে না। এই সামান্য প্রতারণা যদি বন্ধ করা না যায় তা হলে সার্বিক বাজার পরিস্থিতি কি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব?
পেঁয়াজের ক্ষেত্রে দেখা গেছে পদক্ষেপ নেওয়ার চার দিনের মধ্যে দাম কমেছে অর্ধেক। হয়তো আরও কমবে। তা হলে আমদানিনির্ভর ছাড়া দেশে উৎপাদিত অন্যান্য পণ্য কেন বাড়ছে? মূল সমস্যা হলো বাজার সিন্ডিকেট ও তদারকির পর্যাপ্ত অভাব। রাজনৈতিক কারণে বাজার সিন্ডিকেটচক্র প্রভাবশালী হয়। একটি পণ্যের মূল্য বাড়াতে থাকে। এ নিয়ে হইচই শুরু হয়। তার পর পদক্ষেপ। এর মধ্যে কেটে যায় প্রায় এক মাস। তার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
কিন্তু এক মাস তো নিত্যপণ্য না কিনে চলার সুযোগ থাকে না। যারা সিন্ডিকেট করে এই অপরাধ করল তাদের চিহ্নিত করার রেওয়াজ নেই। যদি তাদের চিহ্নিত করে বাড়তি মুনাফার টাকা আদায় করে সাজা দেওয়া সম্ভব হতো তা হলে হয়তো ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ কমে আসত। এর সঙ্গে অপরাধীদের ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল এমনকি কালোতালিকাভুক্ত করা যেতে পারে। যেন তারা দেশের বাইরেও আর ব্যবসা করতে না পারে।
পণ্যের বাজার নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তদারকি কম এটা একেবারেই স্পষ্ট। তা হলে প্রতি সপ্তাহে যেসব পণ্যের দাম বাড়ছে তা সরকারি পর্যায় থেকেই প্রকাশ করার কথা ছিল। এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও। তা দেখা যায় না। এ রকম কোনো পদ্ধতিই দেশে নেই। কেন থাকবে না। থাকা উচিত ছিল।
নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের পেছনে পরিবহন ব্যয় আরেকটি বড় কারণ। এর সঙ্গে যোগ হয় পথে পথে চাঁদাবাজি। এসব তো বন্ধ করতে এলসি খোলার দরকার হয় না। সদিচ্ছাই সমাধানের পথ তৈরি করতে পারে। পথে কেন চাঁদাবাজি হবে? কারা চাঁদাবাজি করে? এ তো কারও অজানা থাকার কথা নয়। তা হলে তাদের কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। জনস্বার্থের কথা মাথায় রেখে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। দিতে হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
সবচেয়ে বড় কথা হলো কোভিডের কারণে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ বেকার হয়েছে। তাদের অনেকে চাকরি পায়নি এখনো। অনেকে পেলেও বেতন আগের চেয়ে কম। নিয়ন্ত্রণহীন বাসা ভাড়ার মধ্যে সব পণ্যের দাম বাড়লে চলতে কষ্ট হয়। তাই টিসিবির লাইনে যুক্ত হয়েছেন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন। ধারাবাহিক এই কষ্ট যদি মৌলিক চাহিদা পূরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হবে পুষ্টিহীন। বাড়বে রোগব্যাধি। তাই এসব বিষয় মাথায় রেখেই রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের আরও কঠোর ভূমিকা জরুরি।
রাজন ভট্টাচার্য : সাংবাদিক