বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং ভারতে তেল পাচারের শঙ্কা থেকে ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। গত ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে কেরোসিন ও ডিজেলের দাম ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা লিটার নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। অথচ ১ নভেম্বর থেকে ভারত ডিজেল ও পেট্রোলের দাম কমিয়েছে। এখন সড়ক পরিবহনে পণ্য ও যাত্রী ভাড়া বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছেন পরিবহন মালিকরা। এই দাবিতে পূর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে ধর্মঘট শুরু হয়েছে।
গণপরিবহন বন্ধে ভাড়া বেড়েছে তিনগুণ, ভোগান্তি চরমে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ডাকা পরিবহন ধর্মঘটের কারণে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ। রিকশা কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করলেও দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া গুণতে হচ্ছে তাদের। মাঝে-মধ্যে দু’একটি দোতলা বিআরটিসি বাস চলাচল করলেও তাতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। বাদুড়ঝোলার মতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছে মানুষ। রাজধানীর প্রতিটি মোড়ে শতশত মানুষকে দীর্ঘক্ষণ যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। আবার অনেকে দীর্ঘপথ হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশে রওয়ানা হচ্ছেন।
ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভাড়া বৃদ্ধির দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে লঞ্চ চালাবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন সাধারণ লঞ্চমালিকেরা। শনিবার দুপুরে রাজধানীর সদরঘাটে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল সংস্থার কার্যালয়ে সাধারণ লঞ্চমালিকদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে মালিকেরা লঞ্চ না চালানোর অনানুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন।
এদিকে সারাদেশে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় বিপাকে পড়েছেন হাজারও যাত্রী। হঠাৎ লঞ্চ বন্ধের ঘোষণা জানা না থাকায় ঘাটে এসে ফিরে যেতে হচ্ছে তাদের। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর দুই দিন লঞ্চ চললেও শনিবার দুপুরে ধর্মঘটের ডাক দেয় লঞ্চ মালিক সমিতি।
গত শুক্র এবং শনিবার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি চাকরির পরীক্ষাও ছিল শুক্র ও শনিবার। লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থীরা চলমান পরিবহন ধর্মঘটের কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে।
এদিকে বেশ কিছুদিন ধরেই সবজির বাজারে শুরু হয়েছে অস্থিরতা। শুধু সবজির বাজারেই নয়, দাম বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যেরও। বাজারে বেশিরভাগ সবজির দাম কেজিতে ২০ থেকে ৪০ টাকা দাম বেড়েছে। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়াতে বিপাকে পড়েছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের সংসার চালাতে নাভিশ্বাস অবস্থা। বর্তমানে বাজারে আগুন লেগেছে। কোনো কিছুর দামই সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নেই। মাছ মাংস না খেয়ে শুধু সবজি কিনে খাবে, তারও কোনো উপায় নেই। তবে যত দিন যাচ্ছে বাজারে ততই শীতকালীন সবজির সরবরাহ বাড়ছে। সরবরাহ বাড়লেও সেভাবে কোনো সবজিরই দাম না কমায় বিপাকে পড়েছেন ক্রেতারা।
এ ছাড়া হঠাৎ করেই ভোজ্যতেল, চিনি এবং চালের অত্যাধিক মূল্যবৃদ্ধি করে ক্রেতাসাধারণকে চাপে ফেলেছে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। প্রায়ই তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশি ব্যবহার্য পণ্যকে টার্গেট করে, যাতে এসব পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে সহজেই ক্রেতাদের কাছ থেকে অধিক মুনাফা আদায় করা যায়। দেখা যায় যে, বাজারে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের সংকট না থাকলেও ওই সিন্ডিকেটটি অনৈতিকভাবে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে জনগণের পকেট থেকে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের এমন অপতৎপরতা রাষ্ট্রকে জিম্মি করার শামিল।
প্রশ্ন উঠেছে, ডিজেলের বাড়তি দামের কারণে ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে চলা ধর্মঘটের মধ্যে দুই প্রধান শহরে সিএনজিচালিত বাস বন্ধ কেন? এসি বাস এবং পণ্য পরিবহনকারী ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিকেরাই-বা কেন ধর্মঘটে অংশ নিয়েছেন? এমন অবস্থায় সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পরিবহন মালিকেরা ভাড়া বাড়াতে মানুষকে জিম্মি করেছেন। সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
শ্রম আইন অনুসারে, পরিবহন মালিকেরা ব্যবসা বন্ধ করে দিতে পারেন, ধর্মঘট ডাকতে পারেন না। আর শ্রমিকেরা ধর্মঘট ডাকলে অন্তত ১৫ দিন আগে সময় বেঁধে (আলটিমেটাম) দেওয়ার নিয়ম। এ ক্ষেত্রে কোনোটাই হয়নি। আইনের বাধ্যবাধকতা কৌশলে এড়িয়েছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। তারা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিয়ে ধর্মঘট পালন করছে। ২০১৬ সালে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছিল। সেবার সরকার ভাড়া কমালেও পরিবহন মালিকেরা তা মানেননি। অর্থাৎ পরিবহন মালিকেরা শুধু তাদের সুবিধা আদায়ে যাত্রীদের জিম্মি করেন। পরিবহন সমিতিগুলোর শীর্ষ পদে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা রয়েছেন। বিআরটিএর কর্মকর্তারা এসব নেতার সামনে অনেকটাই অসহায়।
রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিএনজিচালিত বড় বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা। মিনিবাসের ক্ষেত্রে তা ১ টাকা ৬০ পয়সা। দূরপাল্লার বাসে ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৪৫ পয়সা। সর্বশেষ ২০১৩ সালে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর দূরপাল্লার বাসে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া ১০ পয়সা বাড়ানো হয়েছিল। বাস মালিকেরা ২০১৬ সাল থেকেই ভাড়া বাড়ানোর জন্য দেনদরবার করে আসছিলেন। জ্বালানি তেলের দাম না বাড়লেও তাদের যুক্তি ছিল, যন্ত্রাংশ ও ইঞ্জিন অয়েলের দাম বেড়েছে। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পরিবহন মালিকদের ভাড়া বাড়ানোর দাবিকে আড়ালে ফেলে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- এবার শুধু ডিজেলের বাড়তি দাম নয়, মালিকেরা চান অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ভাড়া অনেকটা বাড়ানো হোক। এ জন্যই তারা চাপ তৈরির কৌশল নিয়েছেন।
দায়িত্বশীলদের অতিকথন আর সমন্বয়হীনতা মূল সর্বনাশটা করছে। আপনাদের কথাই মেনে নিলাম- সবকিছু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছেন। তাহলে আপনাদের কারো তো কোনো কাজ নেই। এবার দয়া করে মুখটা বন্ধ রাখেন। ভুল তত্ত্ব দিয়ে জনগণের সামনে আর হাজির হবেন না। এদেশে সবই ঊর্ধ্বমুখী, শুধু কমেছে মানুষের দাম!
বাণী ইয়াসমিন হাসি
লেখক : সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট
সৌজন্যেঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন