ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: সরকারি ভাবে বাড়ানোর আগেই ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিচ্ছেন বিভিন্ন পণ্যের দাম। আবার সরকার কিছুটা কমালেও দীর্ঘ সময়ে বাজারে প্রভাব পড়ছে না। কেন এমনটি হয়? কিভাবে ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণ করা সম্ভব?
এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন ভোক্তা অধিকার সংরণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।
ডয়চে ভেলে : ভোক্তা অধিকার আইনে কী আছে?
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান : এই আইনটি ২০০৯ সালে সংসদে পাশ হয়েছে। এই আইনে ভোক্তার অধিকারের তিনটি বিষয় ফোকাস করা আছে। একটি হলো, ভোক্তার যে অধিকার সেই বিষয়ে তাদের সচেতন করা। দ্বিতীয়টি হলো, ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফার কারণে ভোক্তারা যে প্রতারিত হচ্ছেন, সে ব্যাপারে বাজার মনিটরিং। এবং তৃতীয়টি হলো, ভোক্তা যদি প্রতারিত হন, তাহলে এর প্রতিকারে কী ব্যবস্থা। এই আইনে ভোক্তা আমাদের কাছে অভিযোগ করতে পারেন। সেই অভিযোগের আমরা নিষ্পত্তি করতে পারি।
এই আইনে কি ভোক্তাদের স্বার্থ পুরোপুরি এসেছে?
এটি আসলে একটি আপেক্ষিক বিষয়। আমাদের দেশে সচেতনতার যে রেট সেটা যদি দেখেন, তাহলে দেখবেন, আমরা সেভাবে সচেতন হইনি। আমি একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই, সাম্প্রতিককালে ই-কমার্স নিয়ে আমাদের যেটা হয়েছে, সেখানে তারা ৫০ ভাগ ছাড় দিচ্ছিল বা অনেক কম দামে পণ্য দিচ্ছিল, সেই অফারে লাখ লাখ যুবক বিনিয়োগ করেছে। এটা তো স্বাভাবিক ছিল, এত ছাড় বা এই আগ্রাসী মার্কেটিং একটা সময় বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা যদি সচেতন থাকতাম, তাহলে ই-কমার্সের এভাবে ধ্বস নামতো না। আসলে আমাদের সচেতনতার লেভেলটা ওই জায়গায় নেই।
ভোক্তার অধিকার নিয়ে জনগণকে সচেতন করতে আপনারা কী ধরনের পদক্ষেপ নেন?
আমি এখানে অল্পদিন এসেছি। কিন্তু আগে থেকেই যেটা করা হচ্ছে৷ ভোক্তাকে সচেতন করতে লিফলেট বিতরণ, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করা হতো। ১৫ মার্চ জাতীয় ভোক্তা দিবস। এই দিবসটি আড়ম্বরপূর্ণভাবে উৎযাপন করা হয়। মিডিয়াতে প্রচারণা চালানো হয়, যাতে মানুষ জানতে পারে। আমি টার্গেট গ্রুপ নিয়ে কাজ করছি। ইতিমধ্যে রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, গণবিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩-৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠান করেছি। প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানে ৭ থেকে ৮শ’ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমেও প্রচারণা চালাচ্ছি। আমাদের কাজগুলো আমরা ডিজিটাল নির্ভর করেছি, যাতে মানুষ জানতে পারে। আমাদের অভিযানগুলো এখন মিডিয়া নিউজের স্বার্থেই কাভার করছে। এতে ভোক্তা সচেতন হচ্ছেন। অভিযান মিডিয়ায় দেখে ভোক্তা কিন্তু দোকানে গিয়ে চ্যালেঞ্জ করছে।
বর্তমানে ব্যবসায়ীরা যেভাবে প্রতারণা করছেন, সেক্ষেত্রে আইনের কী সংশোধনী প্রয়োজন?
প্রতারণার ধরন কিন্তু এখন বদলে গেছে। ২০০৯ সালে যখন আইন করা হয়, তখন কিন্তু ডিজিটাল বিষয়টা ছিল না। আমাদের আইনের সংশোধনী এখন শেষ পর্যায়ে আছে। সেখানে আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে ফোকাস করে।
ভোক্তাদের কাছ থেকে আপনারা কী পরিমাণ অভিযোগ পান?
আমরা যত বেশি অভিযান করছি, ফোকাস হচ্ছি, তখন বেশি অভিযোগ বাড়ছে। গত কিছুদিন আগে মহিউদ্দিন রনি নামে একজন ছাত্র সহজের মাধ্যমে রেলের টিকিট কাটতে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। তিনি আমাদের কাছে অভিযোগ করার পর গত ২০ জুলাই আমরা শুনানি করে সহজকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করেছি অবহেলার দায়ে। এরপর গত ৪-৫ দিনে আমাদের কাছে ৮০০ অভিযোগ জমা পড়েছে। সেক্ষেত্রে আমাদেরও একটা চ্যালেঞ্জ আছে। জনবল কম এটা বলবো না, কিন্তু ২১৭ জন মানুষ দিয়ে আমাকে ৬৪ জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। আমাদের আসলে বহুমুখী কাজ করতে হয়। একদিকে অভিযান চালাতে হয়, অন্যদিকে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি করতে হয়। সব মিলিয়ে অনেক সময় আমাদের চ্যালেঞ্জে পড়তে হচ্ছে।
সবগুলো অভিযোগের কী সুরাহা আপনারা করতে পারছেন?
যত অভিযোগ আছে, পর্যায়ক্রমে এর শুনানি হয়। মেরিট অনুযায়ী কিছু আগে করা হয়। আবার অভিযোগের সঙ্গে প্রমান না থাকলে সেটা শুনানি ছাড়াই নিষ্পত্তি হয়। যেটার মেরিট থাকে, সেখানে শুনানি করে আমরা অর্থদণ্ড দেই। আমাদের এই আইনে একটা সুন্দর বিধান আছে। এখানে যে অর্থদণ্ড করা হয়, অভিযোগকারী এর ২৫ শতাংশ অর্থ পান। এটা করা হয়েছিল, যাতে ভোক্তারা সচেতন হয়ে অভিযোগগুলো করেন। অনেকে মনে করেন, এখানে অভিযোগ করলে সুরাহা হবে না। আবার অনেকে সঠিকভাবে ডকুমেন্ট রাখেন না। তাই আমি ভোক্তাদের বলবো, সঠিক ডকুমেন্ট রাখুন, অভিযোগ করুন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে এর প্রতিকার পাবেন।
ভোক্তাদের কোন ধরনের স্বার্থকে আপনারা বেশি গুরুত্ব দেন?
পণ্যের ক্ষেত্রে আমরা অভিযান চালাই। কিন্তু সেবার ক্ষেত্রেও আমরা কাজ করি। এই যেমন ঈদের সময় বাসের টিকিটের দাম বেশি নেয়। সেখানে আমরা অভিযান চালিয়েছি। সাম্প্রতিককালে আমরা অনলাইনে প্রতারণার অভিযোগই বেশি পাচ্ছি। পাশাপাশি অনেকে অভিযোগ করেন, একটি ইলেকট্রনিক পণ্য কিনেছেন সেটার ওয়ারেন্টি অনুযায়ী পরিবর্তন করে দেওয়ার কথা, সেটা হয়ত দিচ্ছে না। এগুলোর আমরা সুরাহা করি। এখানে একটা সমস্যা আছে। আমাদের তো নিজেদের ল্যাব নেই। ফলে কোনো পণ্যের মান দেখতে হলে আমাদের বিএসটিআইসহ নানা প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করতে হয়। এতেও কিছুটা সময় নষ্ট হয়। এ কারণে আমরা একটা ল্যাব করার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি আমাদের কোনো রিসার্চ সেল নেই। এটা খুবই জরুরি।
ভোজ্য তেলের দাম সরকারিভাবে বাড়ানোর আগেই ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু কমানোর পর কয়েকদিনেও বাজারে এর প্রভাব নেই। এক্ষেত্রে আপনারা কী ভূমিকা রেখেছেন?
এটা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। এটা দুর্ভাগ্যজনক। সরকারিভাবে বৃহস্পতিবার দাম বাড়ানোর পর শুক্র-শনিবারের মধ্যে বাজারে নতুন তেলে সয়লাব হয়ে গেল। এবার লিটারে যে ১৪টাকা কমানো হলো, সেটা ১২-১৩ দিন হয়ে গেল, বাজারে কেবল এটার প্রভাব পড়ছে। যেদিন দাম কমানো হয়েছে, ওই দিনই আমাদের অফিসাররা রিফাইনারিতে গিয়ে দেখেছেন পুরোনো স্টক নেই, নতুন স্টক আসতে শুরু করেছে। দুর্ভাগ্যজনক এটা যে, দাম কমলে তাদের পুরোনো তেল শেষ হয় না। আর বাড়লে পুরোনো তেলের কোনো স্টকই থাকে না। আসলে যারা অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, অতিলোভী, অতি মুনাফার সঙ্গে যুক্ত কতিপয় ব্যবসায়ীর যতদিন নৈতিক পরিবর্তন না আসবে, আমরা মনিটর করে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ হয়ত করতে পারবো, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ সফলতা আসবে না।
সরকার বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী থেকে কি আপনারা পুরোপুরি সহায়তা পান?
আমাদের অভিযানের ব্যাপ্তি তো বেড়েছে। আমরা যখনই অভিযান চালাতে চাচ্ছি, তখনই র্যাব বা পুলিশ কিন্তু আমাদের সাপোর্ট দিচ্ছে। আসলে আমাদের তো ইনফর্মার নেই। নিজস্ব কোনো সোর্স নেই। ফলে আমাদের সেকেন্ডারি সোর্সের উপর নির্ভর করতে হয়। সেক্ষেত্রে আমরা সরকারি যে এজেন্সিগুলো আছে, যেমন, এনএসআই, ডিজিএফআই তাদের কাছ থেকেও সহযোগিতা পেয়ে থাকি। এখন ভোক্তারাও আমাদের অনেক তথ্য দিচ্ছেন। মিডিয়াও আমাদের অনেক সাপোর্ট দিচ্ছে।
সরকার আর কী পদক্ষেপ নিলে আপনারা ভোক্তাদের অধিকার বাস্তবায়ন করতে পারবেন?
এটা আসলে মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। এখানে সিঙ্গেল কোনো বিষয় না। আমরা যেহেতু উন্নত দেশের দিকে যাচ্ছি, সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের পরিবর্তন দরকার। এটা আসলে চর্চা করার বিষয়। আমরা যখন উন্নত হবো, তখন আমাদের অনেক কিছুই উন্নত করতে হবে। তখন আমাদের ভোক্তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা করতে হলে আমাদের জানতে হবে আমাদের অধিকারটা কী? প্রতিকারের ব্যবস্থা কী? সেখানে সবার অংশগ্রহণটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ব্যবসায়ী কমিউনিটির অংশগ্রহণ ছাড়া অধিকারটা প্রতিষ্ঠা হবে না।
খবরঃ ডয়চে ভেলে