ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও খাদ্য সংকট চলছে। বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থার কোনোটিই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। এর মধ্যে আমরা যদি আরও বেশি খাদ্য উৎপাদন করতে চাই তবে আমাদের অবশ্যই সারের সরবরাহ বজায় রাখতে হবে কারণ এটি সরাসরি খাদ্য উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত।
আধুনিক কৃষিতে ফসল উৎপাদন ব্যবস্থার জন্য সার অপরিহার্য। ফসল উৎপাদনকে প্রভাবিত করে নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে সার ফলন বৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার সাফল্য অজৈব সারের উপর নির্ভরশীল। কারণ এসব সার মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশের জন্য দায়ী। যাই হোক ফসল উৎপাদনে সারের অবদান ফসল, ফসলের ঘনত্ব, ঋতু, মাটির বৈশিষ্ট্য এবং ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির উপরও নির্ভর করে।
অন্যদিকে, কৃষি মন্ত্রণালয় সব ধরনের সারের দাম বাড়িয়েছে। প্রতি কেজিতে বিভিন্ন সারের দাম বেড়েছে ১০ টাকা। প্রতি কেজি পাঁচ টাকা। এখন থেকে কৃষককে কৃষিতে বহুল ব্যবহৃত ইউরিয়া সারের দাম দিতে হবে ২৬ টাকা।
২০২২ সালের অগাস্টে ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানো হয় ছয় টাকা। এছাড়াও ডিএপি সার প্রতি কেজি ২১ টাকা, টিএসপি ২৭ টাকা এবং এমওপি সার ২০ টাকা কেজি দরে কিনতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, ডলারের দাম, আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম এবং বিপুল ভর্তুকি বিবেচনায় সরকারের কাছে দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে স্বীকার করেন কৃষিমন্ত্রী।
উল্লেখ্য আন্তর্জাতিক বাজারে তিন বছর ধরে সারের দাম বাড়ছে। কৃষিমন্ত্রী আরও স্বীকার করেছেন যে সার কিনতে কৃষকদের তাদের ঋণ, স্ত্রীর গয়না, গরু এবং সম্পদ বিক্রি করতে হবে। ফলে সারের দাম বাড়লে কিছুটা চাপে পড়বেন তারা। তবে সরকার বীজ, ডিজেল এবং বিদ্যুৎসহ নগদ প্রণোদনার মতো অন্যান্য উপায়ে সহযোগিতা করবে।
এটাও সত্য যে কিছু কৃষক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সার ব্যবহার করে বিশেষ করে ইউরিয়া। এতে জমি ও ফসলের ক্ষতি হয়। সে ক্ষেত্রে পরিমিত পরিমাণ ইউরিয়া সার ব্যবহার করলে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমে আসতে পারে। তবে সারের দাম বাড়ানোর পরও সরকারকে প্রতি বছর মোটা অঙ্কের টাকা এই খাতে ভর্তুকি দিতে হয়।
সারে ২০২১-২২ অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ ২৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি বাবদ প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা লাগবে। সারের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচ এবং অন্যান্য খাতেও। সেই অবস্থায় কৃষিপণ্যের বাজার ও দাম স্থিতিশীল রাখা জরুরি।
বর্তমান সরকার শুধু জনবান্ধবই নয়, কৃষকবান্ধবও। এরই অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে ডায়ামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সারের দাম কমিয়েছে সরকার। সরকার ধীরে ধীরে সারের দাম কমিয়েছে। উল্লেখ্য সরকার ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, ডিএপি ইত্যাদিসহ প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিচ্ছে।
দেশের কৃষকরা ইউরিয়া সার ব্যবহার করার প্রবণতা রাখে যা কিছুটা ব্যয়বহুল। এর পরিবর্তে ডিএপি সার ব্যবহার করা হলে একইসঙ্গে জমিতে ইউরিয়া ও ফসফেট সরবরাহ করা সম্ভব। ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমে, একইসঙ্গে অর্থ ও শ্রম সাশ্রয় হয়, খাদ্য উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়।
সার ছাড়াও সরকার কৃষকদের অন্যান্য উপায়েও প্রণোদনা দিয়েছে। চলতি বোরো মৌসুমে ২ দশমিক ৭ লাখ কৃষককে প্রায় ১৭০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্রদান নিঃসন্দেহে ইতিবাচক এবং আশাব্যঞ্জক। এর আওতায় দেশের ছয় লাখ ৮৬ হাজার ৭০০ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে বিনামূল্যে বীজ, সার ও পরিবহন খরচ বাবদ নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
বিশেষ করে খরিপ মৌসুমে গম, ভুট্টা, সরিষা, সূর্যমুখী, চীনা বাদাম, শীতকালীন মুগ, পেঁয়াজ, তিল ইত্যাদির উৎপাদন বাড়াতে এই সহায়তা দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি দেশের মানুষের জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ সুষম খাদ্য নিশ্চিত করতে ফসলের বহুমুখীকরণ, উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড জাত প্রতিস্থাপনসহ উন্নত ও আধুনিক যন্ত্রপাতি গ্রহণ, সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজনও জরুরি।
২০০৯ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশে সার উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সরকার সার সংকট মোকাবিলা, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং আমদানি নির্ভরতা কমাতে বেশ কিছু নীতি ও উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। মূল উদ্যোগগুলোর মধ্যে একটি ছিল সার শিল্পের বেসরকারিকরণ যেখানে বেসরকারি সংস্থাগুলো সার আমদানি ও বিতরণের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
এটি সার সরবরাহ প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতা এবং উন্নত দক্ষতা নিয়ে আসে। সার আরও সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য করার জন্য সরকার কৃষকদের বড় আকারের ভর্তুকি এবং ঋণ সুবিধা প্রদান শুরু করে।
আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ সরকারকে অন্তত তিনগুণ দামে সার কিনতে হচ্ছে। অন্যদিকে স্থানীয় বাজারে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি হওয়া সারের দাম বাড়াতে পারছে না। ফলে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশ সরকার একে উভয় সংকট হিসেবে বর্ণনা করছে।
বাংলাদেশ একটি প্রধান কৃষি প্রধান দেশ হলেও এর প্রায় সব সারই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। কিন্তু আমদানি মূল্য যাই হোক না কেন সরকার ভর্তুকি যোগ করে নামমাত্র মূল্যে কৃষকের কাছে সার বিক্রি করে। কিন্তু এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ কৃষিতে বেশকিছু নতুন পদক্ষেপ নিচ্ছে।
আমাদের দেশে যে সার দরকার তার বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আনতে হয়। কিন্তু করোনা ভাইরাস, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে সারের দাম অনেক বেড়ে গেছে। অনেক দেশে সার কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, রপ্তানি বন্ধ বা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেড়েছে তাই দামও বেড়েছে।
বাংলাদেশে ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি এবং এমওপি সার প্রধানত কৃষিতে ব্যবহৃত হয়। অথচ এক বছর আগে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এক মেট্রিক টন ইউরিয়া ৫০০ ডলারে কেনা হলেও এখন তা ৮০০ ডলার ছাড়িয়েছে। টিএসপি সারের দাম ২০০/৩০০ ডলার হলেও বিক্রি হচ্ছে ৬০০/৭০০ ডলারে। ফলে বেশি দামে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছে সরকার।
তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচও বেড়েছে। সেটাও দামে যোগ হয়। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৬ দশমিক পাঁচ লাখ টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশে উৎপাদন প্রায় ১০ লাখ টন। বাকি চাহিদা রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও কাতার থেকে আমদানি করা হয়।
সাড়ে সাত লাখ মেট্রিক টন টিএসপি সার প্রয়োজন। অথচ দেশে উৎপাদন হচ্ছে এক লাখ মেট্রিক টন। বাকিটা আমদানি করা হয় মরক্কো ও তিউনিসিয়া থেকে। এক দশমিক ছয় লাখ ডিএপি সার প্রয়োজন। এর মধ্যে দেড় লাখ মেট্রিক টন সার বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এই সার মূলত চীন ও জর্ডান থেকে আমদানি করা হয়। এমওপি সারের চাহিদা আট লাখ যার পুরোটাই বেলারুশ, রাশিয়া ও কানাডা থেকে আমদানি করা হয়।
দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে সরকার ইউরিয়া প্ল্যান্টসহ সার কারখানার সম্প্রসারণে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। সরকার বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সার শিল্পের উন্নয়ন তদারকি এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।
সরকারের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়েছে এবং বাংলাদেশ ইউরিয়া উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। দেশে অন্যান্য ধরনের সারের উৎপাদনও বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ ডায়ামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) এবং মিউরেট অফ পটাশ (এমওপি) আগে আমদানি করা হয়েছিল কিন্তু এখন আর আমদানি করা হয় না। কৃষকদের মধ্যে সারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে এবং সারের বাজার মূল্য কৃষকদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে।
এছাড়া, রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরতা কমাতে সরকার জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছে। জৈব সার ব্যবহার মাটির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ায় এবং রাসায়নিক সারের নেতিবাচক পরিবেশগত প্রভাব কমায়।
সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশে সার উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে শেখ হাসিনা সরকারের প্রচেষ্টা দেশের কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারী নীতি ও উদ্যোগগুলো সারের প্রাপ্যতা এবং সহজলভ্যতা নিশ্চিত করেছে, আমদানির উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করেছে এবং উন্নত টেকসই কৃষি পদ্ধতির উন্নতি করেছে।
এমনকি দুই দশক আগেও বাংলাদেশে সার সংকট শুধু কৃষি উৎপাদনই কমিয়ে দেয়নি বরং কৃষকদের জীবন ও জীবিকার ওপরও বিধ্বংসী প্রভাব ফেলেছিল। কিছু ক্ষেত্রে সারের জন্য আন্দোলনকারী কৃষকদের তাদের জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে। ওই সময় নিহত কৃষকদের পরিবার ওই হত্যাকাণ্ডের বিচার পায়নি। তবে বর্তমান সরকারের কৃষকবান্ধব নীতি বাস্তবায়নের কারণে সেসব ভয়াবহ ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর দেখা যায় না। কৃষকদের এখন সারের জন্য আন্দোলন করতে হবে না। বরং বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মচারী ও স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা কৃষকদের বাড়িতে সার কার্ড পৌঁছে দেন।
বর্তমান সরকার কৃষকদের সাশ্রয়ী মূল্যে পর্যাপ্ত সার সরবরাহ নিশ্চিত করে কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটাতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। আর এই কারণেই বাংলাদেশ প্রায় সব ক্ষেত্রেই কৃষিপণ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে ফলে দুই বছর ধরে চলমান করোনা মহামারির নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের মানুষের ওপর খুব একটা পড়েনি।
অন্যান্য খাতের মতো কৃষি খাতে বর্তমান সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগের কারণে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে সারের চাহিদার কারণে কোনো কৃষক মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। এমনকি কৃষকদেরও সারের জন্য আন্দোলন করতে রাস্তায় নামতে হয়নি।
সৌজন্যে, ঢাকা পোস্ট।